[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

যুদ্ধবন্দি শিবির নম্বর ১০০

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ  যুদ্ধবন্দি শিবির নম্বর ১০০। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।

যুদ্ধবন্দি শিবির নম্বর ১০০

 

যুদ্ধবন্দি শিবির নম্বর ১০০

 

যুদ্ধবন্দি শিবির নম্বর ১০০

আমাদেরকে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম থেকে ডাকলপুরে ১০০ নম্বর শিবিরে নেওয়া হয়। এ শিবিরটি ‘জেনারেলদের শিবির’ হিসেবে পরিচিত ছিল। আমাদের ব্যাটম্যানগণ আমাদের সাথেই রইল। কিন্তু আমাদের এডিসিদের জন্য আরেকটি জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী ও ব্রিগেডিয়ার কাসিমকে বেরিলিতে এবং মেজর সিদ্দিক সালিককে এডিসিদের সাথে স্থানান্তর করা হয়।.

জেনারেল রাও ফরমানের ওপর আবার শ্যেনদৃষ্টি পড়ে। ভারতীয়রা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করতে চাইল। আমি কর্নেল খাবাকে ডেকে পাঠালাম এবং কড়া ভাষায় তার কাছে প্রতিবাদ জানাই। আমি তাকে বললাম যে, কোনোভা কনভেনশন এবং ঢাকা সমঝোতার আলোকে ফরমানকে আটক ভারতীয় প্রস্তাব চুক্তির একটি সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রতিশোধ গ্রহণ ও হয়রানির আশঙ্কা রয়েছে।

খারা আমাকে জানান যে, মুজিব মুক্তি পাবার পর বাঙালিরা ফরমানকে তাদের হাতে হস্তান্তরের জন্য প্রবলভাবে দাবি করছে। বাঙালি স্বার্থের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করায় তারা যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার বিচার করতে চায়। ১৪ই ডিসেম্বর ফরমানের অফিস থেকে উদ্ধারকৃত ডায়েরির কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

এ ডায়েরিতে ফরমান নিজ হাতে লিখেছিলেন, ‘শ্যামল মাটিকে রক্তে লাল করে দেওয়া হবে। আমি পাকিস্তানে ফিরে আসার পর জুলফিকার আলী, ভুট্টোর সাথে এক সাক্ষাৎকারকালে তিনি আমাকে এ ডায়েরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন।

ফরমান দাবি করেছেন যে, তিনি শক্তি প্রয়োগের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু ২৫শে মার্চের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় তার সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তিনি শক্তি প্রয়োগের বিরোধিতা করেন নি।

ফরমান কখনো সরকারি নীতির সাথে দ্বিমত পোষণ করেন নি। সুতরাং আমরা এ কথা বলতে বাধ্য যে, তিনি সরকারি নীতি ও কার্যক্রমকে সমর্থন করেছেন। তাকে পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিচেনা করা হতো। সরকার তার মতামতের মূল্য দিত এবং তার পরামর্শ ও সুপারিশ অনুযায়ী কাজ করতো। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হওয়ার দায় থেকে তিনি নিজেকে কখনো মুক্তা করতে পারবেন না ।

আমি ভারতীয়দের বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, ২৫শে মার্চ অথবা কথিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে ফরমানের সংশ্লিষ্টতা সত্ত্বেও চুক্তি অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। পাকিস্তান সরকারই তার ভাগ্যের ফয়সালা করবে। আমি জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য কর্নেল খারাকে অনুরোধ করি।

যারা চলে গেলেন। তিনি কয়েক ঘন্টা পর আবার ফিরে এসে জানান যে, ফরমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হচ্ছে না। আমি ফরমানকে একথা জানানোর পর তিনি ভীষণ খুশি হন এবং আমার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বললেন, ‘স্যার, আমাকে সাহায্য করায় আমি আপনার প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আশা করি, আমরা পাকিস্তানে ফিরে যাবার পর আপনি আমাকে এভাবেই সাহায্য করবেন ।।

আমি প্রতিশ্রুতি দিই। তবে আমি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতাম না যে, পাকিস্তানে ফিরে যাবার পর তাকে পুরস্কৃত করা হবে। পাকিস্তানে তার আমার সাহায্যের প্রয়োজন হয় নি। যে লোকটি তার দেশ ও সেনাবাহিনীকে অবর্ণনীয় দুর্দশায়।

ফেলেছে সেই লোকটিকেই বিপুলভাবে পুরস্কৃত করা হয়। প্রথমে তাকে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে চাকরি দেওয়া হয় এবং তরে তাকে ফৌজি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান করা হয় । আরো পরে তিনি মন্ত্রীও হয়েছিলেন।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটি ইউনিটের ব্যাচেলর কোয়ার্টারে আমাদের থাকার জায়গা হয়। প্রত্যেক অফিসারকে একটি করে কোয়ার্টার দেওয়া হয়। প্রতিটি কোয়ার্টারে ছিল একটি বেডরুম, পাশে বাথরুম এবং একটি বৈঠকখানা।

সামনে একটি বারান্দাও ছিল। ভবনটি সদ্য নির্মাণ করা হয়েছে এবং সাজ-সজ্জা ছিল চমৎকার। বাড়তি ছিল কিছু রুম। আমরা এসব রুমের একটিকে মসজিদ, আরেকটিকে মেস বানানোর এবং আরেকটি কোয়ার্টার আমাদের চাকর- বাকরদের থাকার জন্য ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। খাবার ছিল একঘেঁয়ে। ভাত, চাপাতি, শাক-সবজি, ডাল এবং মাঝে মাঝে মাংস

আমাদের শিবির ঘেরাও করে রাখা হয় প্রায় ৫০ গজ উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে যাতে কেউ ভেতরে প্রবেশ অথবা ভেতর থেকে বের হতে না পারে। শিবিরের চার কোণায় ৪টি ৩০ ফুট উঁচু প্রহরা চৌকি ছিল। গুগুলোতে সার্চলাইট ছিল এবং রাত হলেই চারদিকে আলো করে এগুলো জ্বলে উঠতো।

একজন টহলদার পাঞ্জাবি সৈন্য একটি এলসেশিয়ান কুকুর সাথে নিয়ে ২৪ ঘণ্টা শিবির এলাকায় টহল দিতো। এটা ছিল ভেতরের নিরাপত্তা ব্যূহ। বাইরে আরেকটি নিরাপত্তা ব্যূহ ছিল। তাতেও এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য মোতায়েন করা হয়। এভাবে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।

জেনারেল জামশেদ কিছুদিন পর আমাদের সাথে যোগ দেন। আমাদের এডিসি ও দুই জন ব্রিগেডিয়ার ছাড়া কলকাতায় আমরা যারা একসাথে ছিলাম তারা আবার এখানে একত্রিতই হই। প্রশাসনিক ও অন্যান্য বিষয়ের জন্য আমাদের শিবির সরাসরি একজন স্টেশন কমান্ডারের আওতায় ন্যস্ত করা হয়।

স্টেশন কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল পদ্ম। শিখ ক্যাভালরি অফিসার জেনারেল পদ্মা ছিলেন খুবই স্মার্ট, বুদ্ধিমান ও সহানভূতিশীল। তার মর্যাদাপূর্ণ আচার-আচরণে আমাদের কাছে বন্দিশালার পরিবেশও সহনীয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

শিবিরের কমান্ডার ছিলেন একজন মেজর। মেডিকেল কোরের একজন ক্যাপ্টেন শিবিরের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করতেন। চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল এবং কেউ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে জব্বলপুর সিএমইচ-এ পাঠানো হতো।

আমাদের কেউ কেউ জব্বলপুর সিএমএইচ-এ গিয়েছেন। তবে কেউ কখনো ভর্তি হন নি অথবা সেখানে অবস্থান করেন নি। মোটকথা, শিবিরের স্টাফদের ব্যবহার ছিল চমৎকার এবং তাদের আচরণ ও কথা-বার্তায় কখনো ঔদ্ধত্য ও বাড়াবাড়ি প্রকাশ পায় নি।

আমরা রুটিনমাফিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর। বিপদে ও দুঃসময়ে আল্লাহকে মানুষ বেশি স্মরণ করে। তাই আমরা নিয়মিত নামাজ আদায় করতাম। জেনারেল আনসারী নামাজে ইমামতি করতেন। বন্দি হওয়ার আগেও আমি নিয়মিত নামাজ পড়তাম। তবে বন্দি জীবনে আমি নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াতে পুরোপুরি আত্মনিবেদেন করার সুযোগ পাই।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আমরা রুমে ব্যায়াম করতাম এবং শিবির চত্বরে হাঁটাহাঁটি করতাম। এতে আমাদের উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হতো। আমরা প্রচুর বই-পত্র ও ম্যাগাজিন পড়তাম। এগুলো হয় কিনতে হতো নয়তো স্টেশনের লাইব্রেরি থেকে ভাড়া করে আনতে হতো। নিয়মিত দৈনিক পত্রিকাও পড়তাম। পত্রিকা পড়ে আমরা বর্তমান পরিস্থিতি এবং বিশ্বের নানা খবর জানতে পারতাম। সময় যেমন কাটতেই চাইতো না ৷৷

