শান্তিকমিটির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ – মুনতাসীর মামুন

শান্তিকমিটির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ [ মুনতাসীর মামুন ] : পঁচিশ মার্চ মধ্যরাতে বা ছাব্বিশে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন। প্রায় একই সঙ্গে বা তার একটু আগে পাকিস্তান বাহিনী তাদের হত্যাযজ্ঞ ও ধংস্বের কাজ শুরু করে। স্বাধীনতা বিরোধী বা দালালদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর নীতি নির্ধারকদের আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল।শান্তিকমিটির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ, শান্তি কমিটি ১

পাকিস্তানি ট্যাংকের গোলা নিক্ষেপ তাদের মনে দারুণ উল্লাসের সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তানি নীতি নির্ধারকদের মতো তারাও মনে করতেন, কয়েকহাজার হত্যার পর বাঙালিরা স্তব্ধ হয়ে যাবে। তখন পাকিস্তানিদের সহযোগী হিসেবে তারাই ক্ষমতায় আসবেন। উল্লেখ্য এদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া, বাকী কেউ কখনও নির্বাচনে জয়ী হতে পারেননি।

পাকিস্তানি বা তাদের সহযোগী দালালরা যা ভেবেছিল তা কিন্তু হয়নি। গণহত্যার খবর চাপা দেয়ার চেষ্টা করা সত্ত্বেও, কয়েকদিনের মধ্যে সে খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে সারা বিশ্বে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খান আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন বালুচিস্তানের কসাই হিসেবে। ফলে, তার পক্ষে গণহত্যা সম্ভব এই ধারণা বদ্ধমূল হলো।

নিজের বা পাকিস্তানের ইমেজ ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার ছিল কিছু কর্মতৎপরতার। তাদের ধারণা হলো, বাঙালি রাজনীতিবিদরা তাদের সঙ্গে আছেন এধারণা সৃষ্টি করতে হবে এবং তাদের দিয়েই বাঙালিদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। দক্ষিণপন্থি বাঙালি রাজনীতিবিদরাও তাই চাচ্ছিলেন। কারণ, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এই যোগাযোগকে ভেবেছিলেন তারা প্রথম পদক্ষেপ।

Table of Contents

শান্তিকমিটির প্রতিষ্ঠায় টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক:

এ পরিপ্রেক্ষিতে ১২ জন বাঙালি রাজনীতিবিদ টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। টিক্কা খানও আনন্দে ‘রাজি’ হলেন। ৪ এপ্রিল ১২ জন আওয়ামী লীগ বিরোধী নেতা বঙ্গভবনে বা সাবেক গভর্নর হাউসে গেলেন টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করতে। নেতৃত্ব দিলেন পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন । প্রতিনিধি দলে ছিলেন গোলাম আজম, ফরিদ আহমদ, খাজা খয়ের উদ্দিন, এ.কিউ.এম. শফিকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান, আবদুল মান্নান প্রমুখ ।

আলাপ আলোচনার পর প্রতিনিধি দলের পক্ষ থেকে “অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসনকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস এবং জনগণের মন থেকে ভিত্তিহীন ভয় দূর করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়।”

টিক্কা খান এ প্রস্তাবে আনন্দ প্রকাশ করে “দুষ্কৃতকারী ও সমাজ বিরোধীদের [অর্থাৎ যারা বাংলাদেশ চায়] আশ্রয় না দেওয়া এবং সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কাছে এদের সম্পর্কে সংবাদ পৌঁছে দেয়ার আহবান জানান। শুধু তাই নয় তাদের “শুধু বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় ফলপ্রসূ কাজ করতে নির্দেশ দেন।”

পাকিস্তানিরা চেয়েছিল, তাদের পক্ষের সবাই একই প্ল্যাটফরমে কাজ করবে। কিন্তু বাঙালি বিরোধী অনেকে এক সঙ্গে কাজ করতে রাজি ছিলেন না। বিশেষ করে দলের ফরিদ আহমদ ও নুরুজ্জামান, গোলাম আজম বা জামায়াতের সঙ্গে একই প্ল্যাটফরমে এসে কাজ করতে রাজি ছিলেন না। ফলে ৬ এপ্রিল গোলাম আজম আবার টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে সামরিক বাহিনীর একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়—

“পূর্ব পাকিস্তানের আরো কয়েকজন নেতা গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা ‘গ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নেতৃবৃন্দ সমগ্র প্রদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের এক হ্যান্ড আউটে বলা হয় যে:

সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব হামিদুল হক চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সভাপতি অধ্যাপক গোলাম আজম, জামায়াত ওলামায়ে ইসলামির পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি পীর মহসীন উদ্দিন আহমেদ এবং একজন নেতৃস্থানীয় এডভোকেট এ কে সাদিক [হবে সাদি] পৃথক পৃথকভাবে জেনারেল টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং পাকিস্তানে সশস্ত্র ভারতীয় অনুপ্রবেশে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।রাজাকার গোলাম আজম

তাঁরা বলেন যে, প্রদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ ভারতের দূরভিসন্ধিকে বানচাল করার জন্য সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করবেন। *

একই দিন পত্রিকায় ‘স্বাভাবিক জীবনযাত্রা’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়। এই সম্পাদকীয়তে শান্তিকমিটি গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়

“বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকদের সমন্বয়ে শান্তিকমিটি গঠন এ ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসূ হতে পারে। এ ধরনের শান্তিকমিটি যেমন দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে শান্তিকামী নাগরিকদের জান-মাল রক্ষার কাজে সহায়তা করতে পারবে। অপরদিকে তেমন দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী যে কোনো মহলের যেকোনো প্রচেষ্টার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখাও তাদের পক্ষে সম্ভব হবে। সুতরাং প্রতিটি বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিককে এ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারণ করা উচিত।”

শান্তিকমিটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের পক্ষে যারা আছেন তাদের নিধন করা। পরের দিন জামায়াত নেতা গোলাম আজম, নুরুজ্জামান ও গোলাম সরোয়ারের একটি বিবৃতিই তা প্রমাণ করে। দীর্ঘ বিবৃতির শেষে তারা উল্লেখ করেন :

“ভারতীয়দের জানা উচিত। এ দেশের জনগণ সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের কখনো ত্রাণকর্তা হিসেবে মনে করেন না। পূর্ব পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের কোন স্থানে দেখামাত্র খতম করে দেবে বলে তারা দৃঢ় আস্থা পোষণ করেন।”

ঢাকা নাগরিক শান্তিকমিটি প্রতিষ্ঠা :

টিক্কা খান ৯ এপ্রিল প্রাদেশিক গভর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার পরপরই ১৪০ সদস্যের ‘ঢাকা নাগরিক শান্তিকমিটি’ গঠিত হয়। তবে, এই সংবাদটি প্রকাশিত হয় ১১ এপ্রিল:

“ঢাকার দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে গতকাল শনিবার ১৪০ সদস্যের একটি নাগরিক শান্তিকমিটি গঠন করা হয়েছে। … গতকাল কমিটির বৈঠকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ এবং পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশের তীব্র নিন্দা করা হয়। …

বৈঠকে আরও বলা হয়, ভারত পাকিস্তানের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে আগুন নিয়ে খেলা করছে।

… পূর্ব পাকিস্তান কাউন্সিল মুসলিম লীগের সভাপতি খাজা খয়েরুদ্দিনকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটিতে যে সকল নেতৃবৃন্দ রয়েছেন তারা হলেন, জনাব একিউএম শফিকুল ইসলাম, মৌলভী ফরিদ আহম্মদ, অধ্যাপক গোলাম আযম, পীর মোহসেন উদ্দিন, জনাব মাহমুদ আলী, জনাব এএসএম সোলায়মান, জনাব আবুল কাসেম এবং জনাব আতাউল হক খান প্রমুখ নাগরিক শান্তিকমিটি আগামী মঙ্গলবার ঢাকায় এক মিছিল বের করবে। মিছিলটি ঢাকার প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করবে।”

কেন্দ্রীয় শাস্তিকমিটির ১৪০ জনের তালিকা সংগ্রহ করা যায়নি। তবে, বিভিন্ন সূত্রের সাহায্যে ৩৪ জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন:

  • মুসলিম লিগ নেতা খাজা খয়েরউদ্দিন
  • জামায়াতের সভাপতি গোলাম আযম
  • অ্যাডভোকেট একিউএম শফিকুল ইসলাম
  • পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ইত্তেহাদুল উম্মাহর নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম
  • মুসলিম লিগ নেতা আব্দুল জব্বার খদ্দর
  • মাহমুদ আলী, ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া
  • এমএকে রফিকুল ইসলাম, আবুল কাসেম
  • জামায়াত নেতা গোলাম সারওয়ার
  • সৈয়দ আজিজুল হক ওরফে নান্না মিয়া
  • এএসএম সোলায়মান
  • পীর মোহসেন উদ্দিন ওরফে দুদুমিয়া
  • শফিকুর রহমান, মেজর (অব.) আফসারউদ্দিন
  • সৈয়দ মোহসেন আলী, ফজলুল হক চৌধুরী
  • মুসলিম লিগ নেতা মোঃ সিরাজুদ্দিন
  • অ্যাডভোকেট এটি সাদি
  • অ্যাডভোকেট আতাউল হক খান
  • মকবুলুর রহমান
  • নেজামে ইসলামের মকবুলুর রহমান
  • জামায়াতের রুহুল কুদ্দুস, নুরুজ্জামান
  • মিয়া মফিদুল হক
  • অ্যাডভোকেট আবু মালেক
  • অ্যাডভোকেট আবদুল নাঈম
  • সিদ্দিক আহমদ
  • আবদুল মতিন
  • ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন
  • তোযায়া বিন হাবিব
  • হাকিম ইরতিজায়ুর রহমান আখুনজাদা
  • চাকমা প্রধান রাজা ত্রিদিব রায়
  • মুসলিম লিগ নেতা ফয়েজ বক্স

পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও জনকল্যাণ কাউন্সিল গঠন:

১০ এপ্রিলই বিরোধ বেঁধে যায় শাস্তিকমিটির নেতাদের মধ্যে। ফরিদ আহমদ, ইসলামিক রিপাবলিক পার্টির নুরুজ্জামান প্রমুখ শান্তিকমিটিতে থাকতে অস্বীকার করেন। মনে হয় আদর্শ থেকে নয়। ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খাই ছিল দ্বন্দ্বের কারণ। খুব সম্ভব ফরিদ আহমদ আহবায়ক হতে চেয়ে ছিলেন। ফরিদ আমাদের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি গঠিত হয় যার নাম দেয়া হয়—

‘পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও জনকল্যাণ কাউন্সিল’।

তবে, এটির সংবাদ প্রকাশিত হয় ১৩ এপ্রিল। দৈনন্দিন কাজ চালাবার জন্য একটি স্টিয়ারিং কমিটিও গঠিত হয়:

“ঢাকা, ১২ই এপ্রিল। শান্তিরক্ষা ও পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে আস্থার ভাব ফিরাইয়া আনা এবং দেশের এই অংশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতীয় মিথ্যা প্রচারণা প্রতিহত করার উদ্দেশ্য গত শনিবার মৌলভী ফরিদ আহমদের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়।

এছলামিক রিপাবলিক পার্টির সভাপতি মওলানা নূরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তাঁহাকেই স্টিয়ারিং কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত করা হয়। জনাব কোরবান আলী (বার-এট-ল), জনাব ওয়াজী উল্লাহ খান, জনাব আজিজুর রহমান, জনাব মোস্তাফিজুর রহমান, কাজী ফিরোজ সিদ্দিকী, চট্টগ্রামের অ্যাডভোকেট জনাব এ, কে, করিম নির্বাচিত এমপিএ (স্বতন্ত্র) জনাব মাহমুদ আলী কমিটির কাৰ্যনিৰ্বাহক সদস্য থাকিবেন। বিস্তারিত  কর্মসূচী প্রণয়নের জন্য আগামী ১৪ই কমিটি বৈঠকে মিলিত হবে।

এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, সর্বত্র আস্থার ভাব ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং প্রচারণা প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে প্রতি জেলায় শান্তি ও জনকল্যাণ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার জন্য কমিটি পূর্ব পাকিস্তান শাস্তি ও কাউন্সিল সংগঠন অনুপ্রবেশকারীদের মোকাবেলা এবং ভারতীয় প্রচারণায় কর্ণপাত না করিয়া কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণে জনসাধারণকে উৎসাহিত করাই হইবে কাউন্সিল সমূহের কমিটিতে এ ছাড়াও ছিলেন আবদুল মান্নান [পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান তাকে ধর্ম মন্ত্রী করেন, দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা], জুলমত আলী খান [পরবর্তীকালে বিএনপি নেতা]

শান্তিকমিটির বিক্ষোভ মিছিল:

১২ এপ্রিল সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা নাগরিক শান্তিকমিটি একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলটি ‘টিক্কা খান’ জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়ে নবাবপুর, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, মিটফোর্ড, চকবাজার, আজিমপুর হয়ে নিউমার্কেট অব্দি যায়। সেদিন ছিল ঝড়ো আবহাওয়া, বৃষ্টি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেদিন গোলাম আজম, খান সবুর বা খয়ের উদ্দিনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সভার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে দৈনিক সংগ্রাম খবর ছেপেছিল—

“নয়াদিল্লী বেতারের ভিত্তিহীন ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা এবং পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশের মাধ্যমে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতের নির্লজ্জ হস্ত ক্ষেপের প্রতিবাদে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশের উদ্দেশ্যে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা নগর শান্তিকমিটির আহ্বানে রাজধানী ঢাকার সকল শ্রেণীর জনগণ এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। শাস্তিকমিটির আহ্বায়ক জনাব সৈয়দ খাজা খয়েরুদ্দিনের নেতৃত্বে মিছিলটি বেলা ২টা ৪০ মিনিটে বায়তুল মোকাররম থেকে বেরিয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করার পর নিউমার্কেটে এসে শেষ হয়।

মিছিলের পুরোভাগে নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন:

  • পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী প্রধান অধ্যাপক গোলাম আযম
  • কাউন্সিল মুসিলম লীগের সহ-সভাপতি জনাব একিউএম শফিকুল ইসলাম
  • সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য খান সুবর
  • পিডিপির সহ-সভাপতি মৌলভী ফরিদ আহম্মদ ও জনাব মাহমুদ আলী
  • কৃষক শ্রমিক পার্টি প্রধান জনাব এএসএম সোলায়মান
  • জনাব আব্দুল জব্বার খদ্দর
  • ইসলামী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম
  • পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম প্রধান পীর মোহসেন উদ্দিন
  • জনাব আবুল কাসেম
  • সৈয়দ আজিজুল হক
  • ইউসুফ আলী চৌধুরী
  • ইসলামী ছাত্রসংঘ প্রধান জনাব মতিউর রহমান নিজামী
  • অ্যাডভোকেট এটি সাদী
  • কবি বেনজীর আহমদ
  • মেজর আফসার উদ্দীন

… কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বৃহৎ আকারের ছবিও মিছিলে শোভা পেতে দেখা যায়।

মুসলধারে বৃষ্টিপাতকে উপেক্ষা করে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’, পাকিস্তানের উৎস কি-‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ শ্লোগানে মুখরিত সুশৃঙ্খল জনতার মিছিল নবাবপুর রোড ধরে অগ্রসর হয়। নবাবপুর রেল ক্রসিং অতিক্রম করতে মিছিলটির ৪৫ মিনিট সময় লাগে। কলেমা খচিত শত শত ব্যানার আর লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানি ঝাণ্ডা হাতে তৌহিদী জনতা দৃঢ় পদক্ষেপে আগে বাড়তে থাকে।শান্তি কমিটির আবেদন, ১৯৭১

‘মিথ্যা প্রচার বন্ধ কর।’ ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ সাম্রাজ্যবাদ-মুর্দাবাদ’ শ্লোগান দিতে দিতে জাগ্রত জনতার মিছিল সিপাহী আন্দোলনের শহীদানের মিনারকে সাক্ষী রেখে সদর ঘাটের দিকে অগ্রসর হয়।…

মিছিলটির একটি ট্রাকে ভারতীয় সৈন্য ও ইন্দিরা গান্ধী সাজিয়ে তাদেরকে ধৃত অবস্থায় রাখা হয়। মিছিলে জুতার মালা পরিহিতা ইন্দিরা গান্ধীর একটি কুশ পুত্তলিকাও বহন করা হয়। …

নেতৃবৃন্দের কণ্ঠ থেকেও উৎসারিত হয় কণ্ঠে কণ্ঠে গর্জিত হয় গগণ বিদারিত শ্লোগান ‘রুশ ভারত সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জিন্দাবাদ’, ‘আমার নেতা তোমার নেতা—বিশ্বনবী মোস্তফা’, ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ—মানব না, মানব না’, ‘জেগেছে জেগেছে—মুসলিম জেগেছে’, ‘ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার’ ইত্যাদি।

… মিছিল শেষে, জামায়াত ইসলাম পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্য দীর্ঘ মুনাজাত করেন:

“পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী প্রধান অধ্যাপক গোলাম আযম মিছিল শেষে মুনাজাত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন তিনি বলেন, ভারতের কোটি কোটি মুসলমানের রক্তের ওপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই পাকিস্তানেও মুসলমানদেরকে রক্ত দিতে হয়েছে। তিনি আল্লাহর দরগাহে দোয়া করেন যেন আর রক্ত দিতে না হয়।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সত্যিকারের মুসলিম সৈনিক হিসেবে দেশ রক্ষার যোগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহর দরগাহে দোয়া করেন। পাকিস্তানের স্থায়িত্ব ও অখণ্ডতা বজায় রাখার জন্যে দোয়া করেন। সত্যিকারের মুসলমান ও পাকিস্তানি হিসেবে বেঁচে থাকার ও পাকিস্তানকে চিরদিন ইসলামের আবাসভূমি হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে দোয়া করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র ১৯৮৭ সালে যে গবেষণা জরিপ চালিয়ে ছিল তাতে জানা যায়, পুরনো ঢাকা, আজিমপুর দিয়ে মিছিলটি যাবার সময় বিভিন্ন বাড়ি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এবং “বেশ কিছু বাঙালিকে ধাওয়া করে হত্যা করে রাস্তার পাশে লাশ ফেলে রাখা হয়।

শান্তিকমিটির ওয়ার্কিং কমিটি:

ঢাকা নাগরিক শান্তিকমিটির অফিস ছিল মগবাজারের ৫ এলিফ্যান্ট লেনে। কমিটির কাজে গতিশীলতা আনার জন্য ১৪ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ২১ সদস্যের একটি ওয়ার্কিং বা কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়। তাঁরা ছিলেন, খাজা খয়েরদ্দিন, আহ্বায়ক, একিউএম শফিকুল ইসলাম, গোলাম আযম, মাহমুদ আলী, আবদুল জব্বার খদ্দর, ‘মওলানা’ সিদ্দিক আহমদ, আবুল কাশেম, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), ‘মওলানা’ সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম, আবদুল মতিন, ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন, অধ্যাপক গোলাম সরওয়ার, এএসএম সোলায়মান, পীর মোহসেন উদ্দীন (দুদু মিয়া), এ কে রফিকুল হোসেন, নুরুল আমিন, আতাউল হক খান, তোহাবিন হাবিব, মেজর আফসারুদ্দীন, দেওয়ান ওয়ারেসাত আলী ও হাকিম ইরতিযুর রহমান আখুনজাদা।

ওয়ার্কিং কমিটির তরফ থেকে শাখা কমিটিগুলির কাছে নির্দেশ:

২১ জুন ওয়ার্কিং কমিটির তরফ থেকে শাখা কমিটিগুলির কাছে একটি নির্দেশ পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগ্রহে এই দলিলটি আছে । দলিলটির প্রতিচিত্র তাদের ১০০টি আলোকচিত্র সংগ্রহেও আছে। তবে ক্যাপশনে যে লেখা আছে ২১ জুন ১৯৭১ কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠনের দলিল তা ভুল। নির্দেশটি ইংরেজীতে। এখানে সংক্ষেপে তার বাংলা অনুবাদ প্রদান করছি ওপরে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নাম ছাপা হয়েছে প্রথম নামটি গোলাম আযমের।

ক. জেলা শহর এবং মহকুমা শান্তি কমিটির সমস্ত কার্যাবলীর বর্ণনা ও কমিটির সদস্যদের নামের তালিকার তিন কপি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠাতে হবে। যা জানানোর জন্য এবং স্বীকৃতির জন্য সেনা কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হবে। এই অফিসে জেলা কমিটির নামে একটি নথি খোলা হবে এবং প্রতিদিন স্থানীয় পত্রিকায় এ সম্পর্কিত রিপোর্ট সেখানে নথিবদ্ধ হবে।

খ. কেন্দ্রীয় কমিটি যেভাবে গঠিত হয়েছে তা অনুসারে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন করতে হবে।

গ. কমিটির নীতি বাস্তবায়নে সাধারণ কমিটির সদস্যদের নিয়ে একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করতে হবে।

ঘ. এ প্রক্রিয়ায় যে সব মহকুমা ও থানা কমিটি গঠিত হয়নি সেগুলোকে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে কমিটি গঠন করতে হবে। ইউনিয়নের ব্যাপারেও তা প্রযোজ্য। কোন পর্যায়ের কমিটিতে যেন (Anti state and anti social element) অন্তর্ভুক্ত না হয়। স্থানীয় সিভিল প্রশাসনের কোন কর্মচারী যদি অন্তর্ভুক্তকরণের জন্য চাপ সৃষ্টি করে তবে সামরিক কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে।

ঙ. সামরিক কর্তৃপক্ষ থেকে স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে দেশপ্রেমীদের থেকে রাজাকার ও গ্রামরক্ষী নিযুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাদের রাইফেল ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করা হয় তা জানানোর জন্য স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এ কারণে শান্তি কমিটির অধীনে একটি প্রতিরক্ষা উপকমিটি গঠন করতে হবে যারা শুধু এ বিষয়টিই দেখবে।

চ. পরিত্যক্ত বাড়ি ঘর সম্পত্তি সাময়িকভাবে বরাদ্দ দেয়ার জন্য ডিসিদের প্রতি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চিফ সেক্রেটারি একটি নির্দেশ পাঠিয়েছেন। এ কমিটিতে স্থানীয় শান্তি কমিটির প্রতিনিধি থাকবে যার প্রধান হবে সামরিক অফিসার। এছাড়া আরও কয়েকটি নির্দেশ ছিল। যার মধ্যে বলা হয়েছিল সব শান্তি কমিটির আহ্বায়ক বা সভাপতি পদাধিকার বলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সাধারণ সভা আহ্বান করা হয়েছিল। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন খাজা খয়েরউদ্দিন।

শান্তিকমিটির নাম পরিবর্তন:

একই সঙ্গে নাগরিক শান্তিকমিটির নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি রাখা হয়। তবে, সারা বাংলাদেশে তা শান্তিকমিটি নামেই পরিচিত ছিল।

নাম পরিবর্তনের পর তা এবং তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত করার জন্য শান্তিকমিটির ১৬ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ১৬ এপ্রিল। প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন কিন্তু নূরুল আমিন। কমিটির সদস্যরা তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা দেন এবং গভর্নরকে জনসাধারণের কতিপয় অসুবিধা সম্পর্কেও জানান। কিন্তু, সেই জনসাধারণ বা তাদের অসুবিধা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে, কমিটির কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, এই জনসাধারণ ছিল পাকিস্তানি সমর্থকরা। পত্রিকার খবর অনুযায়ী:

“আলোচনা চলাকালে শান্তিকমিটির সদস্যরা গভর্ণরকে জানান যে, জনসাধারণ ভারতের হীন চক্রান্ত সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর পিছনে রয়েছে।

গভর্ণর সদস্যগণকে জনসাধারণের বিভিন্ন প্রকৃত সমস্যা পর্যালোচনা ও সে সব সমাধানের উদ্দেশ্যে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস প্রদান করেন।

শান্তি কমিটির যে সব সদস্য গভর্ণরের সাথে সাক্ষাৎ করেন তাঁরা হলেন সৈয়দ খাজা খয়েরুদ্দীন (আহবায়ক), জনাব একিউএম শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম আজম, জনাব মাহমুদ আলী, জনাব আবদুল জব্বার খদ্দর, জনাব মোহন মিয়া, মওলানা সাইয়েদ মোহাম্মদ মাসুম, জনাব আবদুল মতিন, অধ্যাপক গোলাম সারওয়ার, জনাব এ.এস.এম. সুলায়মান, জনাব এ.কে.রফিকুল হোসেন, জনাব নূরুজ্জামান, জনাব আতাউল হক খান, জনাব তোহা বিন হাবিব, মেজর আফসার উদ্দিন ও হাকিম ইরতেজাউর রহমান খান।

ঢাকার সব থানায় শান্তিকমিটির লিয়াজো অফিসার নিয়োগ:

এরপর কমিটি সাংগঠনিক বিস্তৃতি ও বুনিয়াদ শক্তিশালী করার কাজ শুরু করে। ঢাকা শহরে তারা ৬টি থানার জন্য ২৩ জন লিয়াজো অফিসার নিয়োগ করে। এ ছাড়া, বিভিন্ন এলাকায় শাখা কমিটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে অনুযায়ী স্বতস্ফূর্তভাবে এবং কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে সারা বাংলাদেশে কমিটি স্থাপিত হতে থাকে। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি জানায়।

বহুস্থানে ইতিপূর্বেই ইউনিট কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইউনিট কমিটিসমূহের কার্যকলাপ সম্পর্কে যাবতীয় খবর, ৫, এলিফ্যান্ট লেন, মগবাজার, ঢাকা ঠিকানায় কেন্দ্রীয় শাস্তিকমিটির অফিসে প্রেরণ করতে হবে। সর্বসাধারণের সুবিধার জন্য কেন্দ্রীয় অফিস ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে এবং অফিস সেক্রেটারী অ্যাডভোকেট জনাব নূরুল হক মজুমদার সর্বসাধারণের সমস্যাবলি সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অফিসে অবস্থান করবেন।

প্রদেশের সর্বত্র শান্তি কমিটি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য প্রতিদিন শান্তি কমিটির বৈঠক হয়ে থাকে। জনসাধারণকে স্বাভাবিকভাবে জীবন যাত্রার নির্বাহে উদ্বুদ্ধ করিয়া তোলার জন্য এবং বিভিন্ন স্থানে ইউনিট শান্তি কমিটি গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি বিভিন্ন জেলায় ও মহকুমায় নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

কমিটির তরফ হতে তার সদস্যদের মধ্য হত লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগ করা হয়েছে। তারা জনসাধারণের অসুবিধাদি সম্পর্কে তথ্যাদি গ্রহণ করবেন এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আর্মি সেক্টরের সাহায্য গ্রহণ করে ঐগুলির প্রতিকারের ব্যবস্থা করবেন। তাঁরা ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছেন।

প্রতিদিন কেন্দ্রীয় অফিসে রিপোর্ট দাখেলের জন্য লিয়াজোঁ অফিসারদের নাম ও ঠিকানা নিম্নে প্রদত্ত হলো।

শান্তিকমিটির লিয়াজো অফিস কোতোয়ালী থানা :

১। জনাব আজিজ আহমেদ শাহ, আহসান মঞ্জিল, ৯৭, আহসানুল্লাহ রোড, ঢাকা। ফোন : ২৪৬৩৪০।
২। জনাব মোহাম্মদ সাকী সুলতান, ১২, কাশাইটার, ঢাকা, ফোন : ২৫১৩৫১।

শান্তিকমিটির লিয়াজো অফিস লালবাগ থানা:

১। আলহাজ্ব নাজির হোসেন, চেয়ারম্যান, লালবাগ ইউনিয়ন কমিটি, ৫৩, জগন্নাথ সাহা রোড, ঢাকা, ফোন: ২৫৩৬৮১৷
২। জনাব এস.এম. হাবিবুল হক, হাউস নং ৬১২, রোড নং ১৮, ধানমন্ডি, ঢাকা, ফোন : অফিস ২৫০৮০৬, বাসা ২৫৪০৬৪। জনাব নোয়া আলী, অ্যাডভোকেট, সেন্ট্রাল রোড, ঢাকা, ফোন : ২৫০২৬১।

শান্তিকমিটির লিয়াজো অফিস সূত্রাপুর থানা:

১। আলহাজ্ব সিরাজুদ্দীন প্রাক্তন এমপিএ, ৯১, হৃষিকেশ দাস রোড, ঢাকা, ফোন : অফিস ২৮১৩৪১, বাসা ২৮২৫৪০।
২। জনাব মাহতাবুদ্দীন খান ৫৪, আর.কে, মিশন রোড, ঢাকা, ফোন : ২৪৫৩৫৪।
৩। ফজলুল হক, ১২, ফরাশগঞ্জ, ঢাকা, ফোন: ২৫৭৫৯৬।
8। জনাব তমিজউদ্দিন, ৩১, জরিয়াত আলী লেন, ফোন: ২৫৭২৫৬।
৫। জনাব আবদুর রশীদ, ১৬ হাটখোলা রোড, ফোন: ২৫০৯০৯।

শান্তিকমিটির লিয়াজো অফিস তেজগাঁও থানা:

১। জনাব ইকবাল ইদরিস, ৭৫, ইন্দিরা রোড, তেজগাঁও, ঢাকা, ফোন : অফিস ২৫১১০৭, বাসা ৩১০৯৮০।
২। জনাব মাহবুবুর রহমান, গুরহা, ফোন: ৩১১১৭১।
৩। এম.এস.এস. হাবিবুল হক, হাউস নং ৬১২, রোড নং ১৮, ধানমন্ডি, ফোন : অফিস ২৫০৮০৬, বাসা ২৫৪০৬৪।
৪। জনাব নোয়াব আলী, হেড মাষ্টার আই.পি.এইচ. স্কুল মহাখালী (অয়্যারলেস কলোনীর নিকট)।

শান্তিকমিটির লিয়াজো অফিস মীরপুর থানা :

১. জনাব লাইক আহমেদ সিদ্দিকী, ২৬, এ/সি মীরপুর ফাষ্ট কলোনী, ঢাকা ।

শান্তিকমিটির লিয়াজো অফিস মোহাম্মদপুর থানা:

১. জনাব এম.এ. বারেক, ৩০/৬, মোহাম্মদপুর কলোনী, ফোন : ৩১১৫৩৮।
২. ডা. ওসমান (‘এ’ ব্লকের মসজিদের নিকট) মোহাম্মদপুর, ঢাকা, ফোন : অফিস ৩১১২৬৮, বাসা ৩১৬৬৯৫।
৩. জনাব সৈয়দ মোহাম্মদ ফারুক, কায়দে আজম রোড, (রাকাকাত খানের বাড়ির নিকট) মোহাম্মদপুর, ঢাকা, ফোন: ২৫৪৮০৮।
৪. জনাব শফিকুর রহমান, অ্যাডভোকেট, ৬৮, ঝিকাটোলা, ঢাকা, ফোন : ২৪৬৪৬৭। জনাব আবদুর রহমী চৌধুরী, হাউস নং ৭৯০, রোড নং ৯৯, ধানমন্ডি।
৫. আর, এ ঢাকা, ফোন : ৩১১০৩৩ ।

শান্তিকমিটির লিয়াজো অফিস রমনা থানা:

১. আতাউল হক খান অ্যাডভোকেট, ১৯৭, বড় মগবাজার, ঢাকা।
২. জনাব জি, এ, খান, অ্যাডভোকেট ২৪, দিলু রোড, এস্কাটন ঢাকা-২, ফোন: ২৫৪০৩৫।
৩. প্রফেসার এ, হাশেম।
৪. জনাব জুলমত আলী খান, অ্যাডভোকেট, ১ পুরানা পল্টন, ঢাকা-২, ফোন : ২৫৪৮৫৫৷
৫. জনাব মোহাম্মদ আয়ুব আলী, সি-৫৮৭, এ চৌধুরীপাড়া, খিলগাঁও, ফোন : ২৫৪৮০৮।
৬. অ্যাডভোকেট এ, ওয়াদুদ মিয়া, শান্তিনগর, ঢাকা।

১৬ এপ্রিল ফরিদ আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিটিও কাজ শুরু করে। ১৪ এপ্রিল এক বৈঠকে তারা সারা পূর্ব পাকিস্তানে কাজ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং কমিটির নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কল্যাণ কাউন্সিল’ [অতঃপর কাউন্সিল হিসেবে উল্লেখ করা হবে। রাখা হয়।

তাদের ঠিকানা ছিল ধানমন্ডির ৫ নং সড়কের ১২ নম্বর বাড়ি [খুব সম্ভব ফরিদ আহমদের]। কমিটির সদস্যদের জেহাদের জন্য প্রস্তুত “এবং পাকিস্তান ও ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রস্তুত থাকার উদ্দেশ্যে পবিত্র কুরান ও সুন্নাহ মোতাবেক জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার উদ্দেশ্যে পর সদস্য, মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক সকল দেশপ্রেমিক নাগরিকের প্রতি আহ্বান”১৭ জানানো হয়।

শান্তিকমিটির মতো কাউন্সিলও লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করে এবং বিভিন্ন এলাকায় কাউন্সিল গঠন তার খবর ধানমন্ডির কার্যালয়ে পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। সভায় ফরিদ আহমদ ছাড়াও নূরুজ্জামান বক্তৃতা করেন –

“সভায় মওলানা নূরুজ্জামান ষ্টিয়ারিং কমিটির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, কমিটি সারা প্রদেশব্যাপী তাহার তৎপরতা অব্যাহত রাখিবে এবং কমিটির মূল লক্ষ্য হইতেছে জনমনে আস্থার ভাব পুনরুদ্ধার করা এবং জীবনের সর্বপর্যায়ে স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা ফিরাইয়া আনা। জনাব নূরুজ্জামান কমিটির লক্ষ্য সম্পর্কে আরও বলেন যে, এছলাম ও পাকিস্তানের দুশমনের সহিত সংগ্রাম করার জন্য জনগণকে প্রস্তুত রাখার ব্যাপারেও আমাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকিবে ।”

কাউন্সিলের লিয়াজোঁ অফিসার [বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন:

১. রামপুরা, মোহাম্মদ আলী সরকার [অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী]।

২. মালিবাগ, ইদ্রিস আহম্মদ, ২৭১, মালিবাগ ।

৩. স্টেডিয়াম, মোহাম্মদ আলী সরকার।

৪. আর্মেনীটোলা, শাহ ইসমাইল উল্লাহ চিশতি, ১২ গোবিন্দ দাস লেন।

৫. তাসওয়ার হোসেন খান, ২, বাসাবাড়ি লেন ।

৬. ইংলিশ রোড, আবদুল মজিদ, ৬৬ পাতলা খান লেন।

৭. ১৯ উর্দু রোড, মোঃ ইসহাক।

কাউন্সিলকে সমর্থন করেছিলেন নওয়াব হাসান আসকারী এবং ঢাকার কিছু সরদার। হাসান আসকারী ১৮ এপ্রিল ঢাকার পঞ্চায়েতের কয়েকজন সরদারকে ডেকে পাঠান। একসময় পঞ্চায়েতের সরদাররা ঢাকার ‘নওয়াব’দের সঙ্গে কাজ করতেন, নওয়াবদের অনুগত ছিলেন। ঐ সময় ‘নওয়াববাড়ি’র প্রধান ছিলেন আসকারী। তিনি আবার মুসলিম লিগের নেতাও ছিলেন।

সরদারদের মধ্যে ছিলেন আবু নাসের, ঢাকা হোটেলের মালিক আবদুল মাজেদ সরকার, শিল্পপতি সিরাজুদ্দিন। বিশেষ আমন্ত্রণে যোগ দেন ফরিদ আহমদ ও মুহাম্মদ নূরুজ্জামান। ঢাকা সমিতির নেতৃবৃন্দও কাউন্সিলকে সমর্থন করেন। সমিতির পক্ষে স্বাক্ষর করেন, সভাপতি সিরাজুদ্দীন আহমদ, প্রতিষ্ঠাতা কোষাধ্যক্ষ মাজেদ আলী সরদার, সহ-সভাপতি মওলাবখশ সরদার, সাধারণ সম্পাদক এস.এ. ওয়াজেদ আলী ও মোহাম্মদ আলিম শাহাবুদ্দীন আহমদ।

বিবৃতিতে তারা উল্লেখ করেন, ‘জনগণ’ যাতে ‘এছলাম’ ও ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রচারণায়’ কর্ণপাত না করে। তারা আরো বলেন

“আমরা ইহাও স্মরণ করাইয়া দিতে চাই যে, ঢাকায় পাকিস্তানের এই ভূমিতে ১৯০৫ সালে শাহাবাগে পাকিস্তানের বীজ সর্বপ্রথম বপন করা হয় এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর রহমতে এই ঢাকা শহরেই ভারতীয় ও পাকিস্তানের বীজ অন্যান্য শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার জন্য এক নম্বর ঘাঁটি হিসাবে থাকিবে। শহরে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাত্রা কায়েম হইয়াছে এবং আল্লাহর
দোওয়ায় নাগরিকগণ শহরে ও সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে শূন্যতা পূরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও জনকল্যাণ পরিষদের সহিত সহযোগিতায় স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করিয়া যাইতেছেন।

মৌলভী ফরিদ আহম্মদের নেতৃত্বে ও পরিচালনাধীন গঠিত পূর্ব পাকিস্তান শান্তি ও জনকল্যাণ পরিষদের কর্মতৎপরতার প্রতি আমরা আন্তরিকভাবে সমর্থন জানাইতেছি । জানমালের নিরাপত্তা সম্পর্কে কোন প্রকার আশংকা অথবা সন্দেহ ব্যতিরেকে স্বাভাবিক পেশাগত কাজকর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য আমরা প্রত্যেকের নিকট আবেদন জানাইতেছি। পরিশেষে আমরা ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বীর সশস্ত্র সেনাবাহিনীর প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করিতেছি।

লিয়াজো অফিসার বদল :

১৯ এপ্রিল শান্তিকমিটির এক সভায় কয়েকজন লিয়াজো অফিসার বদল করা হয়। তারা হলেন- লালবাগে হাবিবুল হকের বদলে মাহবুবুজ্জামানকে, রমনা থানায় ৩৭৫, উত্তর শাহাজাহানপুরের ফজলুল হক চৌধুরী, ১৫১ দক্ষিণ কমলাপুরে শাহ মফিজুদ্দিন এবং ২২৫ মালিবাগের আবদুল হাইকে।

শুধু তাই নয় দৈনন্দিন কাজ জানবার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয় যার নাম দেয়া হয় কার্য নির্বাহক কমিটি। এর সদস্য ছিলেন- এ.এম. শফিকুল ইসলাম, গোলাম আযম, আবদুল জব্বার খদ্দর, এ.কে.এম সোলায়মান, আবদুল মতিন এবং এসকে খায়েরুদ্দীন (22 ২২ তারিখে কমিটি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি জানায়—“সারা পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রদ্রোহী ব্যক্তিরা সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে এখন পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করছে এবং ২১. ঐ।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস ও শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের হয়রানি করতে শুরু করেছে। সুতরাং এক, জনগণ যেন এদের উৎখাত করতে এগিয়ে আসেন, দুই, ভারতীয় বেতারের ‘বিদ্বেষমূলক প্রচারণা ও রাষ্ট্রদ্রোহীদের গুজব’ ও যেন কান না দেন এবং সশস্ত্র বাহিনীকে যেন ভয় না করেন।

শান্তিকমিটি প্রথমে ঢাকাতেই শাখা কমিটি স্থাপনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় প্রচার শুরু করে। কেন্দ্রীয় নেতারা তাতে অংশ নেন। যেমন গোলাম আজম, মাহমুদ আলী ও আবদুল জব্বার খদ্দর ও আবুল কাসেম খান, শফিকুল ইসলাম, মনসুর আলী ও খদ্দর যান আরামবাগ। জেলা ও মহকুমায়ও শান্তিকমিটির প্রতিনিধিদের পাঠানোর উদ্যোগ নেধাক

 

Dhaka Catholic Cathedral of the Immaculate Conception ঢাকার বিশপের প্রতিষ্ঠান শান্তিকমিটির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ - মুনতাসীর মামুন

 

২৫ এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা শহরে ১৬টি থানা কমিটি গঠিত হয়। ২৪ আগস্ট মাসে ঢাকা শহরে শান্তিকমিটি গঠিত হয়। সভাপতি হন সিরাজুদ্দীন আহমদ, সহ-সভাপতি মাহবুবুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক মো. মনসুর আলী (২৫ শান্তিকমিটির পক্ষ থেকে শান্তি স্কোয়াড গঠিত হয়। কমিটির মতে, এদের কাজ ছিল, ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে ‘শান্তি’ স্থাপন করা।

আসলে তাদের মূল কাজ ছিল আওয়ামী লীগার বা সমর্থক, হিন্দু বা বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের চিহ্নিত করা, প্রয়োজনে তাদের বাড়িঘর লুট বা হত্যা করা। মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের গবেষণা অনুসারে:

“মাথায় সাদা বা লাল পট্টি বাঁধা শান্তিকমিটির এই শান্তি স্কোয়াডের সদস্যরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে বাঙালি হত্যাসহ তাদের বাড়িতে লুটতরাজ ও অগ্নি সংযোগ করে। বাঙালি বিশেষত তরুণ ও যুবকদের দেখামাত্র পিটিয়ে, বেয়নেট চার্জ করে বা গুলি করে হত্যা করে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাঙালিদের বাড়িঘরে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ২৬

ঐ একই গবেষণা অনুসারে মে মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকায় শান্তিকমিটি স্থাপিত হয়। কাউন্সিলও কয়েক জায়গায় কমিটি করে। তবে, মনে হয় হানাদার বাহিনীর সমর্থন ছিল খায়েরুদ্দীনের কমিটির প্রতি। সে কারণে, তারা বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনিক সমর্থনও পায়। কাউন্সিলের প্রতি হানাদারদের সমর্থন ছিল না বটে কিন্তু তাই বলে তাদের কার্যক্রমেও বাঁধা দেয়া হয়নি কারণ তারাও হানাদারদের পক্ষে কাজ করছিল। কিন্তু, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অচিরেই কাউন্সিলের কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়। মূল কমিটিই ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।

শাস্তিকমিটি ও কল্যাণ কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করেছিল মূলত আওয়ামী লীগ ও বামদল বিরোধী চরম ডানপন্থি দলগুলি। এদের মধ্যে জামায়াত ইসলাম ছিল প্রধান। এছাড়া ছিল মুসলিম লিগের বিভিন্ন অংশ, নেজামে ইসলামী, পিডিপি, ইসলামিক রিপাবলিক পার্টি, দক্ষিণ পন্থায় বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গ। একইভাবে এইসব দলের অনুসারীরাই বিভিন্ন জাগায় শাখা কমিটিগুলি গড়ে তোলে। শান্তি কমিটিতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মুসলিম লীগের খাজা খায়রুদ্দীন ও মোহাম্মদ সিরাজুদ্দিন, জামায়াতের গোলাম আযম। এছাড়া ছিলেন আবদুল জব্বার খদ্দর, শফিকুল ইসলাম ও মাহমুদ আলী । কল্যাণ কাউন্সিলে ফরিদ আহমদ ও নূরুজ্জামান।

আওয়ামী লীগ ও বামপন্থি দলগুলি দমনের ফলে রাজনীতিতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল এইসব দলের নেতারা সে শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এসেছিলেন । হানাদাররা চেয়েছিল কিছু বাঙালি রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসুক

যারা তাদের অধস্তন হিসেবে কাজ করবে অন্যদিকে বিশ্ববাসীকে দেখান যাবে, বাঙালিদের একটি অংশ কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব মানতে চায় না। কিন্তু অধিকাংশই চায় । অবরুদ্ধ দেশে যারা আছেন এরা এরা তাদের প্রতিনিধি। আর এইসব রাজনীতিবিদরাও সেই অধস্তনতা মেনে নিতে রাজি ছিলেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল, ক্ষমতাবান হওয়া ঈশ্বরদীর ছাত্রনেতা শহীদুজ্জামান নাসিম নিরাপত্তার কারণে ঈশ্বরদী জামে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেটি এপ্রিল মাসের শেষ দিকের কথা। তাঁর ভাষায়:

“আমরা কিছুটা নিরাপত্তার আশায় ঈশ্বরদী জামে মসজিদে এসে উঠলাম। সেখানে দেখলাম জনৈক মওলানা আলমাদানি সাহেবকে। তিনি জামাত নেতা খোদা বকস খাঁকে পাক বাহিনীর পক্ষে কাজ করা ও পাকিস্তান রক্ষার সবক দিচ্ছেন।”২৭৫

কমিটি গঠন হওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলি ও তাদের নেতারা শান্তি কমিটিকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেন। পিডিপির নূরুল আমিন বা প্রাক্তন মুসলিম লিগের হামিদুল হক চৌধুরী কমিটির সদস্য না হলেও কমিটি গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। মুসলিম লিগের ফজলুল কাদের গ্রুপের সভাপতি শামসুল হুদা ও সাধারণ সম্পাদক এ.এচ.এ ইউসু দেশে “স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার, সর্বপ্রকার সন্দেহ প্রবণতা দূরীকরণ, মিথ্যাগুজব, উত্তেজনা সৃষ্টিকর অলীক কাহিনী প্রচারে বিরত করার উদ্দেশ্যে প্রদেশে সকল পার্টির ইউনিটকে শান্তিপ্রিয় জনসাধারণকে লইয়া কমিটি গঠনের জন্য স্ব স্ব অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে প্রচেষ্টা” চালানোর আহ্বান জানান।

একইভাবে কনভেনশন লিগের ডা. নুরুর রহমান ঘোষণা করেন “হিন্দুস্থান পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব ও সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করার জন্য সর্বদা সচেষ্ট রহিয়াছে।” সুতরাং শান্তিকমিটিকে পূর্ণ সহযোগিতা দিতে হবে। ২৮ নেজামী ইসলামীর নেতা চাঁটগার বাঁশখালি থেকে নির্বাচিত এম.পি’ ‘মাওলানা’ আহমদ সগীরও একই ধরনের বক্তব্য প্রদান করেন। “ছয় দফা কর্মসূচিতে যাহা কিছু ছিল, ভারতীয় চর ও অনুপ্রবেশকারীদের দ্বারা সৃষ্ট গোলযোগ ও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে তাহার চাইতে অনেক বেশি

অঘটন ঘটিয়াছে ।

সিলেটে জামায়াতের শামসুল হক শান্তি কমিটির এক সভায় বলেন, “ভারত পাকিস্তানের সহিত সংগ্রাম করিবার স্বাদ পূর্বেই গ্রহণ করিয়াছে। বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করিয়াছে, আমাদের সড়ক, সেতু ধ্বংস করিয়াছে এবং ব্যাংক, খাদ্য ও গুদাম মূলধন করিয়াছে। এই ধরনের শত্রু ও সমাজ বিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে বীরত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছেন এজন্য তিনি তাহাদের শুকরিয়া জ্ঞাপন করেন।

কিশোরগঞ্জে শান্তি কমিটির এক সভায় পিডিপির সহ সভাপতি ‘মওলানা’ সৈয়দ মোসলেহ উদ্দিন বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের এই দুভাগের জন্য বিচ্ছিন্নকারীরাই দায়ী।”

২৯ নভেম্বর ঢাকায় শান্তিকমিটি এক প্রতিবাদ মিছিল করে ভারতীয় ‘আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেখানে তাতে মুসলিম লিগের (কাইয়ুম) খান এ সবুর বক্তৃতা করেন। জমিয়াতুল মোদরেছিনও যুক্ত ছিল শান্তিকমিটির সঙ্গে।৩৩ কাউন্সিলে দক্ষিণপন্থি দল ছাড়াও, অনেকে ছিলেন যারা বাংলাদেশ চাননি তারা যোগ দিয়েছিলেন শান্তিবাহিনীতে।

উত্তর বঙ্গে, যশোরে, ঢাকায় বিহারিরা প্রায় সবাই যুক্ত ছিলেন শান্তিকমিটির সঙ্গে শান্তিকমিটিতে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল জামায়াতে ইসলামী। এর নেতারা শান্তি কমিটির [কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক] বিভিন্ন পদে ছিলেন। গোলাম আযম শান্তিকমিটির সদস্য এবং জামায়াতের প্রাদেশিক আমির হিসেবে প্রায় সময়ই বক্তব্য রেখেছেন। জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম সবসময় শান্তি কমিটির পক্ষে সম্পাদকীয়। উপসম্পাদকীয় ছেপেছে।

সংগ্রাম ১৩মে লিখেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামীদের নিয়ে—“এ নতুন জাতির নাম হল বাংলা’ জাত। তাদের কলেমা সালাম-কালাম হলো বাংলা’, তাদের দেশের ‘বাংলাদেশ’, তাদের ধর্মের নাম বাঙালি ধর্ম। এ প্রতিকের দিয়েছে বঙ্গবন্ধু।”…

সংগ্রাম কর্তৃপক্ষকে আবেদন করে, “দুষ্কৃতিকারী দমনকল্পে নানা ইউনিয়ন ভিত্তিক প্রশাসন যন্ত্রকে পূর্নবহাল সক্রিয় তুলতে সচেষ্ট ততই দেশ জাতির মঙ্গল। … জায়গায় যেসব শান্তিকমিটি গঠিত কর্তৃপক্ষের উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে সেগুলোও ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

মুক্তিযোদ্ধাদের দমনের সংগ্রাম বিভিন্ন বাহিনী গঠনের কথাও বলে। কারণ, গেরিলা তৎপরতার কারণে দু’একজন করে দালাল নিহত হচ্ছিল। জামায়াতী পরিকল্পনার ভিত্তিতেই সম্পাদকীয়টি লেখা হয় শিরোনাম ছিল— ‘বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড’—

“এসব হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছেন, তাঁদের সকলেই পাকিস্তানবাদী জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী বলে যায়। শান্তিকমিটির সাথে জড়িত ব্যক্তিও নিহতদের মধ্যে রয়েছেন প্রকাশ। এছাড়া প্রদেশের বিভিন্ন জেলায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা যাচ্ছেন তাঁদের গোপন মারফত দুষ্কৃতিকারীরা (মুক্তিযোদ্ধারা লেখক) হুমকি চলেছে জানা যায়।

আমাদের সেনাবাহিনী দুষ্কৃতিকারী দমন অভিযান অব্যাহত রেখেছেন সন্দেহ নেই আমাদের বিশ্বাস আল্লাহর অনুগ্রহে যেভাবে দেশকে হিন্দুস্তানী অনুপ্রবেশকারী দুষ্কৃতিকারীদের সুসংগঠিত হামলা থেকে করতে সমর্থ হয়েছেন তেমনিভাবে এসব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অপরাধীদের সত্বরই নির্মূল করতে সক্ষম হবেন।

দেশের অভ্যন্তরে অবস্থানকারী এসব দুষ্কৃতিকারী দমনের ব্যাপারে আমরা ইতিপূর্বেও সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয় এবং একাধিক নিবন্ধে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস পাকিস্তান জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী নির্ভরযোগ্য লোকদের সমন্বয়ে একটি বেসামরিক পোশাকধারী বাহিনী গঠন তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে অতি তাড়াতাড়ি এসব দুষ্কৃতিকারীদেরকে নির্মূল করা হবে।

এ পরিপ্রেক্ষিতেই কিছুদিনের মধ্যে রেজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি বাহিনী গঠিত হয় যার কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। এসব বাহিনিতেই জামায়াতীরাই ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। গোলাম আজম ১৬ জুলাই ঘোষণা করেন, হিন্দুরা মুসলমানের বন্ধু এমন কোন প্রমাণ নেই

“রাজশাহী, ১৬ই জুলাই। সম্প্রতি স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল হলে রাজশাহী শাস্তি কমিটির উদ্যোগে আহুত সুধী সমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সম্পর্কে বলেন যে, যাদের নিজেদের শক্তি নেই, তারা হিন্দুস্তানের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে স্বাধীন হতে চায়।

জামায়াত নেতা প্রশ্ন করেন, হিন্দুস্তানী ফৌজ এদেশ দখল করলে তাদের অধীনতা থেকে স্বাধীনতা লাভ করা কিভাবে সম্ভব হবে?

তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেন যে, হিন্দুরা মুসলমানের বন্ধু–এরূপ প্রমাণ করার মতো কোন দলীল নেই। তারা চিরদিনই মুসলমানের সাথে দুশমনী করে এসেছে এবং দেশ বিভাগের পরও ভারতে মুসলিম হত্যা দৈনন্দিন ঘটনায় পরিণত।

তিনি আরও বলেন যে, মুসলমানে মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করার কৃতিত্ব হিন্দুদের ভাষার প্রশ্ন তুলে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারলে হিন্দু-মুসলমান মিলে এক জাতি সম্ভব নয় বলে অধ্যাপক আযম মন্তব্য করেন। তিনি বাঙালি অবাঙালি মনোভাব ত্যাগের জন্য সকল মুসলমানকে আকূল আহ্বান জানান। উক্ত সুধী সমাবেশে রাজশাহী শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান জনাব আইনুদ্দীন সভাপতিত্ব করেন।

শান্তিকমিটি কেন শক্তিশালী করা দরকার তার কারণ দেখিয়েছিল দৈনিক সংগ্রাম বা জামায়াত নেতারা। পত্রিকার মতে, সেনাবাহিনী শুধু পাকিস্তানকে পারবে

“ভারত ও তার চরদের অঘোষিত যুদ্ধ যতদিন শেষ না হয় ততদিন শান্তি কমিটি দেশ জনতার উভয় স্বার্থেই প্রয়োজন। তাই তাকে বাঁচিয়ে রাখা সুসংগঠিত করার গুরুত্ব অত্যধিক। শান্তিকমিটির শূন্যতা দেশ জনতা দুটোকেই বিপন্ন করতে পারে, তা উপলব্ধি করা না হলে মারাত্মক হবে। ভুলে গেলে চলবে না, পাকিস্তানের নেতা উপনেতা খতম হলে জনতাও হতাশ হয়ে পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারবে না। একারণেই আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে নিখুঁত ও এককেন্দ্রিক শান্তিকমিটি অধীনে প্রয়োজনীয় নির্ভেজাল রেজাকার বাহিনী। দুটো সংগঠন যদি সুষ্ঠুভাবে চালু

যায় তাহলে সেনাবাহিনী যেমন বহিঃশত্রুর মোকাবেলায় পূর্ণ নিয়োগ করতে পারবে তেমনি শান্তি কমিটিও রেজাকার বাহিনী পঞ্চম বাহিনীকে শায়েস্তা করার জন্য যথেষ্ট হবে। … শান্তিকমিটির কর্মকাণ্ড যে মানুষ আতঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ তা জামায়াতী নেতারা

বুঝতে পারছিলেন। বস্তুত তাদের আগ্রাসী মনোভাবে অন্যান্য দক্ষিণপস্থি দলগুলিও ভীত হয়ে উঠছিল। দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত দু’টি সংবাদ প্রতিবেদন এর প্রমাণ।

১. “পূর্ব পাকিস্তান শান্তিকমিটির বয়স আজ সাড়ে চার মাস অতিক্রম করে চলেছে। তবে শান্তিকমিটির অপ্রশংসনীয় কাজ যে আদৌ নেই তাও বলা চলে না। কারণ দেশের মানুষ দিয়েই শান্তিকমিটি গঠিত। আকাশের ফেরেশতাদের দ্বারা নয়। তাই দেশের মানুষও যেমন ভুল ত্রুটি মুক্ত নয়, তেমনি মুক্ত নয় তাদের নিয়ে গড়া শান্তিকমিটি। এ কারণেই কোথাও বা শান্তিকমিটি নাকি অশান্তি কমিটিরই নামান্তর হয়ে দাঁড়িয়েছে ।

২. “যে রেজাকারদের সর্বদলীয় শাস্তিকমিটির সহযোগিতায় সামরিক সরকারই বাছাই করেছেন এবং ট্রেনিং দিয়ে তাদেরই নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগিয়েছেন, তারা কি করে দল বিশেষের পক্ষ হয়ে অন্যান্য দলের কর্মীদের খতম করেছে তা ভাবতেই অবাক লাগে। অপবাদ মূলত কি সামরিক সরকারকেই দেয়া হচ্ছে না?

সামরিকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রেজাকাররা যখন শুধু ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী ও দালালদের খতম করছে তখন তা যদি অন্য কোন দলের কর্মী খতম করা হয়ে থাকে তবে সে দলের কর্মীরা নিঃসন্দেহে ভারতের দালালী করছে

জামায়াত কতোটা আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল তা বোঝা যায় নভেম্বর মাসে গোলাম আযমের উক্তিতে। কারণ, তখন বাঙালি পাকিস্তানিদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল যে সময় ঘনিয়ে এসছে। মরীয়া হয়ে উঠছিল তারা। গোলাম আযম দাবি

করেন “পূর্ব পাকিস্তানে শান্তিরক্ষার উদ্দেশ্যে সকল দেশপ্রেমিক, শান্তিকমিটির সদস্য এবং রেজাকারদের উন্নতমানের ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করার জন্য অধ্যাপক আযম দাবী জানান।

এর কিছুদিন পরই জামায়াতীদের আলবদররা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। আলবদরদের নেতা ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। শান্তিকমিটির সদস্যরা এতই আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল যে সুদূর পাকিস্তান থেকে এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান বলেন “শান্তিকমিটির সদস্যরা আইন শৃঙ্খলা

পুনরুদ্ধারের নামে ব্যক্তিগত শত্রুতা ও রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের মতলবে গ্রামাঞ্চলের লোকদের হয়রানি করছে। এতে নিরীহ মানুষ কষ্টভোগ করছে।”

প্রত্যুত্তরে সংগ্রাম উল্লেখ করে “জনাব আসগর খান তার সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বেচ্ছাসেবামূলক সংস্থা ও শান্তিকমিটির বিরুদ্ধে পাইকারীভাবে মারাত্মক অভিযোগ এনেছেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের নাম তিনি উল্লেখ না করলেও রেজাকার আলবদর বাহিনী ও মোজাহিদ বাহিনীর প্রতি তিনি ঈঙ্গিত করেছেন।

শান্তিকমিটি ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সদস্য যারা বুকের রক্ত দিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহী ও হিন্দুস্তানী ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে জনাব আসগর খানের এই শত্রুসুলভ অভিযোগ আমাদেরকে দুঃখিত করেনি বরং তার শূন্যগর্ভতা আমাদেরকে বিস্মিত করেছে।

শাস্তিকমিটির নেতাকর্মীদের আদর্শের কথা আগে উল্লেখ করেছি। দক্ষিণপন্থি দলগুলি ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে। অখণ্ড পাকিস্তানে যদি তাদের অধস্তন থাকতে হয় তাতেও তাদের আপত্তি ছিল না। ইসলামকে তারা ব্যবহার করেছিল। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল তাদের কাম্য। শাস্তিকমিটির বিভিন্ন সভায় নেতারা এ কথাটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন।

মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন বলেছিলেন “কেন্দ্রীয় শাস্তিকমিটির কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও পাকিস্তান মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি ব্যারিস্টার আখতার উদ্দীন আহমদ বলেছেন, বর্তমান মুহূর্তে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য আমাদেরকে দলীয় মত পার্থক্য ভুলে গিয়ে একতাবদ্ধ হতে হবে। বরিশালে জেলা শান্তিকমিটি আয়োজিত এক বিরাট সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আখতার উদ্দীন উপর্যুক্ত মন্তব্য করেন। বলে এপিপি পরিবেশিত খবরে প্রকাশ।

পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির বিরুদ্ধে ভারত যে চক্রান্ত ও প্রচারণা চালাচ্ছে, সাহস ও আস্থার সাথে তার মোকাবেলা করার জন্য জনাব আখতার উদ্দীন জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। পূর্ব পাকিস্তানে অশুভ কার্যকলাপে লিপ্ত দুষ্কৃতিকারী এবং বিদেশি চরদের উৎখাত করার জন্যও তিনি আহ্বান জানান।

সভায় আরো বক্তৃতা করেন এম এন এ অবসরপ্রাপ্ত মেজর আফসার উদ্দীন, সাবেক মন্ত্রী এমএম আফজাল, সাবেক এম এন এ চৌধুরী রব খান, অ্যাডভোকেট আব্দুর রহমান বিশ্বাস [বিএনপি নেতা ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট] প্রমুখ88

গোলাম আযম যেমন বলেছিলেন,

“অধ্যাপক আযম বর্তমান পরিস্থিতির ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ জোরদার করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে আমরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হব এবং যতদিন আমরা বাঁচবো পঙ্গু জাতি হিসেবে বেঁচে থাকবো ।

অধ্যাপক আযম এই উপমহাদেশের মুসলমানদের অপরিসীম ত্যাগকে বৃথা যেতে না দেয়া এবং পাকিস্তানি মানবতায় উদ্বুদ্ধ একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সারা বিশ্বে এক অনন্য সাধারণ উদাহরণ স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শপথ গ্রহণ করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান বলে গতকাল শুক্রবার প্রাদেশিক জামায়াতের এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ (৪৫ গোলাম আযম আরো বলেছিলেন,

“পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলে জামায়াতকর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোন সার্থকতা মনে করে না। পাকিস্তান সারা বিশ্ব মুসলিমের জন্য ইসলামের ঘর। কাজেই পাকিস্তান যদি না থাকে তাহলে জামায়াতকর্মীরা দুনিয়ায় বেঁচে থাকার কোন স্বার্থকতা খুঁজে পাবে না। জামায়াত প্রধান বলেন, তাই জামায়াতের কর্মীরা জীবন বিপন্ন করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। শান্তিকমিটির মাধ্যমে ও অন্যান্য উপায়ে জনসাধারণের মনে আস্থা ও নিরাপত্তাবোধ সৃষ্টি করার জন্য কাজ করেছে এবং একই উদ্দেশ্যে জামায়াত দলের দু’জন সিনিয়র নেতাকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধ্য করেছে।

মধ্যপন্থি বা বামপন্থাকে তারা পাকিস্তানের সমর্থক কখনও মনে করেনি। আওয়ামী লীগ সমর্থক তথা বাংলাদেশের মানুষদের বিবেচনা করা হয়েছে চক্রান্ত কারি, হিন্দু ভারতের এজেন্ট, পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিরোধী। আদর্শ ছাড়াও এ বিরোধিতার অন্য কারণ ছিল। আওয়ামী ছিল পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল।

এমনিতে বা রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রভাব ক্ষুণ্ন করার সামর্থ্য এদের ছিল না। সুতরাং, শক্তির সাহায্যে তাদের দমিত করার ইচ্ছা পোষণ করেছে। আওয়ামী লীগ দমিত হলে তাদের শূন্যস্থান তারা গ্রহণ করবে এমন বাসনা ছিল কারণ, নিছক পাকিস্তান আদর্শ রূপায়িত করার জন্য এত খুন, লুট, জখম দরকার ছিল না। আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্ব সম্পর্কে দৈনিক সংগ্রাম লিখেছিল

“সবকিছু ভুল নেতৃত্বের কুফল। ভ্রান্ত নেতৃত্বের যে বিপুল খেসারত অঞ্চলবাসীকে দিতে হল, তার ক্ষতিপূরণ কতদিনে সম্ভব তা কে বলতে পারে, তথাপি আমাদের শেষরক্ষা খোদা যে করলেন, সেজন্য আমরা খোদার কাছে কৃতজ্ঞ। এ ব্যাপারে আমাদের সেনাবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম ত্যাগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। তাদের সময়োচিত হস্তক্ষেপ ছাড়া কিছুতেই আমরা ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদের খপ্পর থেকে মুক্তি পেতাম না।

ক্ষমতার লালসা যে মানুষকে দেশ বিক্রেতাও করতে পারে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী নেতৃত্বই পয়লা সে কলঙ্কজনক নজীর কায়েম করল।

বলা বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত আমাদের সেনাবাহিনী ও জনতার সচেতন পদক্ষেপ যদিও দেশ দেশের জনতাকে ভারতীয় ধ্বংসস্পৃহার হাত থেকে বাঁচিয়েছে, তথাপি আওয়ামী ভ্রান্ত নেতা ফ্যাসিবাদী কর্মীদের একতরফা প্ররোচনা, প্রচারণা জবরদস্তির শিকার হয়ে কিছু লোক ভারতে চলে গেছে আরেকটি বিষয় ছিল সম্পদ হস্তগত করা।

১৯৪৭ সালে, ব্যাপক হারে হিন্দুদের দেশত্যাগ এখানকার মুসলমানদের বিনামূল্যে/স্বল্পমূল্যে সম্পদ আহরণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে স্ফিত করতে সাহায্য করেছিল। ১৯৭১ সেই সুযোগ এনে দিয়েছিল পাকিস্তানপন্থীদের। তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কীভাবে শুধু হিন্দু নয়, অন্যান্যদের সম্পদ দখল করা হচ্ছে।

শান্তিকমিটি যারা করেছিলেন, উচ্চ পর্যায়ের এবং নিম্ন পর্যায়ের, এই প্রথম তারা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিলেন। এ ক্ষমতা এমন যে, যা ইচ্ছে তা করা যায়। খুন ছিল মামুলি ব্যাপার। এই ক্ষমতার স্বাদ তাদের হিংস্র করে তুলেছিল এবং এই ক্ষমতার লোভ, সম্পদের লোভ তাদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

একটি বিষয় উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়। এরকম অনেকে ছিলেন যারা বাধ্য হয়ে যোগ দিয়েছেন শান্তি বাহিনীতে কিন্তু নিষ্ক্রিয় থেকেছেন, ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারাও কোনো ব্যক্তিকে যুক্ত থাকতে বলেছেন খবর সংগ্রহের জন্য। তবে সে সংখ্যা খুব সামান্য।

 

আরও দেখুন…

Leave a Comment