আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ যুদ্ধে প্রতারণা। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।
যুদ্ধে প্রতারণা
যুদ্ধে প্রতারণা
এ বিষয়টি না বললেই নয়, প্রতারণা হচ্ছে এমন এক জিনিস যা শত্রু প্রত্যাশা করে না এবং যার জন্য সে প্রস্তুত নয়। এটা শত্রুকে চমকে দেবে এবং নৈতিকভাবে তাকে দুর্বল করে তুলবে। প্রতারণা থেকে সৃষ্টি হয় চমকের।
চমক হচ্ছে এমন এক লবণ যা যুদ্ধের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। এটা হচ্ছে যুদ্ধের নীতি। একজন কমান্ডার সর্বদাই তার অভিপ্রায় সম্পর্কে শত্রুকে বিভ্রান্ত করেন। বিশেষ করে যেখানে সৈন্যবল কম এবং শত্রুর অস্ত্র, সাজ-সরঞ্জাম ও সম্পদের ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান সেখানে একজন কমান্ডারকে তার ঘাটতি আড়াল, করার জন্য ফাঁদ পাততে ও ধাপ্পা দিতে হয় এবং কৃত্রিম তৎপরতা ও ছলা-কলাে আশ্রয় নিতে হয়।
বিশ্বাস করা হয় যে, প্ররোচণামূলক তৎপরতায় প্রতিপক্ষের কমান্ডার বিভ্রান্ত হবেন। তার মতামত প্রভাবিত হবে এবং তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আমরা শত্রুকে ধোকা দিতে হিমশিম খেয়েছি। কারণ, আমাদের গোয়েন্দা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছিল।
ক্ষুদ্র একটি সৈন্যদল হিসেবে আমাদের সৈন্য ও সমরাস্ত্রের ঘাটতি পূরণে আমাদেরকে উন্নত প্রশিক্ষণ, দক্ষ নেতৃত্ব, কঠোর শৃঙ্খলা, সাহস ও বিভিন্ন অপ্রচলিত ধারণার ওপর ভরসা করতে হয়েছে। তহবিল ও সাজ-সরঞ্জামের অভাব কাটিয়ে উঠতে আমাদেরকে ব্যাপকভাবে কৃচ্ছতা সাধন করতে হয়েছে এবং একই সময়ে আমাদের শক্তি সম্পর্কে শত্রুকে ধোকা দিতে হয়েছে।
শত্রুকে ধোকা দেওয়ার জন্য স্থানীয় বাঙালিদের সহযোগিতা অপরিহার্য ছিল। সৌভাগ্যবশত আমি কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং আমার কয়েকজন পুরনো সহকর্মী পেয়ে যাই। তারা পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে চেয়েছিলেন এবং আমাকে এ কঠিন দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করতে সম্মত হন।
শত্রুকে ধোকা দেওয়ার জন্য আমি কোথাও সৈন্যদের পরিদর্শন করতে গেলে ঢাকায় অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তান বেসামরিক বাহিনী (ইপকাফ)-এর কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদকে সাথে নিয়ে যেতাম। প্রত্যেকেই জেনারেল জামশেদকে চতুর্থ ডিভিশনের ডিভিশনাল কমান্ডার হিসেবে ধারণা করতো।
আমার অফিসে টেবিলের ওপর পুরু কাপড়ে মোড়া ৪টি পতাকা ছিল। এসব ছোটো পতাকার বাঁশের দত্ত বেরিয়ে থাকতো এবং গণনা করা যেতো। একইভাবে আমার অফিসে মোটা কাপড়ে আবৃত মানচিত্র ছিল। এসব মানচিত্রে।
সেনাবাহিনীর ৪টি ডিভিশনের সীমারেখাও দেখা যেতো। যেসব বাঙালি অফিসার ও বেসামারিক লোকজন আমাদের সহায়তা করতো তাদেরকে দেখানোর জন্যই এমন করা হতো। এতে তারা নিশ্চিত হতো যে, পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের ৪টি ডিভিশন রয়েছে।
এভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৪টি ডিভিশনের শক্তি হিসাবের মধ্যে রেখে আগ্রসান চালায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন সিনিয়র কমান্ডারের স্বীকারোক্তি থেকে আমাদের প্রতারণাপূর্ণ পরিকল্পনার কার্যকারিতা প্রমাণ পাওয়া গেছে।
যুদ্ধ বিরতির পর তাদের সাথে আলাপ হয় আমার। তখন তারা আমাদের পরিকল্পনার সাফল্য স্বীকার করেন। মেজর জেনারেল সুখবন্ত সিং তার ‘দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ নামক পুস্তকে পাকিস্তান ইস্টার্ন গ্যারিসনের শক্তি ৪ ডিভিশন বলে উল্লেখ করেছেন।
তার মতে, ভারতীয় গোয়েন্দারা আমাদের শক্তি সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়েছিল । তারা ধারণা করেছিল যে, ঢাকাতেই পুরো এক ডিভিশন সৈন্য রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকায় ছিল মাত্র একটি ব্রিগেড। মেজর জেনারেল জামশেদের নেতৃত্বে এ ব্রিগেড গঠন করা হয়।
৩৬তম এ এডহক ব্রিগেডে ছিল দুটি ব্যাটালিয়ন। ভারতীয়রা ভেবেছিল যে, ঢাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন রয়েছে। তাই তারা ঢাকা অভিমুখী উত্তরাঞ্চলে সকল রুট বিপদমুক্ত দেখেও দ্রুত রাজধানীতে পৌঁছানোর চেষ্টা অথবা আগ্রহ দেখায় নি।
ব্রিগেডিয়ার শাহ বেগ (পরে মেজর জেনারেল) যুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর তিনি একদিন আমার কাছে আসেন এবং নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি তার সন্দেহ নিরসনের জন্য জানতে চান, পূর্ব পাকিস্তানে আমার সৈন্য সংখ্যা কত ছিল। “আপনাদের সেখানে কত ডিভিশন সৈন্য ছিল, স্যার, তিনি জিজ্ঞেস করলেন। আমি জবাব দিলাম, ‘তিন ডিভিশন।
“আপনাদের কি ৪ ডিভিশন সৈন্য ছিল না? জেনারেল জামশেদের কি দায়িত্ব ছিল।”
বিস্ময়ে তিনি জানতে চাইলেন। আমি তাকে জানালাম যে, জেনারেল জামশেদ ছিলেন ইপকাফের কমান্ডার এবং তিনি আমার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।
“ইপকাফ কি কোনো ব্রিগেডিয়ারের কমান্ডে ছিল না?” তিনি জানতে চাইলেন।
আমি বললাম, ‘আপনি ঠিক বলেছেন, ইপকাফের নেতৃত্বে একজন ব্রিগেডিয়ারই ছিলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার নিসার ইপকাফ থেকে বদলি হলে আমি জেনারেল জামশেদকে তার স্থলাভিষিক্ত করি। জেনারেল জামশেদ আমাদের চতুর্থ ডিভিশন কমান্ড করতেন। এটি ছিল একটি এডহক ডিভিশন এবং সৈন্য ছিল মাত্র দুই দুই ব্যাটালিয়ন।’
আমার কথা শুনে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে যান। তাই আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে।
যাই এবং বলি, ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি একজন শিখ।’
‘হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন আমি একজন শিখ। কিন্তু আপনাদের শক্তি
সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য ঢাকা আসার আগে আমাকে চুল ও দাঁড়ি
কেটে ফেলতে হয়। বাঙালিরা আমাকে ঢাকা নিয়ে আসে। তখন আমার পরনে ছিল বাঙালিদের মতো পোশাক। আমি দুদিন অবস্থান করি এবং রিকশায় ঘুরে। বেড়াই। তবে আমি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করি নি।’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কী দেখতে পেলেন ‘ তিনি বললেন, ব্যাপক সামরিক তৎপরতা দেখে আমার মনে হচ্ছিল যে, ঢাকা সৈন্যে বোঝাই। বাঙালিরা আমার সাথে বের হতে চাইতো না তারা ক্যান্টনমেন্ট অথবা সামরিক অবস্থানে ঢুকতে ভয় পেতো।
এ জন্য আমি ঢাকায় সৈন্যদের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা করতে পারি নি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কবে ঢাকা গিয়েছিলেন?” তিনি বললেন, ‘১৯৭১ সালের নভেম্বরের শুরুতে।
ব্রিগেডিয়ার ক্লার (পরে মেজর জেনারেল) ময়মনসিংহ সেক্টরে একটি ভারতীয় ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পর তিনি আমার কাছে এসেছিলেন এবং ব্রিগেডিয়ার শাহ বেগ যে ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন, তিনিও একই ধরনের প্রশ্ন করেন।
আমি বললাম, আমি জানতে চাই, আপনাদের পর্যাপ্ত সৈনা ও সম্পদ, বিমান বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব, প্রচুর ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ছিল এবং আপনারা মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় জনগণের সমর্থনও পেয়েছিলেন। এক কথায় আপনাদের কোনো ঘাটতি ছিল না বরং সব কিছুতেই ছিল প্রাচুর্য।
আপনারা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কমপক্ষে অর্ধেক সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনারা কোনো দিক থেকে ঢাকা এগিয়ে গেলেন না কেন? ঢাকা অভিমুখি সকল রুট বিশেষ করে উত্তরের দিক থেকে আগত রাস্তা শুরু থেকেই ছিল বিপদমুক্ত।
আপনারা সিলেট এ কুষ্টিয়া অঞ্চলে আমার সৈন্যদের পেছনে সৈন্য নামিয়েছিলেন। এরপর টাঙ্গাইলে আপনাদের প্যারা ব্রিগেড অবতরণ করে। ঢাকা সেক্টরে দুটি জায়গায় হেলিকপ্টারে করে আপনারা মেঘনা নদীর এপারে সৈনা নামিয়েছিলেন।
কিন্তু আপনারা তাৎপর্যপূর্ণ কোনো সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। আপনারা ব্রিগেডিয়ার কাদিরের ব্রিগেডকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা এবং সাদউল্লাহর ব্রিগেডকে আশুগঞ্জ থেকে ভৈরব প্রত্যাহারে বাধা দিতে পারেন নি। আপনারা কাউকে বন্দি অথবা কোনো এলাকায় কোনো সিদ্ধান্ত আঁকড়ে ধরতে পারেন নি।

আপনাদের সম্পদের তুলনায় আপনাদের সাফল্য খুবই নগণ্য। সবকিছু আপনাদের অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও সীমান্তের কাছে সমগ্র ফ্রন্টে আপনারা বিপাকে পড়ে যান এবং আপনারা সেখানে তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন।
ঢাকা সেক্টরে পরিস্থিতি এমন গুলিয়ে যায় যে, আপনাদের সেনা কমান্ডারকে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়। আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া না হলে মার্কিনীরা ভিয়েতনামে এবং ফ্রান্স আলেজরিয়ায় যে পরিণতি ভোগ করেছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও পূর্ব পাকিস্তানে অনুরূপ পরিণতি ভোগ করতে হতো।
ক্লার বললেন, ‘আপনাকে সত্য বলতে কি, আমাদের সিনিয়র অফিসাররা ছিলেন খুবই সতর্ক। কারণ, আমরা ১৯৭১ সালের জুলাই থেকেই আপনার সৈন্যদের সাথে লড়াই করছিলাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে যুদ্ধ করেছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা শুধু সাহসী নয় বরং শক্তিশালী এবং তারা তাদের পেশায় সুনিপুণ এবং লড়াই করার যোগ্যতা তাদের ছিল।
তারা বরাবরই তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অগ্রাভিযানে আমাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতিই হচ্ছে আমাদের সতর্ক অগ্রাভিযানের মূল কারণ। ঢাকা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল যে, এখানে লড়াই হবে কঠিন।
ঢাকাকে বলা হতো ‘বাঘের গর্ত। কামালপুর ও জামালপুর আক্রমণে আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল। এ দুটি স্থানে আপনার সৈন্যরা তাদের অবস্থান ধরে রাখার তীব্র লড়াই করেছে এবং আমাদেরকে ঢাকা অভিযানে বাধা দিয়েছে। ঢাকা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্নায়ুকেন্দ্র।
এ ছাড়া ঢাকায় ছিল আপনার সদর দপ্তর। তাহলে আমরা কীভাবে ভাবতে পারি যে, সেখানে লড়াই করা সহজ হবে। একই সময়ে আমাদের মনে এই ধারণাও ছিল যে, ঢাকা সেক্টরে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন রয়েছে এবং ঢাকার প্রতিরক্ষায় এ ডিভিশনের সৈন্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
আপনার সম্পর্কে আমাদের সকল অফিসারদের একটি উঁচু ধারণা ছিল। তারা আপনাকে একজন ফাইটিং জেনারেল হিসেবে মনে করতেন। ঢাকার প্রতিরক্ষা আপনার ব্যক্তিগত কমান্ডের আওতায় থাকায় তারা যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া আপনার প্রতিরক্ষা লাইনে হামলা করতে চান নি।’
ভারতের চতুর্থ কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিংও এই সত্য স্বীকার করেছেন, তবে ভিন্নভাবে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘ঢাকা দুর্গে আপনাদের কী পরিমাণ শক্তি ছিল?’ আমি তাকে বললাম যে, আমার ৩০ হাজার সৈন্য মোতায়েন ছিল এবং আরো কিছু মোতায়েন করার প্রক্রিয়া চলছিল।
এ ছাড়া আমার আরো ২ হাজার যোদ্ধা ছিল। এরা ছিল অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ও পুলিশ বাহিনীর লোক। এদেরকে আমরা নিয়মিত সৈন্যদের সাথে মিশিয়ে ফেলি। বহু পশ্চিম পাকিস্তানি ও বেসামরিক বিহারিও আমাদের সাথে যোগদান করেছিল।
আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করার জন্য শপথ নিয়েছিলাম। ভৈরব বাজারে মোতায়েন ব্রিগেড এবং নারায়ণগঞ্জে মোতায়েন ৩৬ এডহক ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার্সে অবস্থানরত সৈন্যদেরকে এ হিসাবের মধ্যে ধরা হয় নি। প্রতিটি অফিসারের একজন করে ব্যাটম্যান ছিল এবং এই এলাকায় বহু অফিসার ছিলেন।
মোটের ওপর, ঢাকা ছিল সৈন্যে পরিপূর্ণ। অফিসারদের মধ্যে ছিলেন। তিনজন মেজর জেনারেল, একজন এয়ার কমোডর, দুই জন পুলিশের আইজি, আট জন ব্রিগেডিয়ার, কয়েকজন কর্নেল ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল।
বস্তুতপক্ষে, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে একই সময়ে তিনটি দুর্গ যথা- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ভৈরব বাজারের মোকাবিলা করতে হতো। এতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর গোটা চতুর্থ কোরের প্রয়োজন হতো। নারায়ণগঞ্জের অবস্থান এবং আমাদের পার্শ্বভূমির প্রতিবন্ধকতার কারণে ঢাকা পৌঁছান অথবা অবরোধ করা যেতো না।
ভারতীয়রা একমাত্র উত্তর দিক থেকে ঢাকায় হামলা করতে পারতো। সে ক্ষেত্রেও ভৈরব সেতু ছিল তাদের পেছনে। এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী ফাঁদে পড়ে যেতো। তারা উভয় সংকটে পড়তো। হাজার হাজার লোককে অস্ত্রসজ্জিত করার জন্য আমার কাছে তখনো প্রচুর অস্ত্র ছিল।
জেনারেল সগত সিং বললেন, ‘আমি জানতাম যে, ঢাকা ছিল ভালোভাবে সুরক্ষিত এবং ময়মনসিংহ ব্রিগেডের ঢাকা, আশুগঞ্জ ব্রিগেডের ভৈরব বাজার ও ৩৯তম ডিভিশনের সদর দপ্তর এবং এ ডিভিশনের কিছু সৈন্য নারায়ণগঞ্জে স্থানান্তরিত হওয়ায় ঢাকা দুর্গের শক্তি বৃদ্ধি পায়।
এতে আপনার সৈন্য চলাচলও বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতির প্রকৃতি না জানায় মেঘনা নদীর এপারে হেলিকপ্টার থেকে। সৈন্য নামানো সত্ত্বেও আমাদের তৎপরতা ছিল মূলত উত্তরাঞ্চলীয় অংশে সীমাবদ্ধ। জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা ঢাকা দখলে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন।
আমি তাকে বললাম যে, ঢাকা দখলের আগে আমাদের যথাযথভাবে রেকি চালাতে হবে। এ জন্য আমাদের আকাশ পথে ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ছবি তোলার প্রয়োজন। ঢাকা আক্রমণে যথাযথ পরিকল্পনা ও বিশাল বাহিনীর প্রয়োজন হবে। শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার আগে প্রচণ্ড গোলা বর্ষণের মাধ্যমে।
তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ দুর্বল করে দিতে হবে। গোলাবর্ষণের জন্য আমাদের মাঝারি ও ভারি কামান এবং বিমান থেকে বোমাবর্ষণের প্রয়োজন হবে। মাঝারি ও ভারি কামান এবং ট্যাংক ছাড়া তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যাওয়া হবে আমাদের জন্য আত্মঘাতী।
সুতরাং আমি প্রস্তুতি ও আমার সৈন্য সমাবেশের জন্য ৭ দিন সময় চাই। আগরতলায় আমার হেলিকপ্টার ছিল। কিন্তু ভৈরব বাজারের অবস্থানের কারণে আমাদেরকে সেখান থেকে দূরে সৈন্য নামাতে হয়। ভৈরব বাজার আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকায় আমরা ট্যাংক ও কামান আনতে পারি নি।
৭ দিনের মধ্যে ঢাকায় আঘাত হানার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ এসে পৌঁছবে কি-না সে ব্যাপারেও আমার সন্দেহ ছিল। ভৈরব বাজার ও নারায়ণগঞ্জের অবস্থান আমাদের অভিযানকে অধিক কঠিন করে তোলে।