নগদ টাকার পরিবর্তে টোকেন দেওয়া হতো আমাদেরকে। প্রতি মাসে আমি বেতন হিসেবে ১৪০ রুপি পেতাম। এই অর্থ ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবনে এ সামান্য অর্থ বিরাট উপকারে আসতো। আমরা এ অর্থ দিয়ে বই-পুস্তক, লেখার উপকরণ ও খাবার-দাবার কিনে খেতাম।

আমাদের কেনা-কাটার জন্য একজন ভারতীয় হাবিলদারকে নিযুক্ত করা হয়। এ হাবিলদার প্রতিদিন আমাদের কাছে আসতো এবং বাজার থেকে আমাদের যা কিছু প্রয়োজন হতো সেগুলো সে কিনে আমাদের কাছে পৌঁছে দিতো।

বন্দিত্বের মেয়াদ বাড়তে থাকে এবং আশু মুক্তির কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিলাম না। নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব থেকে দূরে থাকায় চিঠিপত্রই ছিল তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র উপায়। আমরা চিঠি পেলে এবং চিঠি লিখে খুবই সান্ত্বনা পেতাম।

আপন জনদের কাছ থেকে পাওয়া চিঠি পড়ে যে আনন্দ পেতাম তার সাথে অন্য কোনো আনন্দের তুলনা খুঁজে পেতাম না। এসব চিঠিতে থাকতো সান্ত্বনা ও ভালোবাসার পরশ। তাই চিঠিগুলো বার বার পড়তাম।প্রথম দিকে ভারতীয়রা আমাদেরকে লেখার উপকরণ সরবরাহ করতো।

কিন্তু পরে এ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে গাঁটের পয়সা দিয়ে আমাদেরকেই এগুলো নিতে হতো। প্রতিদিনই আমাদের চিঠিপত্র সংগ্রহ করা হতো এবং আমরা চিঠি পাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। চিঠিগুলো সেন্সর করা হতো এবং মাঝে মধ্যে চিঠির মূল কথাও কেটে বাদ দেওয়া হতো।

আমি প্রচুর পেয়েছি। কোনো কোনোটি ছিল তিক্ত এবং কোনো কোনোটি ছিল চিঠি উৎসাহব্যাঞ্জক। উৎসাহব্যাঞ্জক চিঠিগুলো আমাকে সাহস ও দৃঢ়তার সাথে বন্দি জীবনের দুর্বিষহ যন্ত্রণা মোকাবেলা করার প্রেরণা যোগাতো।

আমি সংক্ষিপ্ত করে হলেও প্রতিটি চিঠির উত্তর পাঠাতাম। বিদেশ থেকেও খাদ্যদ্রব্য, উপহার সামগ্রী ও চিঠি আসতো। পার্সেলগুলোর মধ্যে থাকতো চকোলেট, টফি, শেভ করার সাজ-সরঞ্জাম, সুগন্ধি প্রভৃতি। পাকিস্তান ও বিদেশ থেকে চিঠিপত্রের মাধ্যমে সান্ত্বনা ও উৎসাহ না পেলে ভারতে আড়াই বছরের বন্দি জীবন হতো দোযখের মতো।

ভারতীয় কূটনীতিক ও ভারতপন্থী মুসলমানরা অন্যান্য শিবিরে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালাচ্ছিল। জুনিয়র পাকিস্তানি অফিসারগণ এসব প্রচারণাকে তাচ্ছিল্যের সাথে প্রত্যাখ্যান করে। আমাদের অফিসারগণ বৈরী মনোভাব প্রদর্শন করায় ভারতীয়দের পক্ষে তাদের মগজধোলাই করা সম্ভব হয় নি। আমাদের সৈন্যরাও একই মনোভাব প্রদর্শন করে। তাই আমাদের মাঝে ভারতীয়দের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করার লোক তৈরি করা সম্ভব হয় নি।

ভারতীয় কর্মকর্তা ও রেডক্রসের প্রতিনিধিগণ আমাদের শিবির পরিদর্শন। করতে আসতেন। তবে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সফর আমাদের কাছে স্বস্তিদায়ক না হলেও রেডক্রস প্রতিনিধি দলের সফর ছিল আমাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।

রেডক্রস প্রতিনিধি দল ভারতীয়দের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করতেন এবং পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ওপর ভারতীয়রা কোনো জুলুম বা বাড়াবাড়ি করছে কি- না সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতেন। তাদের কাছে কোনো অভিযোগ করা হলে তারা সাথে সাথে তার প্রতিকার করতেন। তারা বন্দি জীবনে পাকিস্তানি সৈন্যদের ভদ্র আচরণের প্রশংসা করেছেন।

এক পর্যায়ে ভারতীয়রা শিবিরের চারদিকে একটি দেয়াল তৈরি করতে শুরু করে। আমি প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু আমাকে জানানো হয় যে, আমার নিরাপত্তার জন্যই এ দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। জেনারেল পদ্ম আমাকে জানান যে, পাকিস্তান সরকার আমাকে হত্যা করার জন্য দুই জন ঘাতক পাঠিয়েছে।

কলকাতায় জামশেদ নামে একজন পাকিস্তানিকে ভারতীয় গোয়েন্দারা আটক করেছে। জামশেদ স্বীকার করেছে যে, আমাকে হত্যা করার জন্য তাকে এবং আরো একজনকে পাঠানো হয়েছে।

এ জন্য ভারতের জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে জেনারেল পদ্মকে নির্দেশ দিয়েছে। শিবিরের চারদিকে ছিল প্রচুর গণ ঝোপ-ঝাড়। এগুলোর আড়ালে যে কোনো ব্যক্তি টেলিস্কোপিক রাইফেল নিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারে।

এ দেয়াল নির্মাণের পর আমি বাইরে বের হওয়া মাত্র শিবিরের বাইরের কয়েকটি চৌকিকে সতর্ক করে দেওয়া হতো এবং সৈন্যরা পরিখায় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতো। সশস্ত্র টহল দল প্রতিদিন ভোরে শিবিরের আশপাশের এলাকায় অনুসন্ধান চালাতো। লাহোরে ফিরে আসার পরও দুই বার আমার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয় ।

মেজর জেনারেল শাহ বেগ সিংকে মেজর জেনারেল পদ্মর স্থলাভিষিক্ত করা হয়। শাহ বেগ ব্রিগেডিয়ার থাকাকালে ঢাকায় তার সাথে আমার দেখা হয়। তিনি ছিলেন খুবই বন্ধুবৎসল এবং তিনি হিন্দুদের বিরুদ্ধে তার ঘৃণা প্রকাশ করেন । তিনি খোলাখুলি অভিযোগ করে যে, শিখদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হয়েছে এবং তাদেরকে এমনভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে যেন তারা পূর্ব পাঞ্জাবেও সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে না পারে।

প্রথম মনে হয়েছিল যে, তিনি আমার সাথে চাতুরি করেছেন। কিন্তু পরে আমি বিশ্বাস করি যে, তিনি যা বলেছেন তাতে কোনো খাদ ছিল না। তিনি আমাকে খালিস্তানসহ গোটা পাঞ্জাবের একটি মানচিত্র দেখান। জেনারেল শাহ বেগ সিং অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সৈন্যদের অভিযানে সন্তু ভিন্দ্রানওয়ালের সাথে নিহত হন।

ইতোমধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসানকে সেনাবাহিনী প্রধান করা হয় যদিও তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল না। তার সিনিয়র সকল জেনারেল অবসর গ্রহণের আবেদন করেন। কেবল গুল হাসানের সিনিয়র টিক্কা খান তার অধীনে কাজ করার জন্য রয়ে গেলেন। এটা এক নজিরবিহীন ঘটনা।

মনে রাখা প্রয়োজন যে, গুল হাসান পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবেও তার ভূমিকা সন্তোষজনক ছিল না। তিনি ইন্টার্ন কমান্ডে একটি প্রতারণাপূর্ণ বার্তা পাঠিয়েছিলেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা দিয়েছিলেন।

শাহ বেগ আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার মতে, এটা একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা এবং টিক্কা খানকে পরবর্তীতে গুল হাসানের স্থলাভিষিক করা হবে। আমি তার কথা বিশ্বাস করি নি। কারণ, গুল হাসান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করেছেন। কিন্তু ভারতীয়দের ধারণা কতো সঠিক।

এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, পাকিস্তানি নাগরিকরা যতোটুকু ভেতরে যেতে না পারে ভারতীয়রা তার চেয়েও বেশি ভেতরে ঢোকার ক্ষমতা রাখে। দৃশ্যত তারা জুলফিকার আলী ভুট্টোর অভিপ্রায় সম্পর্কে সচেতন ছিল।

কারণ, বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাসঘাতকতায় যারা লাভবান হয় তারাও বিশ্বাসঘাতকদের বিশ্বাস করে না। জুলফিকার আলী ভুট্টো গুল হাসানের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ কার্যকলাপে লাভবান হয়েছিলেন এবং তার এসব কার্যকলাপ সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন।

 

যুদ্ধবন্দি শিবির নম্বর ১০০

 

তাই জুলফিকার আলী ভুট্টো একজন বিশ্বাসঘাতক সব সময়ই বিশ্বাসঘাতক’- এই বহুল প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী কাজ করেন। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরই অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে গুল হাসানকে সেনাবাহিনী থেকে বিদায় করে দেওয়া হয়। এটাই ছিল বিশ্বাস ঘাতকের পুরস্কার।

আরও দেখুন:

Leave a Comment