Site icon History Gurukul [ ইতিহাস গুরুকুল ], GOLN

৮ মার্চ ১৯৭১ – বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বেতারে | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস

৮ মার্চ ১৯৭১ – বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বেতারে | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস

৮ মার্চ ১৯৭১ | বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বেতারে | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস : স্বাধীনতাযুদ্ধে বিজয়ের পেছনে ছিল দেশ-বিদেশের বহু মানুষের একক ও মিলিত চেষ্টা এবং অজস্র ঘটনা। এখানে রইল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্তেকটি দিনের বিবরণ।

 

৮ মার্চ ১৯৭১
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার বেতারে

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

 

৮ মার্চের সকাল শুরু হয় ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে আগের দিন রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সম্প্রচার দিয়ে। বেতারে সেটি সম্প্রচার করা হয় সকাল সাড়ে আটটায়। অন্যান্য বেতারকেন্দ্র থেকেও সেটি পুনঃপ্রচার করা হয়। ভাষণটি রেসকোর্স ময়দান থেকে সরাসরি প্রচার না করার প্রতিবাদে আগের দিন বিকেল থেকে ঢাকা বেতারকেন্দ্রের বাঙালি কর্মীরা ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। এটি প্রচারের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে বেতারকর্মীরা সকালে কাজে যোগ দেন।

কিন্তু ভাষণের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই দিন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে শুধু ‘ছাত্রলীগ’ করা হয়। ছাত্রলীগের এ সভায় জেলা থেকে প্রাথমিক শাখা পর্যন্ত ‘স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন ও প্রদর্শন, জাতীয় সংগীত বাজানো এবং সিনেমা হলে উর্দু ছায়াছবির প্রদর্শনী বন্ধ করে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। সারা দেশে ছাত্র, যুব ও পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য তৎপরতা দেখা যায়।

ছাত্রলীগ এক বিবৃতিতে সশস্ত্র বাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশের স্বাধিকার সংগ্রামের নিরস্ত্র বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সব সরকারি-বেসরকারি ভবনে অনির্দিষ্টকালের জন্য কালো পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানায়। পাড়ায় পাড়ায়, বাসভবনে, ছাত্রাবাসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শীর্ষে কালো পতাকা ওঠানো হয়। সরকারি ও বেসরকারি যানবাহন এবং মোটরগাড়ি কালো পতাকা লাগিয়ে চলাচল করে। সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী সমিতি ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক অফিসের কাজ বর্জনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে।

 

 

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক–কর্মচারী এবং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা–কর্মচারীরা মুক্তি আন্দোলনে নিহতদের শোকার্ত পরিবারের সাহায্যের জন্য এক দিনের বেতন সাহায্য তহবিলে দান করেন।

 

পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া:

২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া শর্ত সম্পর্কে ইসলামাবাদে সাংবাদিকেরা পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোর মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের ঘোষণাকে জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মওদুদী ও সাবেক আইনমন্ত্রী এস এম জাফর স্বাগত জানান।

এর উল্টো চিত্রও ছিল। ঢাকায় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে করাচির বিভিন্ন মসজিদে গায়েবানা জানাজা ও ফাতেহা পাঠ করা হয়। লাহোরে এক সভায় সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতা–কর্মী এবং ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।

বাওয়ালপুর ইউনাইটেড ফ্রন্টের নেতা ও জাতীয় পরিষদের সদস্য মিয়া নাজিমুদ্দিন জাতীয় পরিষদে যোগদানের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর চার দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে অবিলম্বে তা মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

 

আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

 

ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান:

৭ মার্চে ঘোষিত বঙ্গবন্ধুর শর্ত মেনে নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ন্যাপের (ওয়ালি) প্রাদেশিক (পূর্ব পাকিস্তান) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ এবং জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান।

 

 

পিডিপি সভাপতি নুরুল আমিন সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শক্রমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সুষ্ঠু পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান। মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর খান বলেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত ঘোষণার পর যা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতে যা ঘটবার সম্ভাবনা রয়েছে, এসবের জন্য পশ্চিমাঞ্চলের নেতারাই দায়ী।

 

তাজউদ্দীনের আরও বিবৃতি:

তাজউদ্দীন আহমদ আরও দুটো বিবৃতি দেন। একটি বিবৃতিতে তিনি আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য জনগণকে অভিনন্দন জানান। আরেকটি বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা করা নির্দেশের ব্যাখ্যা দেন। তাতে বলা হয়, সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা থাকবে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ভেতরে নগদ জমা, বেতন ও মজুরি প্রদান, এক হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে এবং আন্তব্যাংক ক্লিয়ারেন্স ও নগদ লেনদেন করতে পারবে। স্টেট ব্যাংক বা অন্য কোনো মাধ্যমে বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না।

 

 

পানি, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। সার সরবরাহ ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহ চলবে। ইটখোলার জন্য কয়লা এবং পাট ও ধানবীজ সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন থাকবে। ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার সাহায্যে ও পুনর্বাসন কাজ চলবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম ও মানি অর্ডারের জন্য ডাক ও তার বিভাগ খোলা থাকবে। স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সার্ভিস অব্যাহত থাকবে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রয়োজনে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতা নেবে। এ ছাড়া অপর সব আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে হরতাল অব্যাহত থাকবে।

 

তথ্য বিজ্ঞপ্তি নিয়ে পাল্টাপাল্টি:

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ সংবাদপত্রে তথ্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলে, শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ২ মার্চ সকাল থেকে পূর্ণ হরতাল পালন শুরু হয়। বিক্ষোভরত জনতা লুট, অগ্নিসংযোগ, ছুরিকাঘাত ইত্যাদিতে লিপ্ত হয়েছিল। গোলযোগের সময় ১৭২ জন নিহত এবং ৩৫৮ জন আহত হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ রাতেই সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি পাঠিয়ে এই তথ্য বিজ্ঞপ্তির নিন্দা করেন। তিনি বলেন, প্রেসনোটে লুট ও আগুন লাগানোর যে অভিযোগ করা হয়েছে, প্রকৃত ঘটনা তার বিপরীত। স্বাধিকারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে চলা বিক্ষোভ মিছিলের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। হতাহতের সংখ্যা যা দেখানো হয়েছে, সেটি অত্যন্ত নগণ্য। নিরস্ত্র মানুষের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অপরিমেয় ক্ষোভের সঞ্চার ঘটেছে।

বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমরা আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে গত ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্সে শেখ মুজিবুর রহমান যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, সকল শ্রেণির মানুষ তা সক্রিয়ভাবে কার্যকরী করেছেন।’

 

আরও দেখুন…

Exit mobile version