৯ মার্চ ১৯৭১ – ইয়াহিয়াকে ভাসানী, স্বাধীনতা মেনে নিন | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস

৯ মার্চ ১৯৭১ | ইয়াহিয়াকে ভাসানী, স্বাধীনতা মেনে নিন | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস : স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা এবং অজস্র ঘটনা। এখানে রইল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্তেকটি দিনের বিবরণ।

৯ মার্চ ১৯৭১
ইয়াহিয়াকে ভাসানী – স্বাধীনতা মেনে নিন

৯ মার্চ ১৯৭১ - ইয়াহিয়াকে ভাসানী, স্বাধীনতা মেনে নিন | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস
মাওলানা ভাসানী

 

আওয়ামী লীগের ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই দিনেও রাজনীতির উত্তাপ অব্যাহত ছিল। দিনের আলোচিত ঘটনা ছিল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর বৈঠক এবং পল্টন ময়দানের জনসভায় ভাসানীর বক্তৃতা।

আওয়ামী লীগ ঘোষিত আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী এই দিন সচিবালয়সহ সারা দেশে সব সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও জেলা কোর্ট প্রভৃতিতে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু যেসব সরকারি অফিস খোলা রাখার নির্দেশ দেন, কেবল সেসব চালু থাকে। সারা দেশে ব্যাংকিং কাজকর্ম চলে। বাস, মোটরগাড়ি, রিকশা ও অন্য যানবাহন চলাচল করে। দোকানপাট ও হাটবাজার খোলা থাকে। লঞ্চ ও ট্রেন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করে। অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, ভবন ও যানবাহন এবং বাসগৃহে কালো পতাকা ওড়ানো হয়।

মুক্তি আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে অর্থদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন।

রাজশাহী শহরে প্রতি রাতে রাত নয়টা থেকে আট ঘণ্টা অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। আওয়ামী লীগ এক বিবৃতিতে বলে, সেনাবাহিনীকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর রাজশাহীতে হঠাৎ কারফিউ জারির কারণ বোধগম্য নয়। এর জন্য নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে কারফিউ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
জামায়াতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার আমির গোলাম আযম দেশকে চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান।

 

ভাসানীর জনসভা:

পল্টনের জনসভায় ভাষণ দিতে মাওলানা ভাসানী ৯ মার্চ সকালে সন্তোষ থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে টেলিফোন করেন। ফোনে দুই নেতার আলোচনার পর আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের কেন্দ্রীয় নেতারা প্রায় আড়াই ঘণ্টা বৈঠক করেন।

পল্টন ময়দানের জনসভায় তুমুল করতালির মধ্যে ন্যাপ নেতা মাওলানা ভাসানী ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নিতে বলেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশমতো ২৫ মার্চের মধ্যে কিছু না করা হলে শেখ মুজিবের সঙ্গে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল গণ-আন্দোলন শুরু করবেন।

 

মাওলানা ভাসানী ৯ মার্চ ১৯৭১ - ইয়াহিয়াকে ভাসানী, স্বাধীনতা মেনে নিন | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস

মাওলানা ভাসানী তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে বলেন, কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে, শেখ মুজিবুর রহমান আপস করতে পারেন। কিন্তু শেখ মুজিব অবিশ্বাস করার মতো লোক নন। তিনি বলেন, ‘তাকে আমি রাজনীতিতে হাতেখড়ি দিয়েছি। আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতি হিসেবে ৩১ জন জেনারেল সেক্রেটারির সাথে কাজ করেছি। তাঁদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানই ছিল শ্রেষ্ঠ সেক্রেটারি।’

৯ মার্চ সরকারিভাবে জানানো হয় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কয়েক দিনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান সফর করবেন।

‘স্বাধীন বাংলাদেশ’: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ক্যানটিনে সকালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-জনসভায় গৃহীত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

আরেক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের জন্য অনুরোধ জানানো হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখনকে নিয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’-এর ওপর স্বাধীনতা আন্দোলনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।

ছাত্রলীগের জেলা ও শহর থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট শাখার সভাপতিকে আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদককে সম্পাদক করে এবং ৯ জন সদস্য নিয়ে মোট ১১ জনের সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করার নির্দেশ দেওয়ার জন্যও প্রস্তাব আনা হয়।

পরবর্তী কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’-এর পরিবর্তে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ নাম ব্যবহার করারও প্রস্তাব গৃহীত হয়।

 

টিক্কা খান সামরিক প্রশাসক:

গভীর রাতে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে এক ঘোষণায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে ‘খ’ অঞ্চলের (পূর্ব পাকিস্তান) সামরিক প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। টিক্কা খান ৭ মার্চ সামরিক বিমানে ঢাকায় এসেছিলেন। ৯ মার্চ তাঁর গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঢাকা হাইকোর্টে হরতাল চলাকালে প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী নবনিযুক্ত সামরিক গভর্নরের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেন।

টিক্কা খান

 

আন্দোলনের বিপক্ষে হক-তোয়াহা:

আবদুল হক ও মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) তাদের বিলি করা এক প্রচারপত্রে গণ-আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।

প্রচারপত্রে বলা হয়, ‘পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং পূর্ব বাংলার তথাকথিত দরদি বিশ্বাসঘাতক নেতাদের পরামর্শদাতা হলো কুখ্যাত নরপশু মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড।…গত কিছুদিন যাবৎ ঘন ঘন পূর্ব বাংলায় এসে এখানেও ব্যাপক হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। বিশ্বের মেহনতি মানুষের বড় দুশমন এই হিংস্র জানোয়ারদের সঙ্গে যেসব তথাকথিত বাংলার দরদি নেতারা বৈঠক করে, ষড়যন্ত্র করে এবং লাঞ্ছিত, শোষিত মানুষকে শান্ত থাকতে উপদেশ দেয়, তারা গরিব কৃষক-শ্রমিকের বন্ধু হতে পারে না।’

২ মার্চ ১৯৭১ সর্বাত্মক হরতাল ঢাকায় 1 ৯ মার্চ ১৯৭১ - ইয়াহিয়াকে ভাসানী, স্বাধীনতা মেনে নিন | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস

 

বামপন্থী দলের তৎপরতা:

পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ) একটি প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্রে বলা হয়, কিছু তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তারা বলছে ধর্মঘট বা অসহযোগ আন্দোলন প্রভৃতির প্রয়োজন নেই। বরং তারা গ্রামে গ্রামে কৃষিবিপ্লব শুরু করার এবং জোতদারদের গলা কাটার আওয়াজ তুলছে। কোনো কোনো নেতা ‘স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে’ বলে ধ্বনি তুলে চলমান গণসংগ্রামের উদ্দীপনা ও সংকল্পে ভাটা এনে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা এক বিবৃতিতে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রতিরোধ বাহিনী গঠন করে সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য দলীয় কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।

 

আরও দেখুন…

Leave a Comment