সিআইএ’র রাজনৈতিক চাপ : ছয় দফা প্রণয়ন এবং লাহোরে অনুষ্ঠিত ডানপন্থী পাঁচ পার্টির জাতীয় সম্মেলনে এর উপস্থাপনা নিয়ে একটি রহস্য দানা বেঁধে ওঠে। রহস্য সৃষ্টি করেন এর উপস্থাপক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান। কারণ, উপস্থাপনার আগ পর্যন্ত সম্মেলনে যোগদানকারী প্রাদেশিক কমিটির প্রতিনিধিদলের কেউই জানতেন না যে শেখ মুজিবর রহমান এ ধরনের একটি প্রস্তাব সম্মেলনে তুলবেন।

আইউব বিরোধী একটি একক ডানপন্থী বিরোধীদলীয় মোর্চা গঠনের লক্ষ্যে লাহোরে ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি এক জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে নূরুল আমিনের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির পক্ষ থেকে যে প্রতিনিধি দল সম্মেলনে যোগদান করে, তার নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবর রহমান।
[ সিআইএ’র রাজনৈতিক চাপ – মাসুদুল হক ]
ওই প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ছিলেন জহির উদ্দিন, নুরুল ইসলাম চৌধুরী, হাফেজ হাবিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল মালেক উকিল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, ইউসুফ আলী, এএইচএম কামরুজ্জামান ও এবিএম নুরুল ইসলাম। এই সম্মেলনেই শেখ মুজিব সর্বপ্রথম ছয় দফা উত্থাপন করেন। অথচ সম্মেলন কক্ষে প্রবেশের আগ মুহূর্তেও এ সম্পর্কে তার মুখে একটি বাক্যও উচ্চারিত হয় নি। এমন কি তার প্রতিনিধি দলের সদস্যদেরকেও ছিটেফোঁটাও জানান নি।

আমাকে দেয়া এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে তৎকালীন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন
“লাহোর যাত্রার প্রাক্কালে ঢাকাতে এমনকি লাহোরে গিয়েও এ সম্পর্কে তিনি আমাদের সঙ্গে কোন আলাপ-আলোচনা করেন নি। আমরা জানতামই না শেখ মুজিব এ ধরনের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন।“
ফলে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক কমিটির প্রতিনিধিরাই শুধু বিস্মিত হন নি, অবাক করে দেয় সম্মেলনে উপস্থিত ডানপন্থী পাঁচ দলীয় নেতৃবৃন্দকেও।
সম্মেলনে যোগদানের জন্য লাহোরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে শেখ মুজিব ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে এক বিবৃতিতে বলেন
“একমাত্র ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও দেশরক্ষার দিক হইতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বয়ংসম্পূর্ণতা বিধানের দ্বারাই দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা যাইতে পারে। করাচি পৌঁছে তিনি আরেকটি বিবৃতি দেন।
সেটা একই তারিখের দৈনিক আজাদ এ প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে বলা হয়। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে তিনি (শেখ মুজিব) পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানান। অথচ সম্মেলন কক্ষে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের কথা না তুলে ছয় দফা প্রস্তাব তোলেন।“
লাহোরের পাঁচ দলীয় জাতীয় সম্মেলন তার ছয় দফা প্রস্তাবকে এক প্রকার উপেক্ষা করে এবং এ নিয়ে শেখ মুজিবকে আলোচনার কোন সুযোগই দেয়া হয় না। তাই সম্মেলন শেষে সারা পাকিস্তানের বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণের সামনে ছয় দফাকে তুলে ধরার জন্য তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি তার প্রস্তাবের দফাওয়ারি ব্যাখ্যা দেন লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন:
“সম্মেলনের একটি বিশেষ কোটারি যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থের অনুকূলে ছয় দফাভিত্তিক একটি প্রোগ্রাম বিবেচনা তো নয়ই, এমন কি আলোচনা করিতে পর্যন্ত অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিয়াছে।“
তিনি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন:
“পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটি কর্মসূচির সাথে একমত না হইতে পারিয়া সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে“।