ঊর্ধ্বতন ভারতীয় অফিসারদের আলাপ-আলোচনা থেকে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের শক্তি সম্পর্কে ধোঁকা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য আমাদের পাতা ফাঁদ ছিল যথার্থ। তারা ভেবেছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার তিনটি নয়; ৪ ডিভিশন সৈন্য রয়েছে।
তারা বিশ্বাস করতো যে, প্রতিটি বিভাগে অস্তুত একটি করে ডিভিশন মোতায়েন রয়েছে। সুতরাং তারা আমার ৪ ডিভিশন সৈন্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি করে। এ পরিমাণ সৈনা আছে ভেবেই তারা শুরুতে ঢাকা দখলের উদ্যোগ নেয় নি। তবে তারা আমার প্রকৃত ক্ষমতা জানতে পারলে তাই করতো। একই কারণে কুষ্টিয়ায় প্রচুর সৈন্য হতাহত হওয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ফরিদপুরে এগিয়ে আসে নি ।
আমাদের এসব প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা কয়েকজন ভারতীয় জেনারেল। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সৈন্যের কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার জন্য মারাত্মক বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, সকল সুবিধা, অনুকূল পরিস্থিতি ও পর্যাপ্ত স্থানীয় সহায়তা সত্ত্বেও তিন হাজার মাইলব্যাপী সীমান্তে ৯ মাসে তিনি কিছুই অর্জন করতে পারেন নি।
যুদ্ধের ইতিহাসে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা যতোটুকু সুবিধা ও অনুকূল পরিবেশে যুদ্ধ করেছেন তা সত্যি এক বিরল ঘটনা। প্রতিপক্ষের তুলনায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সুবিধা ছিল অন্তত দশ গুণ বেশি। আমাদের জঙ্গীবিমান, বিমান- বিধ্বংসী কামান, দূরপাল্লার আর্টিলারি এবং ট্যাংকের ঘাটতি ছিল বিরাট।
পক্ষান্তরে, জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কোথাও কোনো ঘাটতি ছিল না। বিমান শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্বের কারণে তিনি বিমানের ছত্রছায়া, বিমানে করে সৈন্য পরিবহন, নদী পারাপারে বিমান সুবিধা ও আকাশ পথে অব্যাহত সরবরাহ সুবিধা ভোগ করেন।
সমুদ্র ও নদীতে ছিল তার অবাধ কর্তৃত্ব। আমাদের পেছনে ও উভয় দিকে বিনা বাধায় তার সেনারা উপকূল বরাবর ও নদীর তীরে অবতরণ করেছে। প্রতিটি সেক্টরে তার কয়েক ব্রিগেড ট্যাংকগুলো ছিল উভচর।
পক্ষান্তরে, আমাদের ট্যাংকের গোলা ভারতীয় ট্যাংকের বিরুদ্ধে অকার্যকর। প্রমাণিত হয়। তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে দূরপাল্লার কামান ছিল। এসব দূরপাল্লার কামানের বিরুদ্ধে আমাদের স্বল্পপাল্লার কামানগুলোকে অনবরত গোলাবর্ষণ করতে হতো।
এতে আমাদের পদাতিক বাহিনীকে সমর্থনদানের সামর্থ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। ভারতীয়রা মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণদান এবং তাদের সংগঠনে রুশ বিশেষজ্ঞদের সহায়তাও পেয়েছিল। রুশরা যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয়দের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র চালনায় সহায়তা দিতো।
এ ছাড়া হাজার হাজার বাঙালি ও ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তি মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতো। এসব সুবিধা সত্ত্বেও জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা সামরিকভাবে বিজয়ী হতে পারেন নি। আমাদেরকে রাজনৈতিক পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল এবং এটা করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। যুদ্ধ থেমে যাবার মাত্র কয়েক মাস পর অন্য কোনো কাজে নিয়োজিত না করে জেনারেল আরোরাকে অবসরে পাঠানো হয় ।
আরও দেখুন: