আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত
জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত :
পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটার পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী সিমলায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর অবস্থানকালে সবকিছু তদারকির জন্য জনাব মোহাম্মদ ইউনুসকে দায়িত্ব দেন। তিনি লিখেছেন :
“দ্বিতীয় দিন তিনি (জুলফিকার আলী ভুট্টো) ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন, আমি যুদ্ধ বন্দিদের মুক্ত করার জন্য এখানে আসি নি। এই যুদ্ধবন্দিরা এমন এক ভূখণ্ডে জন্য নিয়েছে সেখানকার লোকজন শত শত বছর ধরে ব্রিটিশের কামানের খোরাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য দুই এক লাখ লোকের মৃত্যুতে কি আসে যায়
তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে না গেলে তিনি কেন সিমলা গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে গিয়ে কী অর্জন করবেন? তথাকথিত সিমলা চুক্তির আওতায় কাশ্মীরের যুদ্ধবিরতি রেখাকে নিয়ন্ত্রণ রেখায় পরিবর্তন করা হয়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতীয়রা আজান কাশ্মীরে যেসব চৌকি দখল করেছিল সেগুলো থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করা হয় নি।
এ চুক্তিতে কাশ্মীরে ও কাশ্মীরী জনগণের ভাগ্যে সীলমোহর মেরে দেওয়া হয়। দুটি দেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে নয়, দুই জন ব্যক্তির মধ্যে এ সমঝোতা হয়। দুই জন প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আগে দুটি দেশের প্রতিনিধি দলের মধ্যে যে আলোচনা হয় তা ছিল একটি আইওয়াশ।
সিমলা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর চাটুকাররা দাবি করেন যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো তাদের মধ্যকার একান্ত বৈঠকে মিসেস গান্ধীকে বশীভূত করেছেন। কিন্তু ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে, মিসেস ইন্দিরা গান্ধীই জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বশীভূত করেছেন।
জুলফিকার আলী ভুট্টো খালি হাতে সিমলা থেকে ফিরে আসেন। তিনি যুদ্ধবন্দি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের হৃত সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড ও আজাদ কাশ্মীরের চৌকিগুলো মুক্ত করা ছাড়াই দেশে ফেরেন।
শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলী ভুট্টো উভয়েই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে আগ্রহী ছিলেন । বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অর্থ হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের কফিনের শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া। ইন্দিরা গান্ধী ও জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের এক দেশে পরিণত হওয়ার যে-কোনো সম্ভাবনাকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন।
পাকিস্তান যতক্ষণ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতো ততোক্ষণ বাংলাদেশের যে কোনো ভবিষ্যৎ সরকার অথবা জনগণ পুনরেকত্রীকরণের চেষ্টা করতে পারতো। জুলফিকার আলী ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন।

বাংলাদেশের জাতিসংঘে প্রবেশের বিরুদ্ধে চীন নিরাপত্তা পরিষদে তার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের হুমকি দেয়। পাকিস্তানের জনগণ ছিল স্বীকৃতি দানের বিপক্ষে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ইসলামি শীর্ষ বৈঠকের আয়োজন করেন। বাংলাদেশকে দাওয়াত দেওয়া হয়।
মুজিব বেঁকে বসলেন। তিনি বললেন যে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে তিনি লাহোরে ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করবেন না। মুসলিম দেশগুলোর চাপের মুখে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। মুজিব সদর্পে ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
জুলফিকার আলী ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনতে চান নি। তিনি যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনতে চাইলে আমরা অনেক আগেই ফিরে আসতে পারতাম। জুলফিকার আলী ভুট্টোর হাতে ৪টি তুরুপের তাস ছিল। একটি হচ্ছে, মুজিব।
মুজিবের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দিদের ফিরিয়ে আনা যেতো। কিন্তু তাকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেওয়া হয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ২ লাখ বাঙালি। এসব বাঙালির মধ্যে জেনারেল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নারী ও শিশু ছিল। যুদ্ধবন্দিদের বিনিময় করা যেতো এদের সাথে। কিন্তু তাদেরকেও নিঃশর্তভাবে যেতে দেওয়া হয়।
তৃতীয় তুরুপের তাস ছিল ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং চতুর্থটি হচ্ছে ফিরোজপুর হেডওয়ার্ক। এ হেডওয়ার্কের কাছাকাছি পৌঁছে গোটা ফিরোজপুর ও আশপাশের এলাকা করে দেওয়া যেতো প্লাবিত, ভারতীয় যুদ্ধবন্দি ও ফিরোজপুরের সাথে যুদ্ধবন্দিদের বিনিময় করা যেতো। কিন্তু জুলফিকার-আলী ভুট্টো ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিঃশর্তভাবে মুক্তি দেন।
সিমলায় জুলফিকার-আলী ভুট্টো মিসেস গান্ধীর সাথে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ভারতে দীর্ঘদিন আটক রাখার বন্দোবস্ত করেন। আমাদেরকে মুক্তি দেওয়া না হলে চীন জাতি সংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগের হুমকি দেয়। চীনের এ হুমকির পর ভারত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় আমাদেরকে। জুলফিকার-আলী ভুট্টো আমাদেরকে ফিরিয়ে আনেন নি। চীনের প্রশংসনীয় ভূমিকায় আমরা দেশে ফিরতে পেরেছিলাম।
“এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, জুলফিকার-আলী ভুট্টো যুদ্ধবন্দিদের ফেরত দেওয়ার প্রশ্নে ভারতের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করা ছাড়াই পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি মুজিবকে মুক্তি দেন। নতুন রাষ্ট্র গঠনে মুজিবের ঢাকা উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য এবং ভারতীয়দের কাছে তার প্রয়োজন ছিল এতো বেশি যে, জুলফিকার-আলী ভুট্টো মুজিবকে মুক্তি দানের বিনিময়ে পাকিস্তানি সৈনাদের প্রত্যাবসান দাবী করলে তিনি তাদের মুক্তি নিশ্চিত করতে পারতেন।
সে ক্ষেত্রে ৯৫ হাজার যুদ্ধবন্দিকে দীর্ঘদিন অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। কার্যত জুলফিকার-আলী ভুট্টো মুজিবকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দানে আগ্রহী ছিলেন যাতে মুজিব নিজের ঘর (বাংলাদেশ) গোছাতে পারেন। এ ছাড়া তার আগ্রহ ছিল বাংলাদেশকে স্বীকার করা। তিনি তাই করেছিলেন। ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে তিনি মুজিবকে মুক্তি দিয়ে লন্ডন পাঠিয়ে দিলেন।
আরও দেখুন: