২৪ মার্চ ১৯৭১ | বঙ্গবন্ধু : স্বাধীনতার সংগ্রাম চলবে | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস: স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা এবং অজস্র ঘটনা। এখানে রইল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্তেকটি দিনের বিবরণ।
বঙ্গবন্ধু : স্বাধীনতার সংগ্রাম চলবে
সরকারি অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই দিনেও হরতাল পালিত হয়। দেশজুড়ে বাড়িতে বাড়িতে উড়ছিল স্বাধীন বাংলার পতাকার পাশাপাশি কালো পতাকাও। সারা বাংলায় লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের মুখে সামরিক সরকারের লোকজন বোমাবাজি ও হামলা শুরু করে। ২৪ মার্চ ১৯৭১ তারিখে তারা ঢাকার মিরপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটায়।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবন অভিমুখে ছিল মিছিল আর মিছিল। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি চূড়ান্ত সংগ্রামের নির্দেশ দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকব কি না জানি না। স্বাধীনতা আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।’
চট্টগ্রামে জনতা-সেনাবাহিনী সংঘর্ষ হয়। সৈয়দপুরে সেনাবাহিনীর প্রশ্রয়ে অবাঙালিরা বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। গুলিবর্ষণে অনেক মানুষ হতাহত হয়। আগের রাত থেকে সকাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ি, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে হত্যাকাণ্ড চালায়। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনী ও অবাঙালিরা সম্মিলিতভাবে বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয়। নিরস্ত্র বাঙালিদের গুলি করে হত্যা করে।
রংপুর হাসপাতালের সামনে জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনারা রংপুর সেনানিবাস এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। এতে অনেকে হতাহত হয়।
সন্ধ্যায় ঢাকার মিরপুরে সেনাবাহিনীর সাদাপোশাকধারী লোকদের সহযোগিতায় অবাঙালিরা জোর করে বাঙালিদের বাড়ির ছাদ থেকে স্বাধীন বাংলার পতাকা ও কালো পতাকা নামিয়ে তাতে আগুন দেয়। এরপর পাকিস্তানের পতাকা তোলে। কিছু জায়গায় বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন দেয়।
ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে পাহারারত সেনারা টিভি কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামে অস্ত্র খালাসে বাধা:
বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে নোঙর করা এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে যায়। খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষ বন্দরে গিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলে। জনতা জেটি থেকে কদমতলী পর্যন্ত চার মাইল পথের বিভিন্ন স্থানে ব্যারিকেড দেয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে। সেসব অস্ত্র ট্রাকে তুলে নতুনপাড়া সেনানিবাসে আনার সময় ডবল মুড়িং রোডে একটি ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে জনতা তাদের পথরোধ করে। রাতে সেনারা গুলিবর্ষণ করলে বহু শ্রমিক-জনতা নিহত হয়।
বৈঠক ও বিবৃতি:
সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে সরকার ও আওয়ামী লীগের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক দুই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের ঘোষণা দেওয়া বাকি। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা দীর্ঘ করতে আর রাজি নয়।
চট্টগ্রাম, রংপুর, সৈয়দপুর ও মিরপুরের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তাজউদ্দীন আহমদ গভীর রাতে বিবৃতি দেন। সরকারকে তিনি হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করার উদ্যোগ নেওয়া হলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে।
ইয়াহিয়া-ভুট্টো বৈঠক:
পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো দুপুরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তাঁর উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষে ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত করুণ ও দুর্ভাগ্যজনক। এ অঞ্চলের শোষিত জনগণের প্রতি তাঁর অনেক ভালোবাসা। কিন্তু তাঁর একটি জাতীয় দায়িত্বও রয়েছে। পাকিস্তান অখণ্ড রাখতে তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত।
বিকেলে ওয়ালি ন্যাপ প্রধান খান আবদুল ওয়ালি খান, কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রধান মিয়া মমতাজ মোহাম্মদ খান দৌলতানা, কনভেনশন মুসলিম লীগ প্রধান কাইয়ুম খান, জমিয়তে ইসলামের নেতা মাওলানা শাহ আহমদ নুরানি ও মাওলানা মুফতি মাহমুদ, লীগ নেতা সরদার শওকত হায়াত খান এবং পিপলস পার্টির এ এইচ কারদার, মমতাজ ভুট্টো, গোলাম মোস্তফা জাতোই, হায়াত মোহাম্মদ খানসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা পিআইএর একই ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করেন।
করাচি রওনা হওয়ার আগে ওয়ালি খান গাউস বক্স বেজেঞ্জোকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বাসভবনে সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন।
আরও দেখুন…