লাহোরে অনুষ্ঠিত পাঁচ দলীয় জাতীয় সম্মেলনে গুরুত্ব না পাওয়ায় শেখ মুজিব ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক কমিটির ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে ছয় দফা অনুমোদন করিয়ে নেন।
পরের মাসে ১৯ মার্চ থেকে অনুষ্ঠিত ৩ দিনব্যাপী প্রাদেশিক কমিটির কাউন্সিল অধিবেশনেও ছয় দফা অনুমোদিত হয়ে যায়। প্রাদেশিক কমিটির সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ অসুস্থ থাকায় কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন প্রাদেশিক কমিটির সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা অনুমোদিত হয়ে যাবার পর থেকেই নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ দু’টুকরো হয়ে যায়। দু’ দুটো কমিটিতে অনুমোদিত হয়ে যাবার পরও একটি বিষয় সবার অজ্ঞাত থেকে যায়। তাহলো, এর প্রণেতা কে বা কারা? শেষ মুজিব দুটো অধিবেশনের কোনটাতেই এ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আভাস দেন না। তার এই নীরবতা ছয় দফার প্রণয়ন নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।
![সিআইএ’র রাজনৈতিক চাপ - মাসুদুল হক 5 শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে লাহোরে বাঙালির স্বাধীনতার সনদ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন (ফেব্রুয়ারি ৫, ১৯৬৬) [ Sheikh Mujibur Rahman on behalf of the people of East Pakistan announced the 6-point programme, the charter of freedom of Bengalis in Lahore (February 5, 1966) ]](https://historygoln.com/wp-content/uploads/2022/04/Sheikh-Mujibur-Rahman-on-behalf-of-the-people-of-East-Pakistan-announced-the-6-point-programme-the-charter-of-freedom-of-Bengalis-in-Lahore-February-5-1966.jpg)
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ঢাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (পিকিংপন্থী) অভ্যন্তরে বামপন্থীরা এই প্রস্তাবকে সিআইএ-র একটি চক্রান্ত বলে অভিহিত করে ছয় দফার বিরোধিতায় নামে। কিন্তু এই বক্তব্যের পেছনে তারা কোন যুক্তিও প্রদর্শন করে না। অবশ্য পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এটাকে আইউব উৎখাতে সিআইএ-র রাজনৈতিক চাপ শুরুর প্রক্রিয়া বলে মন করে হল্যান্ডে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত কুদরত উল্লাহ শেহাবের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের আলোকে। তাদের ধারণা দৃঢ় হয় ঢাকায় তৎকালীন মার্কিন কনসাল জেনারেল ব্রাউন ও কনস্যুলেটের আরেক কর্মকর্তা কর্নেল চিশহোমের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে।
পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পায় যে ব্রাউন কনসাল জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সিআইএ-র স্টেশন চিফেরও দায়িত্ব পালন করেছেন এবং তার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের একাংশেরও কিছু রাজনৈতিক নেতার যোগাযোগ রয়েছে। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এও জানতে পায়, কর্নেল চিশহোমের বাসভবনে মাঝে মাঝে পার্টি দেয়া হয়। এইসব পার্টিতে বাছাই করা কিছু রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রনেতা এবং পদস্থ সরকারি বাঙালি কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন। গোয়েন্দা সংস্থা অনুমান করে যে, ছয় দফার ধারণা কর্নেল চিশহোমের পার্টি থেকেই এসেছে। পরে কর্নেল চিশহোমকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি ঘোষণা করে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়।

তৎকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার এক পদস্থ কর্মকর্তা এবিএস সফদার আমাকে জানান :
“শেখ মুজিব তাকে ওই সময় বলেছিলেন যে তেজগাঁও বিমান বন্দরে লাহোরগামী বিমানে ওঠার আগে ছয় দফা প্রস্তাবের একটি টাইপ করা কপি রুহুল কুদ্দস তার হাতে তুলে দেন। তিনি ছিলেন শেখ মুজিবের একটি ইনার সার্কেল।“
তার ভাষ্যের সত্যতা প্রতিপাদিত হয় প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবং লাহোরে অনুষ্ঠিত ডানপন্থী পাঁচ দলীয় সম্মেলনে যোগদানকারী প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য আবদুল মালেক উকিলের কথায়। সাপ্তাহিক মেঘনা-র ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮৫ সালের সংখ্যায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আবদুল মালেক উকিল বলেন:
“ছয় দফা তিনি প্রথম দেখেন একটা টাইপ করা কাগজে শেখ সাহেবের পকেটে ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় কনভেনশনে যাবার পথে।”
ছয় দফা নির্মাণ এবং এর নির্মাতা সম্পর্কে সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন:
“লাহোর সম্মেলনে পেশ করার আগ মুহূর্তেও ছয় দফা সম্পর্কে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির কেউই এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন নিয়ে তাঁকে আমরা প্রশ্ন করিনি– কেন তিনি আমাদেরকে জ্ঞাত না করে এই প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। কেননা, প্রাদেশিক কমিটির দেয়া ক্ষমতাবলে যে কোন প্রস্তাব তৈরির অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার শেখ মুজিবের ছিল। তাই কোন প্রশ্ন না তুলেই ওয়ার্কিং কমিটি সম্মেলনে পেশকৃত ছয় দফাকে অনুমোদন দিয়ে দেয়।“
মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন:
“প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বাইরে শেখ মুজিবের একটি ইনার সার্কেল ছিল। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তিনি ওই ইনার সার্কেলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতেন বলে আমরা ধারণা করতাম। রুহুল কুদ্দুস ও আহমেদ ফজলুর রহমান (দুজনেই সিএসপি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত আসামী) ছিলেন তার ওই ‘ইনার সার্কেল’-এর লোক। আমার ধারণা, এই দুজনেই ছয় দফা তৈরি করেন ।“
যেহেতু ছয় দফার প্রণয়ন সম্পর্কে শেখ মুজিব নীরব ছিলেন, সে কারণে এর প্রণেতা সম্পর্কে তৎকালীন পাকিস্তানে একটি বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। যে যার নিজের মতো একেক জনকে প্রণেতা বলে বয়ান দিতে থাকেন। আইউবের বিশ্বস্ত অনুচর এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের নাম উল্লেখ করেছেন জি ডবলিউ চৌধুরী তার দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান গ্রন্থে। তিনি বলেছেন
“এই রকম গুজব রটান হয়ে যে, এর প্রণেতা আলতাফ গওহর — যিনি আইউবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং প্রশাসনে তার ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তি। কোন কোন বিশেষ মহল থেকে এই রকম ইঙ্গিত দেয়া হয়, আইউব নিজেই আলতাফ গওহরকে এ কর্মটি সম্পাদন করতে বলেন, যখন তাসখন্দ চুক্তি নিয়ে সারা পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে সৃষ্টি হয় প্রবল অসন্তোষ ৷ আইউব চাইছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের দৃষ্টি পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দিতে।“
দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ১৯৬৬ সালের ৪ মার্চে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত ‘বাস্তবতার আলোকে ৬-দফা নিবন্ধে শেখ মুজিবকে ছয় দফার প্রণেতা বলেছেন।
![সিআইএ’র রাজনৈতিক চাপ - মাসুদুল হক 7 বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচি [ 6 points programme of bangabandhu ]](https://historygoln.com/wp-content/uploads/2022/04/6-points-৬-দফা-3-001-300x230.jpg)
জি ডবলিউ চৌধুরী আইউবের তথ্য সচিব আলতাফ গওহরের নাম উল্লেখ করে যে যুক্তি খাড়া করেছেন, সেটাকে মেনে নেয়া যায় না। তিনি যে মহল থেকে আলতাফ গওহরের নাম পেয়েছিলেন, তারা সম্ভবত এই ধারণা থেকে বলেছেন যে ছয় দফা ঘোষণার পর পর আলতাফ গওহর তার প্রভৃ আইউব খানকে তাসখন্দ চুক্তি উদ্ভূত বিপর্যয় থেকে বাঁচাবার জন্য যে কৌশলে এটাকে ব্যবহার করেন তা থেকেই।
