আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ যুদ্ধের শেষ দিকে পরিকল্পিত বিপর্যয়। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।
যুদ্ধের শেষ দিকে পরিকল্পিত বিপর্যয়
যুদ্ধের শেষ দিকে পরিকল্পিত বিপর্যয়
পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার ক্রমাগত ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্ত প্রকাশ করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি অবশ্যই বলবো যে, দেশ শাসন ও নীতি- নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের বৈধ অধিকার থেকে পূর্ব পাকিস্তানিদের বঞ্চিত করা ছিল পাকিস্তানের সকল শাসকের একটি অভিন্ন নীতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন করার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া হলে পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারতো ।
ঐ নির্বাচনে মুজিবের বিজয়ে ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো নাখোশ হন। কারণ, নির্বাচনের পর এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইয়াহিয়া খানকে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়তে হবে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বসতে হবে বিরোধী দলীয় নেতার আসনে যা তার আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী। তাই ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো এক হন এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিজ শহর লারকানায় উভয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এ ষড়যন্ত্র ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ হিসেবে পরিচিত।
“এমএম আহমেদ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য এ ষড়যন্ত্র করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত এবং কূটবুদ্ধি, হুমকি, চক্রান্ত ও সামরিক শক্তি প্রযোগের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করা ছিল এমএ আহমেদ পরিকল্পনার লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উত্তাধিকারী সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার তারিখ ঘোষণা করার পর মোর জেনারেল ওমর এ অধিবেশন বর্জন করার জন্য রাজনীতিকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। তিনি অধিবেশন বর্জনের যুক্তি হিসেবে বলতেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের এটি আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দিতে হবে। শেষটায় পোলিশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। করায় পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগে তার পরিকল্পনা সফল হয়।
মি. সাজ্জাদ হায়দার তখন ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত। রাশিয়া ও ভারত ১৯৭১ সালের আগস্টে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার পর তিনি পাকিস্তান সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন যে, ভারত তার মিত্র রাশিয়ার সহায়তায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং ইস্টার্ন গ্যারিসনকে গ্রাস করার জন্য বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে। মি. হায়দার এ হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর তাকে অযথা ভীতি ছড়াতে নিষেধ করা হয়। এরপর তিনি ভারতীয়দের ইচ্ছে সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠাতে শুরু করলে তাকে তুরস্কে বদলি করা হয়।
আমি এমএম আহমেদ পরিকল্পনার বিষয়বস্তু জানতে পারি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন চিফ সেক্রেটারি জনাব মোজাফফর হোসেনের কাছ থেকে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর তাকে গভর্নর হাউস থেকে সরিয়ে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়। প্রচণ্ড রাগে ও ক্ষোভে তিনি বলে ফেলেন যে, শেষ পর্যন্ত এমএম পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো।
প্রবীণ রাজনীতিক জাফর আহমেদ আনসারী আমার সাথে এক বৈঠকে এ ধরনের একটি পরিকল্পনার অস্তিত্ব ছিল। বলে স্বীকার করেন। জনাব এমএম আহমেদের এক ডজন পরিকল্পনার মধ্য থেকে এই পরিকল্পনা বেছে নেওয়া হয়। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত রাখা এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া ।

লারকানা ষড়যন্ত্র ছাড়াও জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার লোকজন আরো বহু চক্রান্ত করে। এসব ষড়যন্ত্রের একটি হচ্ছে জুলফিকার আলী ভুট্টো, লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান ও এয়ার মার্শাল রহিম খানের মধ্যকার ষড়যন্ত্র।
কথা দেওয়া হয় যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হলে চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসানকে সেনাবাহিনী প্রধান বানানো হবে এবং এয়ার মার্শাল রহিম খানকে বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে পুনঃনিয়োগ দেওয়া হবে।
এক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় এ ষড়যন্ত্রের কিঞ্চিত বাস্তবায়ন করা হয়। ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমতা হস্তান্তরে চাপ দেওয়া হলে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তখন এয়ার মার্শাল রহিম খান তার জঙ্গিবিমান নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনের ওপর চক্কর দিতে থাকেন।
জেনারেল গুল হাসান তার স্মৃতিকথায় স্বীকার করেছেন যে, আমাদের আত্মসমর্পণের পর এয়ার মার্শাল রহিম খানের সাথে তার ঘনিষ্ঠ কথা-বার্তা হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো জেনারেল টিক্কার সাথেও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন।
জুনিয়র অফিসার জেনারেল গুল হাসান সেনাবাহিনী প্রধান হলে ২১ জন সিনিয়র জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার অবসর গ্রহণকরলেও টিক্কা অবসর গ্রহণ করেন নি। পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়ের জন্য টিক্কাই মূলত দায়ী। ২৫ মার্চের নৃশংস সামরিক অভিযানের জন্য তাকে ‘কসাই’ খেতাব দেওয়া হয়। পাকিস্তানের পুরো যুদ্ধ পরিকল্পনা বানচাল করে দেওয়ার জন্য দায়ী হওয়া সত্ত্বেও তাকে সেনাবাহিনী প্রধান পদে নিযুক্তির আশ্বাস দেওয়া হয়। আমি এসব ষড়যন্ত্রের কথা অনেক পরেও জানতে পারি নি।
১৯৭৪ সালে আমি ভারতের বন্দি দশা থেকে ফিরে এসে পূর্ব পাকিস্তানে। বিপর্যয় সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরিকালে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারি যে, একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইস্টার্ন কমান্ডকে উৎসর্গ করা হয়েছে এবং বিপর্যয়ের জন্য ইস্টার্ন কমান্ডের সিনিয়র কমান্ডারদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে।
এ বই লেখার সময় আমি যখন বিভিন্ন লোকের সাথে আলোচনা এবং যোগাযোগ শুরু করি তখন আমার সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়।আমি যাদের সাথে আলাপ করেছি তারা আমাকে জানিয়েছেন যে, সুচিন্তিতভাবে ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে এবং হাই কমান্ডের একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই তা করা হয়েছে।
ভারতের জব্বলপুরে ভারতীয় মেজর জেনারেল শাহ বেগ সিংয়ের কাছ থেকেও আমি এই কথা শুনেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, স্যার। তারা এ বিপর্যয়ের সব দোষ আপনার ও আপনার কমান্ডের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরও দেখুন: