১ এপ্রিল ১৯৭১ – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

১ এপ্রিল ১৯৭১ – বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা এবং অজস্র ঘটনা। এখানে রইল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্তেকটি দিনের বিবরণ।

১ এপ্রিল ১৯৭১ | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

১ এপ্রিল ১৯৭১ | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

 

জাতিসংঘের মহাসচিবকে ভারতের চিঠি:

জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের কাছে ১ এপ্রিল ভারতের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন এমন এক স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে যে সেটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় মনে করে নিষ্ক্রিয় থাকার সময় নেই। আন্তর্জাতিক মানবগোষ্ঠীর উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়, মানবদুর্গতির এই মুহূর্তে নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতাকে দুর্গত জনসাধারণ বহির্বিশ্বের উদাসীনতা বলে ভাববে। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে সংযত না করলে এবং আন্তর্জাতিক অভিমত বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সমর্থনসূচক না হলে এ উপমহাদেশে উত্তেজনা বাড়বে।

পাকিস্তানিদের আরও নিয়ন্ত্রণ:

বাংলাদেশ থেকে ভারতমুখী মানুষের ঢল এই দিনও অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য মানুষ এই দিনও সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।

তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিক সরকার ৩০ মার্চ বেলা তিনটার দিকে এক প্লাটুন সেনা নিয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সামরিক কনভয় অ্যামবুশ করেন। লড়াই চলাকালে রফিক সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী হন। রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে নৃশংস অত্যাচারের পর তারা তাঁকে এই দিনে হত্যা করে।

 

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১ এপ্রিল ১৯৭১ - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

 

পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশের আরও কিছু অঞ্চল এই দিন দখল করে সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তবে দেশের বেশির ভাগ মহকুমা (বর্তমানে জেলা) সদর ও কয়েকটি জেলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। টাঙ্গাইল শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। দিনভর যুদ্ধের পর সন্ধ্যার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা শহর ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরে যান।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রতিক্রিয়া:

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে আলোচনা হয়। সিনেটর ফ্রেড হ্যারিস, এডওয়ার্ড কেনেডিসহ আরও কয়েকজন আলোচনায় অংশ নেন। হ্যারিস তাঁর বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে চলেছে, পৃথিবী সে সম্পর্কে জানে না। কারণ, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ রূঢ়ভাবে বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার করেছে। সম্ভবত একমাত্র এভাবেই তাদের সেনাদের পক্ষে নিশ্চিন্তে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব।

৩১ মার্চের নিউইয়র্ক টাইমস­–এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি (হ্যারিস) বলেন, ‘নয়াদিল্লির এক বিশ্বস্ত সূত্র দাবি করছে যে পাকিস্তানি সেনারা পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক নেতাদের টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে গুলি করে মারছে এবং বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করে হত্যা করছে, যাতে সেখানকার মানুষ চিরকালের মতো নিশ্চুপ থেকে যায়। বিশ্বকে অবশ্যই তার নীরবতা ভাঙতে হবে।

 

05 december20181205062423 ১ এপ্রিল ১৯৭১ - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

 

হ্যারিস আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে যে ব্যাপক মানব ধ্বংসযজ্ঞে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে তার আর নৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার অবস্থায় নেই, তবে তাই বলে নিষ্ক্রিয় থাকলেও চলবে না। যুক্তরাষ্ট্রকে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে যে তারা আপাতত পাকিস্তানকে সব সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ রাখবে।

সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে অবর্ণনীয় গণহত্যা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা সমরাস্ত্র নিরীহ নাগরিকদের ওপর ব্যবহৃত হচ্ছে। এটা চলছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৫০ হাজার উদ্বাস্তু পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও মানবিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সাহায্য করতে পারেন। তবে সে উদ্যোগ জাতিসংঘের মাধ্যমেই হওয়া উচিত।

 

কেনেডি ১ এপ্রিল ১৯৭১ - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনলিপি

 

ব্রিটেনের কমন্স সভার সদস্য রাসেল জসটন লন্ডনে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা-ই ঘটুক না কেন, দুটি বিষয় উপেক্ষা করার মতো নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করেছে এবং পাকিস্তান সরকার তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। বিষয়টিকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার হিসেবে মেনে নিয়ে যুক্তরাজ্য নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। কমনওয়েলথের প্রবীণ সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্যের দায়িত্ব রয়েছে।

 

আরও দেখুন…

Leave a Comment