আলতাফ গওহর তৎকালীন পাকিস্তানের সকল পত্রিকা সম্পাদককে ছয় দফার ব্যাপক প্রচারের গোপন নির্দেশ দেন। তাতে তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদনে আইউব খানের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে যে অসন্তোষ দানা বাঁধে, তা থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদের মতো একটি আতঙ্কজনক বিষয়ের প্রতি তাদের দৃষ্টি অতি সহজেই টেনে আনা যাবে । আইউব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবেন। আলতাফ গওহরের এ কূটকৌশল শেখ মুজিব এবং তার ঘনিষ্ঠজনকে হতবাক করে দেয়। অন্যদিকে প্রাপ্ত তথ্য তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার বক্তব্যকেও সমর্থন করে না।

ছয় দফা নির্মাণ সম্পর্কে শেখ মুজিব সর্বপ্রথম মুখ খোলেন। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যাবার পথে বিমানে বসে। তিনি সাংবাদিক আবদুল গফফার চৌধুরীকে বলেন :
“ছ’দফার কথা বলি। একজন তাজউদ্দিন এবং অন্যজন রুহুল কুদ্দুস। অত্যন্ত গোপনে আমরা এ কাজ সেরেছি। প্রথমে ছিল এগার দফা। পরে সেটাকে কাটছাঁট করা হয়। হানিফকে তোমরা চেন। এখন আমার সঙ্গে আছে। আমার প্রতি ওদের আনুগত্য ও ভালোবাসার কথা আমি ভুলতে পারি না। এই হানিফকে দিয়েই প্রথমে ছ’দফার খসড়া টাইপ করানো হয়েছিল“।
ছয় দফার প্রণয়ন নিয়ে রুহুল কুদ্দস আমাকে দেয়া এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেন :
“ছয় দফার শতকরা একশত ভাগ আমারই তৈরি। প্রথমে ছিল সাত দফা। খসড়া তৈরির পর আমি সেটা দেখাই তাজউদ্দীন আহমদকে। এরপর শেখ মুজিবসহ আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার পর একটি দফা বাদ দেয়া হয়। ওই দফাটিতে ছিল, প্রাদেশিক গভর্নরের নিযুক্তি হবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের ভোটে । কপিটি আমি টাইপ করাই তৎকালীন ইউনাইটেড ব্যাংক অব পাকিস্তানের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আমার বন্ধু খায়রুল কবিরের অফিস থেকে। আমি তখন কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ফাইন্যান্স ডাইরেক্টর।”
খায়রুল কবির আমাকে দেয়া এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেন
“রুহুল কুদ্দুসই হয় তৈ করেন। আমাকে খসড়াটি তিনি দেখান এবং টাইপ করিয়ে দিতে বলেন। টাইপ করতে দেয়ার সময় তাৎক্ষণিকভাবে প্রাদেশিক গভর্নরের নিযুক্তির প্রস্তাবটি আমার মাথায় এসে যায় এবং সেটা ঢুকিয়ে দেই। ছয় দফার ওই খসড়া কপিটি টাইপ করেন আমার ব্যক্তিগত সহকারী আজিম। তিনি অবাঙালি। আমার প্রতি তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। বিষয়টি তিনি গোপন রাখেন। টাইপ করতে দেয়ার আগে মোতাহার হোসেন সিদ্দিকী আমার অফিসে আসেন। কেবল গভর্নর নিযুক্তির প্রস্তাবটি নিয়ে তার সাথে। আলোচনা করি।”
মোতাহার হোসেন সিদ্দিকী” আমাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন যে খায়রুল কবির তার সঙ্গে ওই প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
অতএব, এটা স্পষ্ট যে ছয় দফা তৈরি করেন রুহুল কুদ্দস। পরে শেখ মুজিবের ইনার সার্কেলে এটা আলোচিত হয়ে চূড়ান্ত হয়। অন্যদিকে শেখ মুজিব হানিফকে দিয়ে টাইপ করানোর কথা বলেছেন। তিনি হয়তো তাকে দিয়ে আরেকটি টাইপ করিয়ে নিয়ে থাকতে পারেন।
লাহোর সম্মেলন থেকে ফিরে শেখ মুজিব ওই বছরই ১৯৬৬ সালের ৭ জুনকে ছয় দফা দিবস ঘোষণা করেন এবং ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে সারা পূর্ব বাংলায় হরতাল পালনের আহবান জানান। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে সামরিক চাপ প্রয়াগরে মাধ্যমে আইউব উৎখাতে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন প্রশাসন ছয় দফার মাধ্যমে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের লক্ষ্যে মাঠে নামে। আদতে ছয় দফা ছিল এমন একটি ফর্মুলা যাতে পূর্ব পকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য অবসান ও স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয় চমকপ্রদভাবে। পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা এতে বলা হয় না।
“১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় ছয় দফা ছিল একটি আপোসকামী ফর্মুলা। এখন অনেকে অনেক কথা বলেন কিন্তু ‘৭০ এর নির্বাচনে আমরা আলাদা রাষ্ট্র চাইনি। কিন্তু পাকিস্তানিরা আপোসকামী ফর্মুলায় না গিয়ে গণহত্যা শুরু করে, যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।”১০
এবং মার্কিন প্রশাসনও চায়নি পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হয়ে উঠুক। তারা মূলত যা চেয়েছিল তা হল, পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য অবসান ও স্বায়ত্তশাসনের মতো একটি গণ-আকাঙ্ক্ষিত ইস্যুকে আইউব উৎখাতের পরিকল্পনায় ব্যবহার করতে। কিন্তু ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এই আপোসমূলক ফর্মুলাকে নিজ লক্ষ্যে ব্যবহারের পরিকল্পনা নেয়। পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে।
আলাদা রাষ্ট্র করার লক্ষ্যে সে তার গোপন সংগঠন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের মাধ্যমে ছাত্র সমাজ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুতগতিতে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করে এবং সাধারণ ছাত্র জনতার নিখাদ দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, সততা ও সংগ্রামী চেতনাকে পর্দার অন্তরালে থেকে সুকৌশলে হাতিয়ার করে লক্ষ সিদ্ধিতে অগ্রসর হয় ।
আরও পড়ুন:
- আওয়ামী লীগের ইতিহাস
- মুক্তিযুদ্ধে শিবপুর | হায়দার আনোয়ার খান জুনো
- বাংলাদেশ-পাকিস্তান রাজনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭১-১৯৭৫ : প্রাক-স্বীকৃতি পর্ব
- সিআইএ’র সামরিক চাপ – মাসুদুল হক
- ঢাকা বিভাগের রাজাকারের তালিকা
- স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়
১. পরবর্তীতে মুজিব সরকারের মন্ত্রী এবং এরশাদ শাসনামলে প্রধানমন্ত্রী।
২. দৈনিক আজাদ, ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬।
৩. দৈনিক আজাদ, ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬।
8. দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান, পৃষ্ঠা-১৩৪
৫. নির্বাচিত ভাষণ ও নিবন্ধ: তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, পৃষ্ঠা-৫৭
৬. দৈনিক জনপদ, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩
৭. প্রক্তন সিএসপি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত আসামী, প্রবাসী বাংলঅদেশ সরকার এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারের মুখ্য সচিব।
৮. খায়রুল কবির প্রথম জীবনে ছিলেন সাংবাদিক। কলকাতায় ১৯৪৪ সালে দৈনিক আজাদ দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। উপমহাদেশ বিভক্তির পর ঢাকায় দৈনিক আজাদ-এর বার্তা সম্পাদক হয়ে আসেন। এরপর করাচি চলে যা। এসোসিয়েট প্রেস অব পাকিস্তানের সাংবাদিক হয়ে। কছুিকাল। পর চাকনি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং দৈনিক সংবাদ-এর বার্তা সম্পাদক হন। তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
১৯৫৪ সালে সরকারি চাকরি নেন। চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পাকিস্তান সেন্সর বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান তিনি। পরে প্রাদেশিক তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব। ১৯৬৩ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৬৪ সালে যোগদান করেন ইউনাইটেড ব্যাংক অব পাকিস্তানে। স্বাধীনতার পর জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন।
৯. মোতাহার হোসেন সিদ্দিকী পরবর্তীতে ইংরেজি দৈনিক নিউনেশন-এর সম্পাদক।
১০. মিজানুর রহমান চৌধুরী : দৈনিক দিনকাল, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৫। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর স্মারক ডাকটিকিট উদ্বোধনকালে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণ।
আরও দেখুন…