মুক্তিযুদ্ধে শিবপুর | হায়দার আনোয়ার খান জুনো :
মুক্তিযুদ্ধে শিবপুর | হায়দার আনোয়ার খান জুনো
এক
রাজধানী ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলার অন্তর্ভুক্ত শিবপুর উপজেলায় বামপন্থীদের নেতৃত্বে এক বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল ১৯৭১ সালে। শিবপুর সদর বাদে গোটা উপজেলাকে মুক্ত/আধা-মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন প্রায় স্বাধীনতাযুদ্ধের নয় মাসই। নয় মাসে অসংখ্য যুদ্ধ হয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে। শিবপুরের এই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় খুব বেশি আলোচনা হয় না। অথচ যুদ্ধকালীন আধা-মুক্ত শিবপুর এলাকায় অনেকটা চীন-ভিয়েতনামের মুক্তাঞ্চলের ধাঁচের ব্যতিক্রমধর্মী গণপ্রশাসনও গড়ে উঠেছিল। সে সম্পর্কে আলোকপাত করাই এই রচনার মূল উদ্দেশ্য। কারণ তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে।
শিবপুরে সত্যিকার অর্থেই জনযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। শিবপুরের গ্রামাঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল জনগণের নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা। সেখানে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে অর্থ ও খাদ্য সংগ্রহ হতো জনগণের সম্মতির ভিত্তিতেই। বস্তুতই শিবপুরের মুক্তাঞ্চল ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। মুক্তিযোদ্ধারা কোথাও স্বতন্ত্রভাবে চাঁদা সংগ্রহ করেছেন অথবা জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন, এমন একটি ঘটনাও ছিল না। একথা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, শিবপুরে কোনো রাজাকার তৈরি হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনী এসেছিল অনেকবার শিবপুরের প্রধান নেতা মান্নান ভূঁইয়ার বাড়ি পুড়িয়ে দিতে। কিন্তু কেউ তার বাড়ি দেখিয়ে দেননি। প্রথমদিকে কয়েকজন ডাকাতকে গুলি করে মারার পর পরবর্তী সময়ে একজন ডাকাতও ছিল না। এই সবই ছিল শিবপুরের গণযুদ্ধের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। জনগণের মধ্যে এমন সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব স্বাভাবিক সময়ে দেখা যায় না।
![মুক্তিযুদ্ধে শিবপুর | হায়দার আনোয়ার খান জুনো 3 হায়দার আনোয়ার খান জুনো [ Haider Anwar Khan Juno, File Photo ] শিবপুরের এই ব্যতিক্রমধর্মী যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল 'কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি'র নেতৃত্বে। এই কমিউনিস্ট সংগঠনটির নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে হায়দার আনোয়ার খান জুনো অন্যতম।](https://historygoln.com/wp-content/uploads/2022/04/Haider-Anwar-Khan-Juno-হায়দার-আনোয়ার-খান-জুনো-File-Photo-300x179.jpg)
শিবপুরের এই ব্যতিক্রমধর্মী যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি’র নেতৃত্বে। এই কমিউনিস্ট সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, আবদুল মান্নান ভূঁইয়া, মোস্তফা জামাল হায়দার। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন ছিল এই গোপন কমিউনিস্ট সংগঠনের প্রকাশ্য গণসংগঠন। তাছাড়া ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি’র গ্রামাঞ্চলের কর্মীরা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সমিতিতে কাজ করতেন। শিবপুরে কৃষক সমিতি ও বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের শক্ত ঘাঁটি ছিল।
শিবপুরের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রাজনৈতিক নেতা ছিলেন আবদুল মান্নান ভূঁইয়া। প্রধান সামরিক কমান্ডার ছিলেন মজনু মৃধা। শিবপুরের এই মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল এবং বিস্তৃতি ঘটেছিল নরসিংদী (যার প্রধান সামরিক নেতা ছিলেন শহিদ নেভাল সিরাজ, যিনি আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সহযোগী ছিলেন এবং একই রাজনৈতিক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন), রায়পুরা, মনোহরদি ও পলাশ উপজেলায়। নরসিংদীতে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পটি শিবপুরের গেরিলাবাহিনীই দখল করেছিল। শিবপুরের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সাহায্য আসেনি। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অস্ত্র (প্রধানত পশ্চাদপসরণকারী সৈনিকদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র) এবং পরে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র দিয়ে অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত আমি ছিলাম ঢাকায়। তখন আমি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল শিবপুরের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার। আমি নিজেকে বিশেষভাবে সৌভাগ্যবান মনে করি এই কারণে যে, তখন আমি ছিলাম যুবক- যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময়।
অনেক বছর হলো। স্মৃতিতে অনেক কিছুই ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিন্তু কিছু স্মৃতি কিছুতেই মলিন হতে পারে না। শিবপুরের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কমান্ডার মজনু মৃধা আজ আর নেই। কিন্তু কি করে ভুলব তার অসাধারণ বীরত্ব, রণকৌশল এবং অমন চমৎকার বন্ধুর মতো আচরণ। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বের অসাধারণ গুণাবলি, সাংগঠনিক দক্ষতা, বিচক্ষণতা, দেশপ্রেম ও মানবিক গুণাবলি আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না শহিদ মুক্তিযোদ্ধা ফজলু, মানিক ও ইদ্রিসকে। তারা সকলেই ছিল কিশোর। ভোলা যায় না অসম সাহসী যোদ্ধা নেভাল সিরাজকে, যিনি স্বাধীনতার অল্প পরেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন।
বটেশ্বরের নুরুল ইসলাম চাচা, খালেকের ট্যাকের খালেক ভাই, বসিরুদ্দিন খান (যার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদাররা এবং যার দুই ছেলেই, কনক ও ঝিনুক যুদ্ধ করেছিল), মান্নান খান, আব্দুল আলী মৃধা, আওলাদ হোসেন খান, তোফাজ্জল হোসেন, সেন্টু, শহীদ, মিলন, গফুর এবং কিশোর মহম্মদ হোসেন ও সালেক এইরকম অসংখ্য সহযোদ্ধার কথা কখনই ভোলা সম্ভব নয়। স্মৃতিতে চিরঅম্লান হয়ে থাকবেন সহযোদ্ধা নুরুল হক ও নুরুল ইসলামের মা হেনা বিবি, যিনি মায়ের স্নেহ যেমন দিয়েছেন তেমনি জুগিয়েছেন সাহস। শিবপুরের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমার জীবনের দুর্লভ সম্পদ।

দুই
শুরুটা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকেই করা যাক। ঐ দিন বিকেলবেলা ঢাকার পল্টন ময়দানে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে দুই লক্ষাধিক মানুষের বিশাল জনসভা হয়েছিল। কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, আতিকুর রহমান সালু ও আমি বক্তৃতা করেছিলাম। আমরা ঘোষণা করেছিলাম যে, মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমরা আহ্বান রেখেছিলাম। তবে আমরা তখনও জানতাম না যে, সেই রাত্রেই পাকিস্তানি দস্যু বাহিনী নিরস্ত্র জনগণের ওপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে। সেটাই ছিল বিভীষিকার কালো রাত।
২৭ তারিখ সকালে স্বল্প সময়ের জন্য কারফিউ উঠে গেলে কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, শেখ আবদুল কাদের (বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী) নিয়ে শিবপুরের পথে রওয়ানা হই। প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক ও লেখক জহির রায়হানের গাড়িতে করে, আমি ড্রাইভ করছিলাম। জহির রায়হান কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব সমন্বয় কমিটির সভ্য ছিলেন। তিনি তার গাড়িটি আমাদেরকে দিয়ে দিয়েছিলেন। যুদ্ধের নয় মাস ঐ গাড়িটি শিবপুরে ছিল যুদ্ধের প্রয়োজনে।
আমাদের আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল যে, গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি করে গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে। শিবপুর হবে প্রধান ঘাঁটি। তাই নেতৃবৃন্দ প্রথমেই শিবপুর চলে যান। পরদিন ২৮ মার্চ আমি ঢাকা ফিরে গিয়ে আমার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী চপল, কাজী জাফর আহমেদের স্ত্রী বুলু ভাবি ও তাদের দুই বছরের কন্যা জয়া এবং ছাত্রীনেত্রী শাহরিয়া আখতার বুলুকেও শিবপুর নিয়ে আসি। পরে আমার মা-বাবাও ঢাকার বাসা ছেড়ে শিবপুর আশ্রয় নিয়েছিলেন।
১ এপ্রিল রনো ও মেনন ভাই মওলানা ভাসানীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ হয়ে টাঙ্গাইলের বিন্নাপুরে গিয়েছিলেন। এপ্রিল মাসেই প্রথমে রাশেদ খান মেনন ও পরে রনো শিবপুর ফিরে আসেন। তারা অবশ্য থাকেননি। চলে গিয়েছিলেন অন্যত্র। কাজী জাফর আহমেদও চলে গিয়েছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার চিয়রা গ্রামে। ১ জুন তারা তিনজন বামপন্থীদের সম্মেলনে যোগদান করার জন্য কলকাতা গিয়েছিলেন। সেই সম্মেলনেই গঠিত হয়েছিল “জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি”।
আমিও কাদের পার্টির নির্দেশেই সিলেটের মৌলভীবাজার অঞ্চলে গিয়েছিলাম। সেখানে গেরিলাবাহিনী গঠন ও গেরিলা তৎপরতা শুরু করানোর দায়িত্ব নিয়ে অনেক ঘোরাপথে গিয়েছিলাম। কিন্তু যে পথে গিয়েছিলাম সে পথে ফিরতে পারিনি। বাধ্য হয়েছিলাম ত্রিপুরা রাজ্যে প্রবেশ করতে। সেখানে ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী, তরুণ কমরেড গৌতম দাস প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। ঘটনাচক্রে তখন আগরতলায় এসেছিলেন ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গের সম্পাদক কমরেড প্রমোদ দাসগুপ্তের সঙ্গে। তিনি বললেন,
“নিজেদের শক্তির ওপর ভিত্তি করে আপনাদের যুদ্ধ করতে হবে। অস্ত্র ছাড়া আর সবরকম সাহায্য-সহযোগিতা সিপিএম আপনাদের করবে।“
ত্রিপুরা রাজ্যে আমাদের শুভানুধ্যায়ী ব্যারিস্টার মনসুর আহমেদ ও তার ভাগ্নে ক্যাপ্টেন মাহবুবের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি নির্ভয়পুর ক্যাম্পের দায়িত্বে আছেন। তিনি বললেন, “শিবপুর থেকে পনেরো থেকে কুড়িজনের মতো একটা দল পাঠিয়ে দিন, আমি তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করব।”
তিন
এপ্রিলের শেষ দিকে সম্ভবত তিরিশে এপ্রিল কাদের আর আমি আগরতলা থেকে শিবপুরে ফিরে আসি। শিবপুরে তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন ঘটেনি। তবে নরসিংদীতে তারা শক্তিশালী বসেছে।
আমরা প্রথমেই গেলাম মান্নান ভাইয়ের প্রশিক্ষণ বাহিনী গঠনের পাশাপাশি অস্ত্র সংগ্রহের অভিযান শুরু এপ্রিলের এক-দুই তারিখে ডেমরা থেকে নরসিংদী যাওয়ার পাঁচদোনায় ই.পি.আর. আর রেজিমেন্টের সৈন্যদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অসংগঠিত বাঙালি যোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এই সৈন্যরা নরসিংদী, নবীনগর হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলা পৌঁছান। পথে অনেক অস্ত্র তাঁরা ফেলে যান। এই সব অস্ত্র অনেকেই সংগ্রহ করে। এদের মধ্যে কিছু চোর-ডাকাতও ছিল। মান্নান ভাই জানালেন, এখন এই সব অস্ত্র সংগ্রহের অভিযান শুরু হয়েছে। সব অস্ত্র এক কমান্ডে আনতে হবে। একক কোনো ব্যক্তির কাছে কোনো অস্ত্র রাখা যাবে না।

আমি মান্নান ভাইকে ব্যারিস্টার মনসুর ও ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাথে আলোচনার কথা জানালাম। আরো বললাম, আমাদের উচিত এখনই একটা দল আগরতলায় পাঠানো। ট্রেনিংয়ের সাথে সাথে কিছু অস্ত্র পাওয়ারও সম্ভাবনা থাকবে। তার চেয়ে বড় কথা, আগরতলায় অবস্থিত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে একটা যোগসূত্র স্থাপিত হবে। কৌশলগত কারণে সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
মান্নান ভাইয়ের সাথে আলাপ শেষ করে গেলাম সাখাওয়াৎ ভাইয়ের বাড়ি। ওখানে চপল আর বুলু আছে। ওদেরকে সেই রাতেই নিয়ে যেতে হবে রব খানের বাড়িতে। ওখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা হবে।
বাড়িতে চাল-ডাল যথেষ্ট পরিমাণে আছে। ক্ষেতে শাক-সব্জিরও অভাব নেই। বাড়ির পেছন দিয়ে একটা ছোটো নদী চলে গেছে। কাদের প্রায়ই জেলেদের কাছ থেকে সস্তায় মাছ কেনে। চপল আর বুলু রান্না করে। শিবপুর শহিদ আসাদ কলেজের শিক্ষক আলতাফ প্রায় সারাদিন আমাদের সাথে থাকে। স্কুলশিক্ষক আওলাদ মাঝে মাঝে আসেন। রব খানের বাড়িতে বেশ একটা ভালো আস্তানা গড়ে উঠল। মান্নান ভাই সাংগঠনিক কাজে খুবই ব্যস্ত। তবুও মাঝে মাঝে আমাদের আস্তানায় চলে আসতেন আলোচনা করার জন্য।
শিবপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির পাশাপাশি গ্রামে গ্রামে সংগঠন গড়ে তোলার প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। এলাকায় এলাকায় ছাত্র, কৃষক ও সাধারণ জনগণকে নিয়ে ছোটো ছোটো সভার আয়োজন করা হয়। যদিও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই ইতিমধ্যে দেশ ত্যাগ করেছেন, তবু দুই-একজন যাকে পাওয়া যেত, তাদেরকে সভায় উপস্থিত থাকতে বলা হতো। মান্নান ভাই, তোফাজ্জল হোসেন, আওলাদ, আব্দুল আলী মৃধা, কালা মিয়াসহ আমরা কয়েকজন এই সব বৈঠকে আলোচনা করতাম। আমাদের বক্তব্যে আমরা বলতাম, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য নয়। আমরা চাই সত্যিকার অর্থে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি তাদের খাওয়া-পরার স্বাধীনতা। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার স্বাধীনতা।
ইতিমধ্যে আমাদের প্রতিটি এলাকার সংগঠকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেই এলাকায় কার কার কাছে অস্ত্র আছে, তার তালিকা তৈরি করার জন্য। সেই সব অস্ত্র আস্তে আস্তে সংগ্রহ করা শুরু হয়। অনেকেই স্বেচ্ছায় আমাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। আবার অনেকের কাছ থেকে জোর করেই অস্ত্রগুলো নিতে হয়েছে। মজনু মৃধা একদিন একটা সাব মেশিনগান নিয়ে হাজির। সাথে গুলিভর্তি দুটো ম্যাগাজিনও আছে। তিনি মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ওটা ইপিআর-এর এক হাবিলদারের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। এভাবে আরো কিছু অস্ত্র সংগ্রহ হতে থাকে ।

শিবপুরে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছে, এ খবর আশপাশের এলাকায় বেশ প্রচার হতে থাকে। মনোহরদি, রায়পুরা, কালীগঞ্জ, নরসিংদী- এসব এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধে আগ্রহী লোকজন মান্নান ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। এদের মধ্যে একজন পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সিরাজউদ্দিন আহমেদ। পরে তিনি নেভাল সিরাজ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। নেভাল সিরাজের সাথে প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়।
মজনু মৃধা, ঝিনুক ও মান্নান খানের। পরে মান্নান ভাই ও তোফাজ্জলের সাথে তাঁর দীর্ঘ আলাপ হয়। নেভাল সিরাজ জানান যে, ডেমরা ও পাঁচদোনার যুদ্ধের পর ঐ এলাকা থেকে বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ তিনি সংগ্রহ করেছেন। সে সব অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার হোক এটাই তাঁর কাম্য। তিনি মান্নান ভাইয়ের সাথে সমন্বয় সাধন করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং তাঁর সংগৃহীত অস্ত্রের একটা বড় অংশ শিবপুরে দিয়ে দিতে সম্মত হন।
নেভাল সিরাজের সংগৃহীত অস্ত্রসমূহ ডেমরার কাছে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ডাংগা নামের এক জায়গায় লুকানো ছিল। সিদ্ধান্ত হয় যে, লঞ্চে করে ঐসব অস্ত্র কালীগঞ্জ থানার চরসিন্দুরে আনা হবে। সেখান থেকে সেই সব অস্ত্র শিবপুরে আনার জন্য মোটরসাইকেল করে মান্নান ভাই, আওলাদ হোসেন, ফজলু মেম্বার ও আতিকসহ ছয়জন চরসিন্দুর উপস্থিত হন। কিন্তু তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি থাকায় চরসিন্দুরে অস্ত্র না নামিয়ে ঐ অস্ত্র বোঝাই লঞ্চ হাতিরদিয়া নিয়ে আসা হয় এবং সব অস্ত্র হাতিরদিয়া স্কুলে তোলা হয়।
ডাংগা থেকে যখন লঞ্চ ছাড়ে তখন ঘটনাচক্রে অস্ত্রভর্তি ঐ লঞ্চে হাকিম, হারুন, সাইদুরসহ ছয়জন ইপিআর-এর সদস্য ওঠে। আর নেভাল সিরাজের সাথে ছিল মাত্র একজন সহযোগী। হাতিরদিয়া আসার পর অস্ত্রের মালিকানা নিয়ে নেভাল সিরাজের সাথে হাকিমের বিরোধ দেখা দেয়। হাকিমের বক্তব্য, যেহেতু অস্ত্রগুলো ইপিআর-এর সুতরাং তারাই ঐ অস্ত্রের মালিক। শেষ পর্যন্ত মান্নান ভাইয়ের মাধ্যমে একটা সমঝোতা হয়। মান্নান ভাই নেভাল সিরাজ ও হাকিমের দলকে একত্রে মনোহরদি থানার চালকচরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করার দায়িত্ব দেন। আমরা দুটো হালকা মেশিনগান ও ছয়টা রাইফেল নিয়ে শিবপুরে ফিরে আসি।
সার্বিক যুদ্ধের পরিকল্পনা ও চালচরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনার জন্য হাকিম, হারুন, সাইদুরসহ পাঁচ-ছয়জন শিবপুরে আসেন। ওদের সাথে মান্নান ভাই, তোফাজ্জল, কালা মিয়া, মজনু মৃধাসহ আরো কয়েকজন আলোচনায় বসেন। আলোচনার পর হাকিম আর তার লোকজন শিবপুর বাজারেই থেকে যায়। মান্নান ভাই তোফাজ্জলকে নিয়ে চলে যান নদীর ওপারে গফুরের বাড়িতে।
সে রাতেই শিবপুরে আর্মির তিনটা গাড়ি আসে। গাড়ির শব্দ পেয়ে মান্নান ভাই রব খানের বাড়িসহ আরো কয়েক জায়গায় খবর পাঠান সতর্ক করার জন্য।
আর্মির গাড়িগুলো চক্রধা গ্রামে ঢুকে প্রথমে যায় রফিক ডাকাতের বাড়ি। সেখানে কাউকে না পেয়ে আসে রব খানের বাড়ি। প্রথমে রফিক ডাকাতের বাড়িতে যাওয়ার ফলে যে সময়টুকু নষ্ট হয়, তাতেই আমরা রক্ষা পেয়ে যাই। কোনো বাড়িতেই কাউকে না পেয়ে আর্মির গাড়িগুলো যখন ফিরে যাচ্ছিল, তখন বান্ধাইদা ব্রিজের কাছে মজনু মৃধা আর হারুন যৌথভাবে আর্মির গাড়ির ওপর আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা গুরুতরভাবে আহত হয়। তারা বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। আমাদের পক্ষ থেকে গোলাগুলি বন্ধ করা হলেও পাকিস্তানি বাহিনী সারা রাত গুলি চালাতে থাকে।
খন্দকার মমতাজউদ্দিন নামে বিমানবাহিনীর একজন প্রাক্তন সদস্য শিবপুর বাজারে ঘোরাঘুরি করত। তার কিছুটা মস্তিষ্কবিকৃতি ছিল। প্রায়ই সে বাজারের উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানকে গালাগালি করে ইংরেজিতে বক্তৃতা দিত। ঘটনার পরদিন ভোরে সে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে গিয়ে ইংরেজিতে চিৎকার করে বলতে থাকে, ব্লাডি পাকিস্তানি, তোমরা এত গোলাগুলি করছ কেন? গুলির শব্দে সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি।

তখন কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তাকে গাছের সাথে বেঁধে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। রব খানের বাড়িতে আর্মি আসার পর ওখানকার আস্তানা গুটিয়ে ফেলা হয়।
এইরকম এক সময়ে আমাদের পার্টির অন্যতম নেতা মাহফুজ ভুইয়ার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। তার বড় ভাই মাহমুদ ভাই খবর পাঠিয়েছেন, তাদের এলাকায় (কিশোরগঞ্জে) কয়েকজন সশস্ত্র ডাকাত খুব লুটপাট করছে। আর স্থানীয়ভাবে কিছু পাকিস্তানি দালালও জনগণের ওপর খুব অত্যাচার করছে। এমনকি গ্রামের মেয়েদের ধরে ধরে আর্মির ক্যাম্পে দিয়ে আসছে। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, শিবপুর থেকে একটা দল কটিয়াদিতে পাঠানো হবে।
মাহফুজ ভাইয়ের সাথে মজনু মৃধা, মজিবুর রহমান, কনক খান, হযরত আলী, আব্দুল কাদিরসহ দশজনের একটা দল কটিয়াদিতে পাঠানো হয়। এই দলটা প্রথমে মাহমুদ ভাইয়ের বাড়িতে গোপনে অবস্থান নেয়। তারপর একদিন খুব ভোরে অতর্কিতে কুখ্যাত রহমান ডাকাতের ঘাঁটি আক্রমণ করে। এই আক্রমণ যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল কারণ ডাকাতদের হাতেও যথেষ্ট অস্ত্র ছিল। কিছুক্ষণ গোলাগুলির পর রহমান ডাকাত তার সাত সহযোগীসহ ধরা পড়ে। এদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ছিল।
উল্লসিত জনতা ডাকাতদের ঘাঁটি থেকে লুট করা সব মালামাল উদ্ধার করে। পরে প্রমাণ সাপেক্ষে যার যার জিনিস তার তার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের দল
শুধু উদ্ধারকৃত অস্ত্রগুলো নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। এই ঘটনার পর গ্রামবাসীদের নিয়ে একটা সভার আয়োজন করা হয়। জনতার আদালতে রহমান ডাকাতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় এবং তা কার্যকর করা হয়।
এর দু’দিন পরেই রাজাকার ও শান্তি কমিটির একটা ঘাঁটি আক্রমণ করে সেটা ধ্বংস করা হয়। সেখান থেকেও কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে দল গড়ার জন্য মাহফুজ ভাইয়ের কাছে কিছু অস্ত্র রেখে বাকি অস্ত্র নিয়ে আমাদের দলটা শিবপুরে ফিরে আসে। মাহফুজ ভাই নিজের এলাকায় কিছুদিন থেকে পরে মেঘালয় চলে যান এবং মুক্তিবাহিনীর পাঁচ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন।
চার
মে মাসের মাঝামাঝি সম্ভবত ১৩ মে মান্নান খানের নেতৃত্বে তেরোজনের একটা দল আগরতলায় পাঠানো হয়। এই দলের সদস্য ছিল রশিদ মোল্লা, সেন্টু, নুরুল ইসলাম কাঞ্চন, গফুর, ঝিনুক, আব্দুল আলী মৃধা, চানমিয়া, বাদল, শাখাওয়াত প্রমুখ। এদের পথপ্রদর্শক হিসেবে থাকে কাজী গোফরান। দলটা নবীনগর পার হওয়ার পর যখন সিঅ্যান্ডবি রাস্তায় এসে পৌঁছায়, তখন হঠাৎ করে পাকিস্তানি টহলদার বাহিনী এসে হাজির হয় এবং গোলাগুলি শুরু করে। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের দলের কোনো ক্ষতি হয় না। ওরা কসবার কাছে একটা রেলসেতুর নিচ দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে। দলটা প্রথমে গিয়ে ওঠে মতিনগর ক্যাম্পে। মতিনগরে এক রাত থাকার পর ওদেরকে পাঠানো হয় নির্ভয়পুর ক্যাম্পে। এ ব্যবস্থা ব্যারিস্টার মনসুর করে দেন।
ক্যাপ্টেন মাহবুবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে আমাদের ছেলেরা প্রশিক্ষণ পেতে থাকে। ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য ছেলেদের দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করিয়ে ছোটোখাটো অপারেশনও করানো হয়। এইভাবে ছেলেরা অল্প সময়েই গেরিলা কায়দা কানুনে বেশ রপ্ত হয়ে উঠতে থাকে।
জুন মাসের প্রথম দিকে আমি আর একটা দল নিয়ে আগরতলায় যাই। এই দলে মিলন, ফজলু, মানিক, হান্নান ভূঁইয়া, আফসার উদ্দিন, সিরাজুল হক, সাউদ, হাবিবুর রহমান, কাদিরসহ মোট বারোজন সদস্য ছিল। আমরা সবাই প্রথমে যশোর বাজারে মিলিত হই। যশোর বাজার শিবপুরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। পাশেই নদী। নদী পার হলেই রায়পুরা। রাতের অন্ধকারে আমরা রায়পুরা পৌঁছলাম। সেই রাতটা আব্দুল হাই ফরাজীর বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে রওনা দিলাম নবীনগরের পথে। পুরো পথটাই হেঁটে যেতে হলো।
নবীনগরের কয়েক মাইল আগে লোকজনের কাছে শুনলাম, ওখানে কয়েকজন দালাল খুব সক্রিয় রয়েছে। তারা ভারতগামী শরণার্থীদের লুটপাট করে। মহিলাদের ধরে নিয়ে অত্যাচার করে। আর মুক্তিবাহিনীর লোক সন্দেহ হলে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আপাতত আমাদের কিছু করার নেই। নবীনগরের ওপর দিয়ে সরাসরি না গিয়ে বেশ কিছুটা ঘোরাপথে সীমান্ত পার হলাম। আগরতলা পৌঁছে আমরা সরাসরি চলে গেলাম নির্ভয়পুর ক্যাম্পে।

ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাথে আবার দেখা হলো। তিনি শিবপুরের ছেলেদের খুব প্রশংসা করলেন। ছেলেরা সাহসী পরিশ্রমী। মান্নান খানের নেতৃত্বে দলটা এসেছে তাদের প্রশিক্ষণের কাজ ভালোই চলছে। দলনেতা হিসেবে মান্নান খান যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
ক্যাপ্টেন মাহবুব আমাকে বললেন, আপনাদের এই নতুন দলটাকে একটা শর্ট কোর্স ট্রেনিং দেবো। আপনি দিন পনেরো পরে এসে দুই দলকে এক সাথে নিয়ে যাবেন। আমি বললাম, আমাদের জন্য কিছু অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। একটু মৃদু হেসে তিনি বললেন, আচ্ছা ব্যবস্থা হবে।
মনসুর ভাইয়ের সাথে প্রায় প্রত্যেক দিনই দেখা হচ্ছে। তাঁর সাথে একদিন মেলাঘর ক্যাম্পে গেলাম। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে মেজর খালেদ মোশাররফের দেখা পেয়ে গেলাম। তিনি খুবই ব্যস্ত। অল্প সময়ের জন্য আলাপের সুযোগ হলো। তাঁকে সংক্ষেপে শিবপুরের অবস্থা বর্ণনা করে বললাম, আমাদের কিছু অস্ত্র প্রয়োজন। তিনি আশ্বাস দিলেন, আমাদের জন্য অস্ত্রের ব্যবস্থা তিনি করবেন। তারপর বললেন, আমি জানি, এই ক্যাম্পে তোমাদের দলের অনেক ছেলে আছে। তাদের চুপচাপ ট্রেনিং নিতে বলো। আর তুমি নিজে এই ক্যাম্পে আর এসো না। ব্যারিস্টার মনসুরের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখো।
ক্যাম্পে মেনন ভাইয়ের ছোটো ভাই শহিদুল্লাহ খান বাদল ও রুমির সাথে দেখা হলো। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী। সে ছিল কলেজের বর্ষের ছাত্র। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে সে আমাদের বাসায় এসেছিল। তারপর এই আবার দেখা। পরবর্তীকালে সে ঢাকায় অনেকগুলি বীরত্বপূর্ণ গেরিলা অ্যাকশন করেছিল। একসময় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
রুমী দুই-একদিন আগেই মেলাঘরে এসেছে। বাদল অবশ্য বেশ আগে থেকেই মেলাঘরে আছে। সে ক্যাপ্টেন হায়দারের সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। মেলাঘর ক্যাম্পে বাদল বামপন্থী ছাত্র ও কর্মীদের ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য সহযোগিতা করে। এই অপরাধে পরবর্তীকালে তাকে তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
ফেরার পথে মনসুর ভাই আমাকে কয়েকটা মুক্তিযোদ্ধার পাস দিয়ে বললেন, এগুলো সাথে রাখো। কাজে লাগবে। এখানকার প্রশাসন ও অনেক সামরিক কর্মকর্তাই বামদের ব্যাপারে বেশ স্পর্শকাতর। আগরতলায় এসে সিপিআই (এম)-এর নেতা কমরেড নৃপেন চক্রবর্তীর কাছ
থেকে শুনলাম, কলকাতায় বামপন্থীরা মিলিত হয়ে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করেছেন। জুন মাসের মাঝামাঝি মনসুর ভাইয়ের সাথে নির্ভয়পুর ক্যাম্পে গেলাম। গিয়ে দেখি সেদিন সকালেই শিবপুর থেকে আরো বারোজনের একটা দল এসে হাজির হয়েছে। এই দলে রয়েছে নুরুল হক, জসীমউদ্দিন, সুলতানউদ্দিন, মাহবুব মোর্শেদ, রমিজউদ্দিন, আকিল, গিয়াসউদ্দিন, ফজলুল হক, সাহাবউদ্দিন, হিরা মিয়া প্রমুখ।

নির্ভয়পুর ক্যাম্পটা ছোট। আগের ছেলেরাই সব গাদাগাদি করে থাকে। তার মধ্যে এই নতুন দল এসে পড়ায় এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাথে মনসুর ভাই, মান্নান খান ও আমি আলোচনায় বসলাম। সিদ্ধান্ত হলো, মান্নান খান, আব্দুল আলী মৃধা, রশিদ মোল্লা, কাঞ্চনসহ সাতজনকে মেলাঘর ক্যাম্পে পাঠানো হবে। এই পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া। এদেরকে মেলাঘর ক্যাম্পে ঢোকানোর দায়িত্ব নিলেন মনসুর ভাই। বাকি আঠারোজনকে নিয়ে আমি শিবপুর ফিরে যাবো। আর নুরুল হকের নেতৃত্বে যে দলটা এসেছে তারা পনেরো দিনের ট্রেনিং নিয়ে শিবপুর ফিরে আসবে।
আগের পঁচিশজনের সাথে আজ যোগ হয়েছে আরো বারোজন। ছোট ক্যাম্প। হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। যারা নতুন এসেছে তাদের কাছ থেকে শিবপুরের শেষ অবস্থা জানলাম। এখন পর্যন্ত শিবপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প বসেনি। কিন্তু আর্মির গাড়ি ঘন ঘন শিবপুরে আসছে। তবে বড় কোনো সংঘর্ষ ঘটেনি।
আমরা পরদিন সকালে রওনা হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ক্যাপ্টেন মাহবুব বললেন, আমি ট্রাকের ব্যবস্থা করেছি। আপনারা আজ রাতেই চলে যান।
রাত বারোটার দিকে শিবপুর ফিরে যাওয়ার দলটাকে জড়ো করা হলো। হান্নান, ঝিনুক, গফুর, সেন্টু, মিলন, ফজলু, মানিক, আফসার উদ্দিন, বাদল, চান মিয়া, সাখাওয়াত, সিরাজুল হক, সাউদ, হাফিজুর রহমান, কাদিরসহ মোট আঠারোজন। আমাকে নিয়ে উনিশজন। ক্যাপ্টেন মাহবুব একটা ছোটোখাটো বিদায়ী ভাষণ দিয়ে শেষে বললেন, তোমাদের যে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, বাস্তব যুদ্ধ তার চেয়ে অনেক কঠিন। তোমরা সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা নও। তোমরা রাজনীতি সচেতন মুক্তিযোদ্ধা। এলাকায় ফিরে গিয়ে তোমরা তোমাদের নেতাদের নির্দেশ অনুসারে কাজ করবে। আমি তোমাদের সাফল্য কামনা করি।
রওনা হওয়ার আগে ক্যাপ্টেন মাহবুব আমাদেরকে তিনটা স্টেনগান, দুই বাক্স গুলি, আটটা অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন, পঁচিশটা হ্যান্ড গ্রেনেড, দুই-তিন পাউন্ড পিকে বিস্ফোরক ও চার-পাঁচ ফুট ফিউজ দিলেন। ক্যাপ্টেন মাহবুবকে আমাদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ট্রাকে উঠলাম। অন্ধকারে মনে হলো কয়েকজন চোখ মুছছে।
রাত তিনটার দিকে ট্রাকচালক আমাদের সীমান্তের কাছাকাছি একটা গ্রামে নামিয়ে দিলো। চারদিকে অন্ধকার। কোনো লোকজন নেই। এত রাতে সীমান্ত পার হওয়া কি ঠিক হবে? তাছাড়া যে এলাকায় আমাদের নামানো হয়েছে, সে এলাকা আমাদের পরিচিত নয়। সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে খোঁজখবর না নিয়ে গেলে বিপদ হতে পারে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, এখন সীমান্ত পার হওয়া যাবে না। সকাল হলে এলাকার লোকজনের সাথে আলাপ করতে হবে। তারপর ঠিক করব কীভাবে সীমান্ত পার হবো। আপাতত বিশ্রামের দরকার। একটা পুকুরপাড়ে গিয়ে সবাই বসলাম।

যদিও ভারতের মধ্যে, তবুও প্রকাশ্য জায়গায় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসে থাকার বিপদ আছে। সীমান্তের ওপারে খবর হয়ে যেতে পারে যে, মুক্তিযোদ্ধারা ভিতরে ঢুকছে। ফলে ওত পেতে থাকা শত্রুর ফাঁদে আটকে যেতে পারি। তাই দিনের জন্য একটা আশ্রয় দরকার।
ভোর হতে শুরু করেছে। দুই-একজন লোকের দেখা পেলাম। তাদের কাছ থেকে শরণার্থী ক্যাম্পের সন্ধান পাওয়া গেল। ঠিক করলাম দুপুর পর্যন্ত ওখানেই থাকব। শরণার্থী ক্যাম্পের দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় এক নেতা গোছের লোক। এত ভোরে তাকে ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য একটু বিরক্তই হলেন। তারপর আমাদের জেরা শুরু করে দিলেন- কোথা থেকে আসছি? কোন ক্যাম্পে ট্রেনিং হয়েছে? বাংলাদেশে ফেরার অনুমতি আছে তো? ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার কাছে মনসুর ভাইয়ের দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের পাস ছিল। সেটা দেখিয়ে বললাম, এর বেশি আপনাকে আর কিছু দেখানো যাবে না, বলাও যাবে না। এসব গোপনীয় ব্যাপার। আপনার আপত্তি থাকলে আমরা এখনই বর্ডার পার হওয়ার চেষ্টা করব। তবে আমরা যে আপনার সহযোগিতা পেলাম না, সেটা জায়গামতো অবশ্যই রিপোর্ট করব।
ভদ্রলোক একটু নরম হলেন। আমাদের জন্য একটা ঘরের ব্যবস্থা হলো। সাউদ আর ফজলুকে পাঠানো হলো সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করতে। কাঠাল আর মুড়ি সবাই পেট ভরে খেলাম। দুপুরের জন্য এক দোকানের সাথে ব্যবস্থা হলো। পথের জন্য কিছু চিড়া আর গুড় কিনে নিলাম।
দুপুর পর্যন্ত সবাই পালা করে বিশ্রাম নিলাম। তারপর খেয়ে দেয়ে রওনা হওয়ার পালা। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে কিছু কিছু খোঁজখবর নিয়েছি। প্রথমে রেললাইন পার হতে হবে। তারপর ছোটো-বড় কয়েকটা টিলা পার হয়ে সিএন্ডবি রাস্তা। রাস্তায় সারাদিন আর্মির গাড়ি টহল দেয়। রেললাইনেও মাঝে মাঝে আমি আসে। পথে কয়েক জায়গায় বাংকার আছে।
বিকাল তিনটা। সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছি। অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন, গুলির বাক্স আর গ্রেনেডগুলো সবার মধ্যে ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। মাইনগুলো বেশ ভারি। হাত থেকে পড়ে গেলে বা জোরে ধাক্কা লাগলে ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই খুব সাবধানে নিতে হবে। আমাদের মধ্যে ফজলুই সবচেয়ে দুর্বল। তবু মনোবলের অভাব নেই। ও নিজেই একটা মাইন তুলে নিয়েছে। তিনটা স্টেনের একটা আমার কাছে, বাকি দুটো মিলন ও ঝিনুকের হাতে।
মূল দল থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ আগে আগে চলেছে গফুর আর সাউদ। ওরা কিছুদূর গিয়ে গিয়ে থামছে। তারপর চারদিক ভালো করে দেখে আবার আমাদের চলার নির্দেশ দিচ্ছে। এভাবে এগোতে এগোতে আমরা রেললাইনের কাছাকাছি চলে এলাম। আর মাত্র বিশ-পঁচিশ গজ বাকি।
আর না এগিয়ে আমরা একটা বাঁশঝাড়ের মধ্যে জড়ো হলাম। রেললাইনটা প্রায় আট-নয় ফুট উঁচুতে অবস্থিত। ওপারের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কাদির গাছে চড়তে বেশ পটু। কাছেই একটা মাঝারি আকারের কাঁঠালগাছ ছিল। কাদিরকে তাতেই চড়ানো হলো রেললাইনের ওপারের অবস্থা দেখার জন্য। ও জানাল ওপারে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ছে না। তবুও খুব সাবধানে রেললাইন পার হতে হবে। কিছু বলা তো যায় না।।।
আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, চারজন করে এক এক বারে পার হবো। প্রথম দল পার হয়েই রেললাইন থেকে কমপক্ষে ত্রিশ-চল্লিশ গজ দূরে গিয়ে অবস্থান নেবে। পরবর্তী দল পার হওয়ার সময় কোনো বিপদ হলে তাদের সাহায্য করবে। একটা দল পার হওয়ার দশ মিনিট পরে পরের দল রওনা হবে।

প্রথম দলে থাকল মিলন। ওরা হামাগুড়ি দিয়ে রেললাইন পার হয়ে ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। দশ মিনিট পরে দ্বিতীয় দল। আরো দশ মিনিট পরে তৃতীয় দল পার হলো। সব শেষে পার হলাম আমি, হান্নান, ঝিনুকসহ সাতজন।
সবাই নির্বিঘ্নে রেললাইন পার হলাম। ইতিমধ্যে দেখি মিলন আর গফুর গ্রামের দু’জন লোকের সাথে বেশ জমিয়ে নিয়েছে। জানা গেল সিএন্ডবি রাস্তা ওখান থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে। পথে ছোটো-বড় কয়েকটা টিলা পার হতে হবে। এই এলাকায় বসতি একেবারে নেই বললেই চলে। লোক দু’জন আরো জানাল, সকাল থেকে বেশ কয়েকবার আর্মির গাড়ি সিএন্ডবি রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছে। তবে বাংকারের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে কোনো খবর ওরা দিতে পারল না।
ওদের অনুরোধ করলাম রাস্তা পর্যন্ত আমাদের পৌঁছে দিতে। কিন্তু ওরা কিছুতেই রাজি হলো না। প্রায় পাঁচটা বাজতে চলেছে। সন্ধ্যার আগেই সিএন্ডবি রাস্তা পার হয়ে গ্রামে ঢুকে যেতে হবে। আবার সবাই তৈরি। গোনা হলো। আমাকে নিয়ে উনিশজন। সামনের রাস্তা বেশি প্রশস্ত না। পায়ে হাঁটা পথ। পাশাপাশি দুইজন করে চলেছি।
হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে রাস্তা পিচ্ছিল করে দিলো। পা টিপে টিপে হাঁটতে হচ্ছে। এত পিচ্ছিল পথে আমার হাঁটার অভ্যাস নেই। তাই প্রথম আছাড়টা আমিই খেলাম। অল্প পরে ফজলু পিছলে পড়তে পড়তে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিল। ফজলুকে খুবই পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল। আমি সাউদকে ডেকে ওর কাছ থেকে মাইনটা নিতে বললাম।
না, না। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। মাইনটা আমি ঠিকই নিয়ে যেতে পারব। ফজলু প্রতিবাদ করতে থাকে।
তবু অনেকটা জোর করেই সাউদ ওর কাছ থেকে মাইনটা নিয়ে নিল। আমরা ছোটো একটা টিলা পার হলাম। সামনে ধানক্ষেত। তারপর অপেক্ষাকৃত বড় একটা টিলা। ধানক্ষেত পার হয়ে টিলায় উঠতে শুরু করলাম। পিচ্ছিল পথে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। উপরে উঠে দেখি বেশ কিছুটা সমান জায়গা। দশ বারোটা কাঁঠালগাছও আছে। একটা গাছের তলায় বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।
এবার টিলা থেকে নামতে হবে। বৃষ্টিতে ভেজা এঁটেল মাটি। খুব সাবধানে একজন একজন করে নামতে শুরু করেছি। এমন সময় হঠাৎ নিচ থেকে শুরু হয়ে গেলো মেশিনগানের গুলি। তখনই দেখতে পেলাম নিচের বাংকারটা। কোনোমতে হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম। উপরে উঠে দেখি এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। হান্নান তো প্রায় পাগলের মতো চিল্লাচ্ছে।

বহু কষ্টে টেনে হেঁচড়ে দলটাকে একটা বড় কাঁঠালগাছের পেছনে জড়ো করা হলো। ঝিনুক, সাউদ, মিলন আর আমি বাংকারের অবস্থান দেখার জন্য নিচু হয়ে এগিয়ে গেলাম। একটা মোটা গাছের আড়াল থেকে নিচে তাকিয়ে দেখি, একদল সৈন্য ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠে আসছে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। আজ ফিরে যেতে হবে। সবাইকে বলা হলো টিলা থেকে নেমে ধানক্ষেতের মধ্যে আশ্রয় নিতে। আমি আর ঝিনুক দুটো গ্রেনেডের পিন খুললাম। প্রথমে ঝিনুক গ্রেনেডটা ঢাল বেয়ে উঠে আসা আর্মির দিকে গড়িয়ে দিলো। তার কয়েক সেকেন্ড পরে আমারটা। একটু পরেই অল্প বিরতিতে দুটো গ্রেনেড ফাটার শব্দ পাওয়া গেলো।
আমি আর ঝিনুক দৌড়ে কাঁঠালগাছের কাছে ফিরে এলাম। মিলন আর সাউদ আগেই ওখানে পৌঁছে গেছে। বাকি সবাই নেমে যাচ্ছে। আমরাও নামতে শুরু করলাম। ইতিমধ্যে দেখি টিলার উপরে দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলা ফাটতে শুরু করেছে। গোলাগুলো আসছে টিলার ডান-বাম দুই দিক থেকেই।
আমরা সবাই ধানক্ষেতের মধ্যে শুয়ে। কোনো কথা নেই। কোনো নড়াচড়া নেই। টিলার ওপারে সূর্য ডুবে গেছে। ইতিমধ্যে তিনদিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে টিলার ওপর অবস্থান নিয়েছে। ধানক্ষেতের ওপর অন্ধকার নেমে এসেছে। তাই আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু টিলার ওপরে ওদের চলাফেরা ছায়ার মতো দেখতে পাচ্ছি।
ধানক্ষেতে প্রায় আধাঘণ্টা শুয়ে থাকলাম। বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে সবাইকে জড়ো করা হলো। ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি। সবাই ঠিক আছে তো? আমাকে নিয়ে আঠারোজন। আঠারো কেন? উনিশ হবে। আবার শুনলাম। আঠারোজন। কে নেই? এক এক করে সবার নাম ডাকা হলো। হান্নানকে পাওয়া গেল না। তবে কি হান্নান ধরা পড়ল?
বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। পথ আরো পিচ্ছিল। চারদিকে অন্ধকার। এরই মধ্যে বহু কষ্টে আবার ফিরে এলাম ভারতের মাটিতে। সবাই পরিশ্রান্ত ও বিধ্বস্ত। হান্নানকে নিয়েও কম দুশ্চিন্তা নয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। খোঁজ করারও কোনো উপায় নেই। আবার ফিরে গেলাম সেই শরণার্থী কেন্দ্রে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তিটি ঘুমিয়ে ছিলেন। তাঁকে ঘুম থেকে তোলার দুঃখ প্রকাশ আমাদের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে বোধ হয় ভদ্রলোকের একটু করুণা হলো। তিনি আবারও রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।
পরদিন বিকেলে আবার সীমান্ত পার হলাম। এবার অনেক ঘোরাপথে চলেছি। সাথে একজন গাইড আছে। স্থানীয় লোক। পনেরো মাইল মতো হাঁটতে হবে। বাকি পথ নৌকায়। প্রায় দু’দিনের মতো লাগল যশোর বাজার পৌঁছাতে।

বাজারে শহীদ আর ইয়াসিন বসে ছিল। নৌকা থেকে আমাদের নামতে দেখেই দৌড়ে এলো। শহীদ একে একে সবাইকে জড়িয়ে ধরল। তারপর জানতে চাইল আমাদের সবাই ঠিক মতো ফিরে এসেছে কি না। আমরা হান্নানের হারিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই শহীদ হাসতে হাসতে বলল, হান্নান তো কাল সকালেই ফিরে এসেছে। আসার পর থেকে শুধুই হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে, পাকিস্তানি আর্মি সবাইকে মেরে ফেলেছে। আজ সকালেই হান্নানকে মান্নান ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যশোর বাজারে সে রাতে একটা ভূরিভোজের ব্যবস্থা হলো। মনে হলো, অনেকদিন পরে পরিচিত রান্নার স্বাদ পেলাম।
পাঁচ
জুন মাসের মাঝামাঝি থেকেই শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে ভাগ করে দেওয়া হয়। জয়নগর, কামরাবো, কোদালকাটা, ইটান প্রভৃতি জায়গায় আমরা ক্যাম্প বসাই। ক্যাম্প বলতে তাঁবু খাটানো ক্যাম্প নয়। একটা দুটো মাটির ঘরই আমাদের ক্যাম্প। দড়িপুরায় মহির ট্যাকে একটা ট্রেনিং সেন্টার খোলা হলো। দায়িত্বে আছে ইয়াসিন ও সিরাজ। ওরা দুজনেই পাকিস্তানি আর্মিতে ছিল।
শিবপুরের উত্তর অঞ্চল একটু উঁচু। বেশ বড় বড় টিলা আছে। বর্ষার সময় এই সব টিলার চারদিকে পানি থাকে। নৌকা ছাড়া যাওয়ার কোনো উপায় নেই। বিলশরণ গ্রামের এরকম একটা টিলার উপর খালেকের বাড়ি। জায়গাটা খালেকের ট্যাক নামে পরিচিত। সেখানেই আমাদের হেড কোয়ার্টার। হেড কোয়ার্টার যে সব সময়ই খালেকের ট্যাকে ছিল তা নয়, মাঝে মাঝে অন্যান্য জায়গাতেও হেড কোয়ার্টার সরিয়ে নেওয়া হতো।
যুদ্ধের শেষের দিকে কামরাবোতে হেড কোয়ার্টার স্থানান্তরিত করা হয়। মান্নান ভাই বেশির ভাগ সময় হেড কোয়ার্টারেই থাকেন। মান্নান ভাইয়ের সাথে সব সময় থাকে তোফাজ্জল হোসেন আর তোফাজ্জল হোসেন ভূঁইয়া। আমি মাঝে মাঝে হেড কোয়ার্টারে থাকি। অন্য সময় বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে থাকতে হয়।
জুন মাসের শেষ দিকে মোস্তফা জামাল হায়দার শিবপুরে এসে উপস্থিত। পঁচিশে মার্চ জামাল ভাই দিনাজপুরে ছিলেন। শিবপুরে আসার পরে জামাল ভাই মান্নান ভাইয়ের সাথে হেড কোয়ার্টারে থাকতে শুরু করেন। হেড কোয়ার্টারে আরো একজন থাকতেন। তিনি রমিজ ডাক্তার। আমাদের মেডিকেল টিমের প্রধান।
রমিজ ডাক্তার লোকটা বেশ দায়িত্বশীল। এক ক্যাম্প থেকে আর এক ক্যাম্পে গিয়ে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করছেন। কোনো ক্লান্তি নেই। রমিজ ডাক্তারের সহকারী হিসেবে কাজ করছে জামালউদ্দিন। শেখ কাদেরকে ঢাকা পাঠিয়ে ডা. আজিজের কাছ থেকে ছোটখাটো অপারেশনের যন্ত্রপাতি, গজ, ব্যান্ডেজ ও ওষুধপত্র আনা হয়েছে। এ ব্যাপারে শিবপুরের থানা চিকিৎসা কেন্দ্র থেকেও যথেষ্ট সাহায্য পাওয়া গেছে।
রমিজ ডাক্তার বেশ আলাপী লোক। অবসর সময়ে রমিজ ডাক্তার আমাদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমি কমিউনিস্ট না। কিন্তু আপনাদেরকে আমার ভালোই লাগে।
ক্যাম্পগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দিন বাড়ছে। ট্রেনিং সেন্টারেও নতুন লোক আসছে। ক্যাম্পগুলোতে খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট। বেশির ভাগ দিনই আমরা ভালোভাবে খেতে পেতাম মরিচ ভর্তা আর শুটকি ভর্তা খেতে খেতে অনেকেই আমাশয়ে আক্রান্ত হয়। অনেকেরই একটার বেশি লুঙ্গি, গামছা নেই। তেল-সাবানের ব্যবস্থা কদাচিৎ যায়।
ক্যাম্পে ক্যাম্পে খাবার অন্যান্য জিনিসের সঙ্কট, কিন্তু মান্নান ভাইয়ের কঠোর নির্দেশ, কোনো ক্যাম্প থেকে কোনো ধরনের নেওয়া চাল-ডাল অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করা যাবে না। কেন্দ্রীয়ভাবেই জিনিসপত্র সংগ্রহ হয়। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন রব খান, বসিরুদ্দিন খান, তোফাজ্জল হোসেন, তোফাজ্জল ভূঁইয়া, কালা মিয়া, শহীদুল ইসলাম, খালেক, নুরুল ইসলাম, বাতেন ফকির, রণজিৎ, প্রমুখ।
শিবপুর ঘন ঘন আমি আসতে করেছে। বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল বস্তুত এসব এলাকায় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের মুক্তিবাহিনী। ছোটোখাটো বিচার-আচার স্থানীয়ভাবেই হচ্ছে। কোনো সমস্যা দিলে হেড কোয়ার্টার থেকে মান্নান ভাই কাউকে পাঠিয়ে সমাধান করেন। শিবপুর যখন আমি আসত, সময়টা অন্য সব সময়ই সদরে আমাদের অবাধ যাতায়াত।
ছয়
নরসিংদী পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি। সেখান থেকেই তারা শিবপুর আসত। নরসিংদী-শিবপুর রাস্তার উপর পুটিয়া বাজারের পাশে ব্রিজ ছিল। ব্রিজটা যদি ধ্বংস যায়, তবে পাকিস্তানি বাহিনীর ঘন শিবপুরে আসা একটু কষ্টকর হবে। পুটিয়া ব্রিজ ধ্বংসের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেটা আগস্ট মাসের প্রথম দিকের এক সময়।
রাত প্রায় তিনটা। একটা গোয়ালঘরের মজনু মৃধা আর আমি আছি। থেকে ব্রিজটা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। ব্রিজটি ত্রিশ গজ মতো লম্বা। একটা নদী। আমাদের অবস্থান ব্রিজের উত্তর দিকে। ঝিনুক, আমজাদ, মিলন, ফজলু, বেণু, আফতাব, ইয়াসিন আর অন্যান্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সব মিলিয়ে আঠারোজন।
দু’দিন আগে মান্নান মজনু মৃধা, তোফাজ্জল আমি বসেছিলাম যোদ্ধা বাছাই করতে। অভিযানে নেওয়ার জন্য সবারই আগ্রহ। কাকে রেখে কাকে সে এক বিরাট সমস্যা। কষ্টে বুঝানো গেল, তো সবে শুরু। সামনে আরো আছে। প্রাথমিকভাবে দল ঠিক হয়েছিল, তাতে ফজলু না। কথা জানতে ওর সে কি করুণ আকুতি, দলে রাখতেই হবে। পর্যন্ত বাধ্য হয়েই ওকে নেওয়া হলো।

আমরা পাঁচটার দিকে ব্রিজটা উড়াব। আপনি ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিতে পারেন, জেগে আছি। মজনু আমাকে বললেন। কী বলেন মজনু মামু? এই টেনশনের মধ্যে কি ঘুমানো যায়। আমি বরং মিলনকে নিয়ে একটু জায়গাটা ঘুরে দেখি। ফেরার রাস্তাটা আমাদের চেনা থাকা দরকার।
ছেলেরা সবাই বেশ উত্তেজিত। প্রথম অ্যাকশন। যুদ্ধের প্রথম স্বাদ। আনন্দ, ভয়, উদ্বেগ আর উত্তেজনার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। এখানে আসার আগে সবাইকে ব্রিফিং দেওয়া হয়েছে। ব্রিজ উড়ানোর দায়িত্ব আমার আর ঝিনুকের। তারপর অপেক্ষার পালা। পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রিজের দিকে এগোতে থাকলেই আমরা এপার থেকে আক্রমণ চালাব। সার্বিক নেতৃত্ব দেবেন মজনু মৃধা। সাড়ে চারটার দিকে মজনু মৃধার কাছে ফিরে এলাম। দেখি একই জায়গায় ঠায় বসে আছেন।
জুনো ভাই, চলেন কাজে নামা যাক। অন্ধকার তো ফিকে হতে চলেছে। শিবপুরের ছেলেরা সবাই মজনু মৃধাকে মজনু মামু বলে ডাকে। আমিও ডাকি। কিন্তু মজনু মৃধা আমাকে আবার জুনো ভাই বলতেন।
আমাদের অস্ত্রের মধ্যে আছে পনেরোটা থ্রি নট থ্রি রাইফেল, একটা এলএমজি ও দুটো স্টেন। ব্রিজ উড়ানোর জন্য একটা অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন, কয়েকটা গ্রেনেড, কিছু পিকে ও ফিউজ। অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইনের উপর চাপ পড়লেই সেটা বিস্ফোরিত হয়। তাই এটা দিয়ে ব্রিজ উড়ানো সহজ নয়। কিন্তু কী করা। এর চেয়ে কার্যকর বিস্ফোরক তো আমাদের কাছে নেই। অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইনের উপরের মুখটা খুলে ফেললাম। সেখানে কিছু পিকে ঢুকিয়ে দেড় ফুট লম্বা একটা ফিউজ আটকালাম। পুরো মাইনটা ব্রিজের নিচের দিকে একটা পিলারের উপর বসালাম।
দেড় ফুট লম্বা ফিউজ পুড়তে কতক্ষণ লাগবে? এক মিনিট? দুই মিনিট? ফিউজে আগুন ধরিয়ে ব্রিজ থেকে নেমে আসতে কতক্ষণ লাগবে? আধা মিনিট? এক মিনিট? এত চিন্তা করার সময় নেই। পকেট থেকে লাইটার বের করে ফিউজের মুখে আগুন ধরিয়েই দিলাম দৌড়। না ফিউজটা জ্বলেনি। আবার ফিরে গেলাম। এবার একটু সময় নিয়ে ফিউজের মুখে লাইটারটা জ্বালালাম।
ফিউজ পুড়তে শুরু করেছে। ফিউজের দিকে তাকিয়ে আছি। প্রায় ছয় ইঞ্চি পুড়ে গেছে। আর বাকি এক ফুট। ফিউজটা পুড়তে পুড়তে মাইনের দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে গেল। আমি স্বপ্নাবিষ্টের মতো এক দৃষ্টিতে পুড়তে থাকা ফিউজটার দিকে তাকিয়ে আছি। আশেপাশের আর সবকিছু আমার কাছে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম কে যেন ডাকছে, জুনো ভাই চলে আসেন। তাড়াতাড়ি।
দৌড়াতে দৌড়াতে ব্রিজ থেকে নেমে এলাম। তারপর লাফ দিয়ে একটা ঢিবির পেছনে কোনোমতে পৌছালাম। এদিকে মজনু মৃধা চিৎকার করছেন, সবাই মুখ হা করো, দুই কানে হাত দাও।
বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ। ব্রিজের এক অংশ উড়ে গেছে। কিন্তু যতটা আশা করেছিলাম ততটা না। বিস্ফোরণের শব্দে এলাকার লোকজনের ঘুম ভেঙে গেছে। একজন দু’জন করে আসতে শুরু করল। দেখতে দেখতে বেশ লোক জড়ো হয়ে গেল।

ব্রিজটা দেখছে। ব্রিজের যেটুকু নষ্ট হয়েছে, তাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পার হতে খুব কষ্ট হবে না। গ্রামবাসী স্বতঃস্ফূর্ত হয়েই হাতুড়ি-বল্লম ইত্যাদি নিয়ে কাজে নেমে পড়ল। প্রায় আধা ঘন্টার মধ্যে ব্রিজের মাঝের অংশটা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। যে কোনো সময় নরসিংদী থেকে পাকিস্তানি বাহিনী চলে আসতে পারে। লোকজন
সবাইকে সরে যেতে বলা হলো। কিন্তু তারা কি সরতে চায়! আমাদের অস্ত্র দেন। আমরাও যুদ্ধ করব। গ্রামবাসীদের প্রবল আগ্রহ।
আগে ট্রেনিং নিতে হবে। শিবপুরে আমাদের ক্যাম্পে যোগাযোগ করতে বললাম। বাজারে একটা খাবারের দোকান ছিল। দোকানদারকে আমাদের জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে বললাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চাপাতি আর ডিমভাজি এসে গেল। পেট ভরে খেলাম। কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে।
দোকানদারকে খাবারের দাম দিতে চাইলাম। কিন্তু বাজার কমিটির চেয়ারম্যান বলল, কমিটির পক্ষ থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা তিনিই করেছেন। দাম দিতে হবে না।। এবার প্রতীক্ষার পালা। মজনু মামু সবার জায়গা বুঝিয়ে দিয়েছেন। রাস্তার পশ্চিম দিকে একটা বড় বটগাছের গোড়ায় এলএমজি নিয়ে মজনু মামু, সাথে ইয়াসিন। আমার হাতে স্টেন। একই দিকে একটা ঢিপির পেছনে বসে আছি। আমার ডান দিকে ফজলু। বেণু আর মিলন আর একটু দূরে। সব শেষে ঝিনুক। ওর কাছেও স্টেন।
আমজাদ রাস্তার পূর্ব দিকে ব্রিজের সাথে কোনাকুনিভাবে অবস্থান নিয়েছে। ওর সাথে আছে আরো তিনজন। অযথা গোলাগুলি নষ্ট করা যাবে না। আমাদের গুলি সীমিত। প্রথমে মজনু মৃধা শুরু করবেন। তারপর প্রত্যেকে টার্গেট দেখে দেখে গুলি করবে। বার বার সবাইকে কথাগুলো মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হতে চলেছে। খবর পাওয়া গেল ওরা আসছে। প্রায় দেড়শ গজ দূরে একটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে ছয়টা ট্রাক থেকে সৈন্যরা নেমেছে। একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করে এগিয়ে আসছে। আমরা যে যার অবস্থানে বসে আছি- নিশ্চুপ। আমার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। দেখলাম মজনু মৃধা এলএমজির বোল্ট পরীক্ষা করে ম্যাগাজিনটা ঢুকালেন। পাশে দুটো স্পেয়ার ম্যাগাজিন। ছোটো একটা বাক্সে আরো শ’খানেক গুলি। আমার স্টেনটাও একবার দেখে নিলাম। একটা স্পেয়ার ম্যাগাজিন আর পকেটে পনেরো বিশটা আলগা গুলি।
প্রত্যেকটা ম্যাগাজিনে একুশটা গুলি ভরা আছে। খালি হতে আধা মিনিটও লাগার কথা না। স্টেনটা অটোমেটিক সেট করা ছিল। সিঙ্গেল মটে নিয়ে এলাম। আবার বোল্ট টেনে দেখলাম। আশেপাশে রাইফেলের বোল্ট টানার শব্দ শুনলাম। সবাই তৈরি হচ্ছে।
এসে গেছে। দেখা যাচ্ছে শত্রুপক্ষকে। ওরা কেউই আমাদের ব্যক্তিগত শত্রু না। তবু এদেরকে মারতে হবে। আক্রোশটা ব্যক্তিগত না। আক্রোশটা সমষ্টিগত। টান টান উত্তেজনা। মজনু মৃধা কি করছেন। এখনো গুলি করছেন না কেন? আর কত কাছে আসতে দেবে শত্রুদের? পাকিস্তানি সেনাদের চেহারা এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দুজন কেন এত সময় করছেন? মনে হচ্ছে সময় হারিয়ে ফেলেছে।
হঠাৎ সব স্তব্ধতা ভেঙে শোনা গেল মজনু মৃধার হালকা মেশিনগান থেকে এক গুলির শব্দ। সাথে সাথে উঠল আমাদের পনেরোটা রাইফেল ও দুটো স্টেন। কিন্তু আমাদের সব শব্দ ম্লান দিয়ে শুরু প্রতিপক্ষের গোলাগুলি। বৃষ্টির মতো ছুটে আসছে এলএমজি অটোমেটিক চাইনিজ থেকে। ব্রিজের যে পাড়ে আমাদের অবস্থান, সেটা পাড়ের একটু উঁচু। অবস্থানগত সুবিধার লোকবল আর অস্ত্র আমাদের কম থাকলেও, আমরা বেশ কার্যকরভাবেই প্রতিপক্ষের উপর আঘাত হানতে থাকি।
আমার স্টেনের একটা ম্যাগাজিন হয়েছে। সেটা খুলে স্পেয়ারটা আধা ঘণ্টা গোলাগুলির মনে হলো একটু বিরতি হয়েছে। মনে ওদের ক্ষতি আমাদের সবাই অক্ষত। নিচু হয়ে মজনু মৃধার কাছে গেলাম। এলএমজিটা কাজ করছে না।
চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন। তারপর ইয়াসিনের হাতে এলএমজিটা রেখে অবস্থান থেকে নিচু কেমন একবার দেখা দরকার। হয়ে আমরা এগুচ্ছি। ফজলুর পেছনে আসতেই মজনু মৃধাকে দেখে সে খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল।
জানেন তাকে উঠতে নিষেধ করব- সময় আর হলো না। একটা গুলি লাগল তার পিঠে। মুখ দিয়ে একটু গোঙানির মতো শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ফজলু।
হঠাৎ আবার হয়ে গেল গোলাগুলি। প্রত্যেককে নিজের অবস্থান একটা দুটো গুলি চালাতে বেণুকে আমজাদের কাছে পাঠানো হলো, সে যেন রাস্তার পুর্ব পাড়ে আছে তাদের নিয়ে এদিকে চলে আসে। আমরা কয়েকজন ফজলুকে ধরাধরি করে আস্তে আস্তে পেছনে করে তার উপর ফজলুকে শোয়ানো গুলি পিঠ দিয়ে ঢুকে সামনে দিয়ে হয়েছে। রক্ত গলগল পড়ছে। ফজলু
বাঁচবে? ফজলুকে বাঁচানো যাবে? কোনো ডাক্তার আছে? ওদিকে গুলির শব্দ স্তিমিত হয়ে আসছে। সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে আনা মৃধা পাকিস্তানি বাহিনীর কেমন ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে তা জানার জন্য। তাছাড়া ওরা কোনো অস্ত্র যায়, হবে।
ফজলুর বুকে-পিঠে কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। একবার একটু ক্ষীণ শব্দ বের হলো দিয়ে। কিছু বোঝা গেল না। পথেই মারা ফজলু। শিবপুরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ।

সাত
প্রথম যুদ্ধেই বিরাট সাফল্য। প্রায় ত্রিশজনের মতো পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছে। এর মধ্যে একজন ক্যাপ্টেনও আছে। দুটো চাইনিজ রাইফেল, একটা পিস্তল ও ছয়-সাত বাক্স গুলি পাওয়া গেছে। নিহত ক্যাপ্টেনের নাম সেলিম। তার টুপি ও ব্যাজও উদ্ধার করা হয়েছে। এত সাফল্যের পরও সবার মনই বিষণ্ন। এত বড় বিজয়। কিন্তু তারপরও নেই কোনো উল্লাস। ফজলুকে তার গ্রামের বাড়িতে ‘গান স্যালুট’ দিয়ে সমাহিত করা হয়েছে। একটা মৃত্যু আমাদের এই বিজয়ের উল্লাসকে বিমর্ষ করে দিয়ে গেল।
পুটিয়া যুদ্ধের সাফল্য আমাদের যোদ্ধাদের মনোবল প্রচণ্ড রকম বাড়িয়ে দেয়। এলাকাবাসীর উপরও এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এমনকি শিবপুরের আশেপাশের অনেক এলাকা থেকেই লোকজন এসে আমাদের সাথে নতুনভাবে যোগাযোগ করতে শুরু করে এবং তাদের এলাকায় যুদ্ধ করার আমন্ত্রণ জানায়। এই সুযোগে সে সব এলাকায় আমরা আমাদের সংগঠন গড়ার কাজে হাত দেই।
নুরুল হকের নেতৃত্বে শেষ দলটাও নির্ভয়পুর ক্যাম্প থেকে ফিরে এসেছে। ইতিমধ্যে মান্নান খানও মেলাঘর ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষ করে শিবপুরে ফিরে এসেছেন। তিন নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহ মান্নান খানকে শিবপুর থানার কমান্ডার নিয়োগ করেছেন। একই সাথে নেভাল সিরাজকে নরসিংদী, শিবপুর, রূপগঞ্জ, আড়াই হাজার এলাকার আঞ্চলিক কমান্ডার নিয়োগ করা হয়েছে। এতে আমাদের সুবিধাই হলো। কারণ, নেভাল সিরাজের সাথে আগেই আমাদের একটা সমঝোতা হয়েছিল যে, আমরা সমন্বয় সাধন করে কাজ করব। তিনি আমাদের এলাকায় কোনো অতিরিক্ত খবরদারি করতে যাননি। আমরা আমাদের নিজস্ব পরিকল্পনা মাফিকই কাজ করেছি। পরে তিনি আমাদের পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার অল্প পরেই তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন।
তিন নম্বর সেক্টর থেকে মান্নান খানকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল শিবপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে তাদের তালিকা পাঠানোর। তাছাড়া পনেরো দিন পর পর মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রমের রিপোর্টও পাঠাতে বলা হয়েছিল। এই নির্দেশ অনুযায়ী মান্নান খানের ডেপুটি কমান্ডার নিয়োগ করা হয় মজিবুর রহমানকে। আর মজনু মৃধা, আওলাদ হোসেন খান, ঝিনুক খান, সেন্টু মোল্লা, আব্দুল আলী মৃধা, আব্দুর রশিদ মোল্লা ও নুরুল ইসলাম কাঞ্চন এই সাতজনকে গ্রুপ কমান্ডার নিয়োগ করা হয়।
পুটিয়া যুদ্ধের দুই-তিন দিন পরই পাকিস্তানি বাহিনী এসে পুটিয়া বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমরা বুঝতে পারছিলাম এবার আর্মি শিবপুর সদরে স্থায়ীভাবে ক্যাম্প বসাবে। তাই আমরা শিবপুর থানায় যে পনেরো-ষোলোটা রাইফেল ছিল, তা নিয়ে নিই। আর থানায় আগুন লাগিয়ে দেই। এই কাজে নেতৃত্ব দেয় মান্নান খান, ঝিনুক, সেন্টু, আওলাদ প্রমুখ। শিবপুর থানার দারোগা ও পুলিশদের আমরা আমাদের মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করতে আহ্বান জানাই। কিন্তু পুলিশরা জানতে চায় যে, আমাদের সাথে থাকলে আমরা তাদের বেতনের ব্যবস্থা করতে পারব কি না। তাদের বেতন দিতে অক্ষমতা প্রকাশ করায় সব পুলিশই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
থানার দারোগা কয়েকদিন আমাদের সাথে থাকেন। কিন্তু পরে বুঝতে পারেন যে আমাদের কষ্টের জীবনযাত্রার সাথে খাপ খাইয়ে চলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনিও শেষ পর্যন্ত শিবপুর থেকে চলে যান। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানি আর্মি শিবপুরে স্থায়ীভাবে ক্যাম্প বসায়। এসময় জামাত নেতা মোসলেউদ্দিন নোমানী এবং ওহিদ পাঠান, শহীদ পাঠান ও আব্দুল ফকিরসহ অল্প কয়েকজন দালাল শিবপুর সদরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এই দালালদের পরামর্শে পাকিস্তানি বাহিনী মজনু মৃধা, বসিরুদ্দিন খান, রব খানসহ বেশ কয়েকজনের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।

এই সময়ই শিবপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে হঠাৎ করে ডাকাতের উপদ্রব শুরু হয়। কেউ কেউ মান্নান ভাই ও অন্যান্য নেতাদের নাম করে অথবা সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা সেজে গ্রামবাসীদর কাছ থেকে চাঁদা নিতে থাকে। অনেকে আবার পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে দিতে হবে বলে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ছাগল, মুরগি, ডিম ইত্যাদি সংগ্রহ করতে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়। তারপরেও যারা অস্ত্রের জোরে ডাকাতি ও চাঁদাবাজি করতে থাকে তাদের ধরে এনে প্রকাশ্যে গুলি করা হয়। এদের মধ্যে সাবেদ আলী, নিজামুদ্দিন, উসমান ও কার্তিক উল্লেখযোগ্য। এর পরে শিবপুরে আর কোনো ডাকাতির খবর পাওয়া যায়নি।
ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত সব মুক্তিযোদ্ধাই ফিরে এসেছে। স্থানীয়ভাবে প্রচুর যুবককে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। পুরানো ক্যাম্পগুলোতে আর জায়গা হচ্ছে না। তাই নতুনভাবে অঞ্চল ভিত্তিক ক্যাম্প বসানো হয়। শিবপুরের পূর্বাঞ্চলে যশোর, কোদালকাটা ও কামরাবোতে যে ক্যাম্পগুলো বসানো হয়, সেগুলোর কার্যক্রম রায়পুরা থানার অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পশ্চিম অঞ্চলে দত্তের গাঁও, মিয়ার গাঁও আর দরিপুরাতে ক্যাম্প বসানো হয়। এখান থেকে কালীগঞ্জ থানার কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করা হতো। শিবপুরের দক্ষিণে সৃষ্টিঘর ও বিরাজনগরে দুটো ক্যাম্প বসানো হয়। বর্ষা শুরু হওয়ার ফলে শিবপুরের উত্তর অঞ্চল বেশ দুর্ভেদ্য ছিল। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো সহজ রাস্তা ছিল না। তাই হেড কোয়ার্টার বিলশরণে খালেকের ট্যাকেই রয়ে যায়।
শিবপুর সদর পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসলেও বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল মুক্ত ছিল। আগস্ট মাসের শেষ দিকে কাজী গোফরান আগরতলা থেকে শিবপুরে আসে। সাথে নিয়ে আসে ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’র ঘোষণা ও প্রচারপত্র আর ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির কয়েকটা সার্কুলার। এরই ভিত্তিতে নৌকাঘাটা প্রাথমিক স্কুলের মাঠে শিবপুর থানা ভিত্তিক এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
প্রতিটা ক্যাম্প থেকে দশজন করে প্রতিনিধি এবং এলাকা ভিত্তিক কৃষক সমিতির প্রতিনিধিদের এই সভায় আনা হয়। এ সভায় রায়পুরা, মনোহরদি ও কালীগঞ্জের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিল। সমাবেশে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল প্রায় দু’শজন। মান্নান ভাইয়ের সভাপতিত্বে এই সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন মোস্তফা জামাল হায়দার। এই সভায় রনো আর মেনন ভাইয়ের উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা আসতে পারেননি।
সভায় চীন সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। আমরা সাধারণ মানুষের কাছে চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিলাম। তাই জনগণ ও কর্মীদের প্রশ্ন ছিল চীন কেন আমাদের পক্ষ নিচ্ছে না। আমাদের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়, চীন ভুল করেছে। চীন যাই করুক, আমরা আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। এই উত্তরে কর্মীরা বেদনার সঙ্গেই সন্তুষ্ট হয়েছিল। এই সভা মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জনগণের মনোবল বাড়াতে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
আট
পুরো বর্ষা চলছে। রাস্তাঘাট কাদায় প্যাচপ্যাচ করছে। ক্যাম্পে বর্ষাতি বা ছাতার কোনো বালাই নেই। ভেজা কাপড় গায়েই শুকোয়। এর মধ্যেও অস্ত্র নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে টহল দিতে হয়।
শিবপুরে ক্যাম্প বসানোর পর আমি শিবপুর থেকে হাতিরদিয়া যাতায়াত শুরু করে। আমরা ঠিক করেছি এই পথের কোনো একটা জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ির বহরের উপর আক্রমণ করব। এ কাজে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন রাস্তায় পুঁতে রাখা হয়। উপর দিয়ে গাড়ি গেলে চাপের ফলে মাইন বিস্ফোরিত হয়। এই মাইন পাতার অসুবিধা এই যে, মালবাহী গরুর গাড়ির চাকা মাইনের উপর দিয়ে গেলেও মাইন ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে জন্য মাইন পাতা হলে গরুর গাড়িকে সাবধান করার জন্য সব সময় পাহারার ব্যবস্থা রাখতে হয়। ফলে মাইন পাতার ব্যাপারটা জানাজানি হবার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া গাড়ির বহর বা কনভয় থাকলে শুধুমাত্র প্রথম গাড়িটাই বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু আমরা যদি শত্রুকে ভালো রকম ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাই এবং তাদের অস্ত্র সংগ্রহ করতে চাই, তবে বহরের মাঝামাঝি একটা গাড়ি ধ্বংস করা দরকার। সেজন্য আমরা বৈদ্যুতিক ডেটোনেটরের সাহায্যে মাইন বিস্ফোরণের পরিকল্পনা নিলাম।
কিন্তু বৈদ্যুতিক ডেটোনেটর তো আমাদের নেই। তাই নিজস্ব কায়দায় বৈদ্যুতিক ডেটোনেটর বানানো হলো। একটা টর্চের বাল্বে খুব ছোটো একটা ফুটো করে তার মধ্যে দিয়াশলাইয়ের কিছু বারুদ ভরা হলো। তারপর বাল্বের দুই প্রান্ত থেকে তার টেনে এনে ব্যাটারি সংযোগ করে দেখা গেল বাল্বটা ফট করে জ্বলে উঠছে। এরকম কয়েকটা বৈদ্যুতিক ডেটোনেটর আমরা তৈরি করে ফেললাম।
শিবপুর-লাখপুর রাস্তা আর চরসিন্দুর হাতিরদিয়া রাস্তার সংযোগস্থানে দুলালপুর অবস্থিত। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম দুলালপুরের কাছাকাছি হাতিরদিয়া রাস্তায় মাইন পাতব। একটা পছন্দসই জায়গা পাওয়া গেল। রাস্তার এক পাশে ধানক্ষেত। তার পেছনে ডোবা মতো কিছুটা জায়গা। অন্য দিকটা একটু উঁচু টিলার মতো। আশেপাশে বেশ গাছপালাও আছে।

প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে। সারা রাত ধরে রাস্তায় মাইন বসালাম। শক্ত মাটির রাস্তায় গর্ত খুঁড়ে অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন বসাই। মাইনের উপরের মুখ খুলে কিছু পিকে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দিলাম। পিকের সাথে আমাদের তৈরি বৈদ্যুতিক ডেটোনেটর আটকানো হলো। তারপর ঐ ডেটোনেটর থেকে কুড়ি গজ মতো লম্বা তার ধানক্ষেতের মধ্যে টেনে আনলাম। এই তারের দুই প্রান্তে ব্যাটারি সংযোগ করলেই মাইন বিস্ফোরিত হবে। সঠিক ভোল্টেজ পাওয়ার জন্য দশটা দেড় ভোল্টের টর্চ ব্যাটারি পর পর একটা নলের মধ্যে বসানো হলো। রাস্তার গর্ভটা আবার সুন্দর করে মাটি দিয়ে ভরে দিলাম যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে ওখানে কোনো খোঁড়াখুঁড়ির কাজ হয়েছে।
এই অপারেশনে ঝিনুক, মজিবুর রহমান, মানিক, আব্দুল আলী মৃধা, কাফিলুদ্দিন, শাহজাহান, সাহাবুদ্দিন, মিন্টু, সোলেমান, সিরাজসহ মোট বারোজন রয়েছি। অস্ত্রের মধ্যে একটা এলএমজি, বাকি সব থ্রি নট থ্রি রাইফেল আর ভারতীয় এসএলআর। সারা রাত কাজ করে সবাই পরিশ্রান্ত। তিনজনকে পাহারায় রেখে বাকিরা একটা গাছের তলায় একটু ঘুমিয়ে নিলাম।
মানিকের ধাক্কায় ঘুম ভাঙল। ভোরের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ খিদে পেয়েছে। কাদিরকে বললাম, কিছু নাস্তার ব্যবস্থা করতে। ইতিমধ্যে গ্রামের লোকজন একজন দু’জন করে আমাদের কাছে জড়ো হতে শুরু করেছে। বয়স্ক একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কিও, আজকের যুদ্ধ কখন হইতো?
ঝিনুক সব সময়ই রসিকতা করতে পছন্দ করে। সে বলল, চাচা মিঞা, চাচিরে পাকসাকের ব্যবস্থা করতে কন। একটার মধ্যে যুদ্ধ শেষ করে আমরা হাজির হবো। আর একজন লোক এসে বলল, আমরাও তো মুক্তি হইতাম চাই। একটা বন্দুক দেন না, দুই-তিনডা পাঞ্জাবিরে খতম করি।
তাদের গ্রামে পরে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হবে বলে তখনকার মতো তাকে নিরস্ত করা গেল। এভাবে লোকজন জড়ো হতে থাকলে অসুবিধা হবে। তাই সবাইকে সরে যেতে বললাম। তারপর আমরা আমাদের অবস্থান নিলাম।
ধানক্ষেতের মধ্যে ব্যাটারিতে তার সংযোগের দায়িত্ব আমার। আমার কাছে থাকছে মজিবুর। আমাদের দু’জনের কাছেই আছে এসএলআর। রাস্তা থেকে আমাদের দূরত্ব কুড়ি গজ মতো। আমাদেরকে কভার দেওয়ার জন্য একটু দূরে দু’জন রয়েছে। এলএমজি-টা রাখা হয়েছে রাস্তার ওপারে। কাফিলুদ্দিন একটা মোটা গাছের গুঁড়ির পেছনে ওটা নিয়ে বসে আছে। বাকি সাতজন রাস্তা বরাবর অবস্থান নিয়েছে। আর ঝিনুককে একটা বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুলালপুর থেকে প্রায় পোয়া মাইল। দক্ষিণে শিবপুরের রাস্তার উপর একটা কালভার্ট আছে। এখানে গোলাগুলি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ঝিনুক ঐ কালভার্টটা বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেবে যাতে গাড়িগুলো ওপথে আর ফিরে না যেতে পারে।

আমরা আক্রমণের একটা মোটামুটি পরিকল্পনা নিয়েছি। গাড়ির বহরের প্রথম দুটো বাদ দিয়ে তৃতীয়টা যখন মাইনের উপর আসবে, তখন সেটা ফাটানো হবে। আর একই সাথে আমরা রাস্তার দুই দিক থেকে আক্রমণ করব। আমি তো ধানক্ষেতের মধ্যে শুয়ে থাকব। তাই গাড়ির সঠিক অবস্থান আমার পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। মাথা উঁচু করে দেখা বিপজ্জনকও বটে। তাই ওপাশ থেকে মানিক প্রথম গুলিটা করবে। গুলির শব্দ পেলেই আমি ব্যাটারিতে তার সংযোগ করব।
বৃষ্টিভেজা ধানক্ষেতের মধ্যে বসে আছি। ছোটো ছোটো পোকা আর আর পিঁপড়া খুব জ্বালাচ্ছে। একটা বারো-তেরো বছরের বাচ্চা আমাদের জন্য চাপা কলা আর মুড়ি নিয়ে এসেছে। মুড়ি খেতে খেতে বাচ্চাটার সাথে একটু গল্প জুড়ে দিলাম। তার নাম আসমত আলী। পাশের গ্রামেই থাকে। ক্লাস ফোরে পড়ে। ছোটো আরো দুই বোন আছে। বাবা কৃষিকাজ করে। আসমত আলী জানাল তার ‘মুক্তি’ হওয়ার খুব শখ। কিন্তু মাঠে বাবাকে সাহায্য করতে হয়। তাই এখন ‘মুক্তি’ হতে পারছে না।
আমি বললাম, কে বলে তুমি ‘মুক্তি’ না। এই যে আমাদের জন্য মুড়ি নিয়ে এসেছ, এটা তো ‘মুক্তি’দেরই কাজ। তুমি আর একটু বড় হও। তখন তোমাকে দিয়ে যুদ্ধও করাব। সকাল সাড়ে দশটার দিকে দেখা গেল আর্মির গাড়ি আসছে। গাড়ির সংখ্যা মাত্র তিনটা। তার আর ব্যাটারিগুলো ঠিকমতো সাজিয়ে নিলাম। এসএলআর এর বোল্ট টেনে সেফটি ক্যাচ্ ঠিক করলাম। তারপর ধানক্ষেতের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে ফেললাম। আমার কাছ থেকে তিন-চার ফুট দূরে মজিবুরও শুয়ে আছে।
গাড়ির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গাড়ির সংখ্যা তো মাত্র তিনটা। আগের সিদ্ধান্ত ছিল বহরের তৃতীয় গাড়িটা উড়ানো হবে। মানিক কি বুদ্ধি করে মাঝের গাড়িটা যখন মাইনের উপর আসবে তখন গুলি করবে? তাহলে বেশ সুবিধা হয়। গাড়ির শব্দ বেশ জোরালো হচ্ছে। এখনও গুলি হচ্ছে না কেন? অধৈর্য লাগছে।
শেষ পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া গেল। তাড়াতাড়ি ব্যাটারির দুই প্রান্তে তার সংযোগ করলাম। কিন্তু মাইন ফাটলো না। আবার নতুন ভাবে তার দুটো ব্যাটারির দুই প্রান্তে চেপে ধরলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। ইতিমধ্যে গুলির শব্দে গাড়িগুলো থেমে গেছে। এখন আর পিছু হটার সময় নেই। আমি আর মুজিবুর আমাদের এসএলআর থেকে গুলি করা শুরু করলাম। রাস্তার ওপাশ থেকেও আমাদের এলএমজি আর রাইফেলের আওয়াজ পাওয়া গেল। আমার এসএলআর থেকে তিনটা গুলি বের হওয়ার পরই জ্যাম হয়ে গেল। শালার এসএলআর। এখন বোল্ট টেনে টেনে গুলি করতে হবে।
ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে সৈন্যরা নেমে গেছে। রাস্তার দুই দিকে তারা সমানে গুলি করে চলেছে। ধানক্ষেতের উপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি ছুটে আসছে। গুলির শিস কাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলাও আসছে। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে কাদামাটি আর ডোবার মধ্যে পড়ায় একটাও ফাটছে না।
সৈন্যরা যদি ধানক্ষেতের মধ্যে নেমে আসে, তাহলে ধরা পড়ার খুবই সম্ভাবনা। যদিও পেছন থেকে দু’জন মাঝে মাঝে গুলি করে আমাদেরকে কভার দিচ্ছে, তবু ধানক্ষেত থেকে সরে যেতে হবে। খুব আস্তে আস্তে ক্রল করে পেছন দিকে সরে আসছি। এসএলআর-টা খুব ভারি মনে হচ্ছে। তবু ফেলা যাবে না। অস্ত্রই আমাদের জীবন।
ধানক্ষেতের শেষ প্রান্তে একটু নিচু খাদ। সেখানে নেমে একটু স্বস্তি ফিরে পেলাম। দূরে একটা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেল। ঝিনুক তাহলে কালভার্টটা উড়িয়েছে। রাস্তার ওদিকে আমাদের গুলির শব্দও আস্তে আস্তে কমে আসছে। এসএলআর-এর বোল্ট টেনে টেনে গাড়ি লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি করলাম। তারপর আমরা এপারের
চারজন রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে সরে এলাম। দূর থেকে লক্ষ্য করলাম, চার-পাঁচজন সৈন্যকে ধরাধরি করে গাড়িতে তোলা হচ্ছে। তারপর গাড়িগুলো মুখ ঘুরিয়ে শিবপুরের দিকে ফিরে গেল।
আমার মাথায় খালি ঘুরছে, মাইন ফাটলো না কেন। গাড়িগুলো চলে যাওয়ার পর পরই ফিরে এলাম ধানক্ষেতের মধ্যে। তার ধরে ধরে এগুতে গিয়ে দেখি রাস্তার ধারে এক জায়গায় তারটা ছেঁড়া। সম্ভবত মাইন পাতার পর আমরা যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন কোনো গরু-ছাগল তারটা ছিড়ে দিয়ে গেছে।
ইতিমধ্যে ওপার থেকে মানিক আর সিরাজও এসেছে। গ্রামের কয়েকজন লোকের সাহায্যে খুব সাবধানে গর্ত খুঁড়ে মাইনটা তুললাম। তারপর আমরা ক্যাম্পে ফিরে গেলাম। ক্যাম্পে ঝিনুকও ফিরে এসেছে। ঝিনুক বলল, সে বেশ সাফল্যের সাথেই কালভার্টটা উড়িয়েছিল। গাড়িগুলো কালভার্টের কাছে থেমে প্রথমে চারিদিকে সমানে গুলি চালায়। তারপর গাছের গুড়ি, ইট ইত্যাদি দিয়ে জায়গাটা ভরাট করে গাড়ি তিনটা পার করে। ঝিনুক আফসোস করে বলল, ওখানে আমাদের এলএমজি-টা থাকলে সব টাকে শেষ করে দেওয়া যেত।
![মুক্তিযুদ্ধে শিবপুর | হায়দার আনোয়ার খান জুনো 21 জাতীয় স্মৃতিসৌধ [ The National Martyrs' Monument of Bangladesh ]](https://historygoln.com/wp-content/uploads/2022/04/The-National-Martyrs-Monument-of-Bangladesh-জাতীয়-স্মৃতিসৌধ-300x169.jpg)
নয়
সেপ্টেম্বর মাস থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী তাদের আক্রমণ তীব্রতর করতে থাকে। আমাদের ক্যাম্পগুলোর সন্ধানে রাতের বেলাও কমান্ডো বাহিনী পাঠাতে থাকে। রাতের যুদ্ধ আমরা সব সময়ই এড়িয়ে যাই। এজন্য সারা দিন এক জায়গায় ক্যাম্প করে সন্ধ্যার পর আমরা অন্য জায়গায় ক্যাম্প সরিয়ে ফেলতাম। কমান্ডো আক্রমণের ভীতি আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যেও দেখা দেয় এবং তাদের মনোবল দুর্বল হতে থাকে।
একদিন সকাল দশটার দিকে খালেকের ট্যাকে খবর এলো পাকিস্তানি বাহিনীর দুটো দল দুই দিক থেকে এগিয়ে আসছে। আমি আর জামাল ভাই তখন শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত খাচ্ছি। মান্নান ভাই দাড়ি সেভ করছেন। আগের রাত থেকেই তোফাজ্জলের শরীর খারাপ। সে শুয়ে আছে। অন্যান্য ছেলেরা কেউ অস্ত্র পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত। আর কেউবা দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা করছে।
খবর পাওয়ার সাথে সাথে জামাল ভাই খাওয়া ছেড়ে উঠে বললেন, এই মান্নান ওঠ। বসে খাওয়া শেষ কর। আমিও ততক্ষণে শেভ করা শেষ করছি। মান্নান ভাই বললেন। তুই কি ক্লিন শেভ অবস্থায় ধরা দিতে চাস? জামাল ভাই খেপে গেলেন।
আমি জানি, মান্নান ভাই তাড়াহুড়া করলে ক্যাম্পে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে। মান্নান ভাই তাই সময় নিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর মান্নান ভাই কাদের আর হাবিবকে ক্যাম্পের অস্ত্রগুলো দুই নৌকায় তুলতে বললেন। তারপর ধীরে সুস্থে উঠে জামাল ভাইকে বললেন, চল্ এবার যাওয়া যাক।
পরে অবশ্য খবর পাওয়া গেল, পাকিস্তানি বাহিনী খালেকের ট্যাক পর্যন্ত না এসেই ফিরে গেছে।
পাকিস্তানি বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে জনগণের মধ্যেও ধারণা হতে থাকে যে, আমরা বোধ হয় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে টিকতে পারব না। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমরা একটা কৌশল অবলম্বন করি। জনসমক্ষে আমাদের শক্তি প্রদর্শন করতে থাকি। দুই-তিনটা ক্যাম্পের যোদ্ধাদের একত্রিত করে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে পাঠানো হতো। সাথে থাকত এলএমজি, স্টেন আর রাইফেল।
গ্রামে গ্রামে মিটিং করে এই সব অস্ত্র গ্রামবাসীদের দেখানো হতো। এইভাবে একই অস্ত্র সারা শিবপুরের গ্রামাঞ্চলে দেখানোর ফলে জনগণের ধারণা হলো যে, আমাদের যথেষ্ট অস্ত্র আছে এবং আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে মোকাবেলা করতে সক্ষম। জনগণের এই মনোবল ফিরিয়ে আনাটা আমাদের জন্য বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
আমাদের যোদ্ধাদের মনোবল ঠিক রাখার জন্য রাজনৈতিক ক্লাসের পাশাপাশি মাঝে মাঝে গানবাজনার ব্যবস্থাও হতো। বাংলার কমরেড বন্ধু, এইবার তুলে নাও হাতিয়ার, গণযুদ্ধের ডাক এসেছে, কমরেড, কমরেড, কমরেড’ এটা আমাদের খুব প্রিয় গান ছিল। এসব অনুষ্ঠানে গ্রামবাসীরাও অংশ নিত।
পাকিস্তানি আর্মি যেমন কমান্ডো পাঠিয়ে আমাদের তটস্থ রাখত, আমরাও ঠিক করলাম ওদের রাতের ঘুম নষ্ট করতে হবে। পরিকল্পনাটা মজনু মৃধার।
নরসিংদীর আর্মি ক্যাম্পটা ছিল টি এন্ড টি অফিসে। এর কাছেই পেতনীর বাজার। একদিন রাতে মজনু মৃধা, সেন্টু, শেখ কাদের আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পেতনীর বাজার গেলাম। আমাদের সাথে দুটো এলএমজি আর দুটো স্টেন। টি এন্ড টি ক্যাম্পের উত্তর-পূর্ব আর উত্তর-পশ্চিম দিকে দুটো যুৎসই জায়গা বেছে নিলাম। তারপর সেখান থেকে ক্যাম্প লক্ষ করে আমাদের এলএমজি আর স্টেনের একটা করে ম্যাগাজিন শেষ করলাম।
আমাদের গুলি বন্ধ হওয়ার সাথে ক্যাম্পে হৈ চৈ বেধে গেল। ওদের ধারণা হলো, ক্যাম্প বুঝি আক্রান্ত হয়েছে। তাই তারা এলোপাথাড়ি গোলাগুলি শুরু করে দিলো। আমরা হাঁটতে হাঁটতে শিবপুরের পথে রওনা দিলাম।
নরসিংদী থেকে আমরা যখন তিন-চার মাইল দূরে চলে এসেছি, তখনও ওদের গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
এর কয়েকদিন পরে আমরা ঘাসিরদিয়ার রাস্তায় অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মাইন বসাই। এই কাজের দায়িত্বে ছিল হাবিবুর রহমান, রমিজউদ্দিন আহমেদ রোমো আর নাজিমুদ্দিন। ওরা খুব গোপনে সারা রাত ধরে মাইনটা বসায়। পরদিন সকালে ঐ মাইনের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় একটা আর্মির ট্রাক ধ্বংস হয় এবং ট্রাক ড্রাইভারসহ আটজন সৈন্য নিহত হয়। এই ঘটনার পর পরই আমি এসে আশেপাশের অনেক বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং সাতজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর একটা বড় ধরনের অ্যামবুশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। নরসিংদী থেকে শিবপুর আসার পথে পুটিয়া বাজারের এক মাইল উত্তরে শাসপুর চৌরাস্তা। ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর মান্নান খানের নেতৃত্বে একটা বড় দল চৌরাস্তার দুই প্রান্তে সারা রাত অবস্থান নিয়ে বসে থাকে।
মান্নান খানের দলকে সাহায্য করার জন্য মজনু মৃধার নেতৃত্বে আর একটা দল চন্দরদিয়া পুলের কাছে অবস্থান নেয়। এই দলের দায়িত্ব ছিল দুটো। প্রথমত মান্নান খানের দল বিপদে পড়লে পাকিস্তানি বাহিনীকে পেছন থেকে আক্রমণ করা। দ্বিতীয়ত যদি পাকিস্তানি বাহিনী আক্রান্ত হয়ে চন্দরদিয়া দিয়ে পালাতে থাকে তবে তাদেরকে সেখানে আক্রমণ করা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী দু’দলই যার যার অবস্থানে সারা রাত বসে থাকে। কিন্তু সম্ভবত আমাদের এই অবস্থানের কথা পাকিস্তানি বাহিনী আগেই জেনে যায়। তারা শাসপুরের রাস্তায় না এসে ভোরবেলা হঠাৎ করে চন্দরদিয়ায় অবস্থানরত মজনু মৃধার দলকে পেছন থেকে আক্রমণ করে বসে। এই অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে মজনু মৃধা, আবদুল আলী মৃধা, আমজাদ, মানিক, ইদ্রিস, নজরুল ও অন্যান্যরা অসীম সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা করতে থাকে।
আমজাদের রাইফেলের গুলি একটা আর্মির ট্রাকের ড্রাইভারকে বিদ্ধ করে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাকটা রাস্তার পাশে উল্টে পড়ে এবং চারজন সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মজনু মৃধার দলের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হতে তাকে।
এক সময় মজনু মৃধা তার দলকে পিছু হটতে নির্দেশ দেন। পিছু হটতে গিয়ে প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হয় মানিক। তার একটু পরেই ইদ্রিসের মাথায় গুলি লাগে। মজনু মৃধার দল আক্রান্ত হয়েছে শুনে মান্নান খান তার দলবলসহ ছুটতে ছুটতে চন্দরদিয়ায় এসে পৌঁছায়। এ অবস্থা মজনু মৃধা তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলেন এবং প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে এসএমজি দিয়ে গুলি করতে করতে আবার পাকিস্তানি বাহিনীর দিকে এগিয়ে যান। তাঁকে পেছন থেকে কভার দিতে থাকে মান্নান খান, আমজাদ আর আব্দুল আলী মৃধা।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও আমাদের যোদ্ধারা রাস্তার এপারে আর ওপারে মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনী চিৎকার করতে থাকে, সবকো জিন্দা পাকড়ো। মজনুকো পাকড়ো। ইতিমধ্যে মজনু মৃধাসহ বেশ কয়েকজনের গুলি ফুরিয়ে যায়। তখন আমজাদ, নজরুল ও আব্দুল আলী মৃধা একটা দুটো গুলি ছুঁড়ে কভার দিতে থাকে। আর বাকিরা পিছিয়ে আসে। প্রায় শেষ পর্যায়ে আমজাদের পায়ে গুলি লাগে।
আব্দুল আলী মৃধার সাহায্যে আমজাদ পালিয়ে আসতে পারলেও নজরুল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। দূর থেকে আমরা দেখলাম নজরুলকে ট্রাকের উপর তোলা হচ্ছে। কিন্তু তখন আমাদের কিছুই করার ছিল না।
এই যুদ্ধে আমরা হারালাম আমাদের দুই সাহসী যোদ্ধা মানিক আর ইদ্রিসকে। নজরুল একটা রাইফেলসহ ধরা পড়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর সাতজন মারা গেলেও আমরা কোনো অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারিনি। আমাদের যোদ্ধারা অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করলেও সার্বিকভাবে আমাদের ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি। এরকম পরিস্থিতিতে সবার মাঝেই হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। যোদ্ধাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য নতুনভাবে অ্যাকশনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
ভরতের কান্দি সেতু উড়াতে হবে। মজনু মৃধার নেতৃত্বে বারোজনের দল বাছাই করা হলো। দুটো এলএমজি, দুটো স্টেন, একটা এসএমজি আর বাকি সব রাইফেল। সাথে কয়েকটা হ্যান্ড গ্রেনেড ও বিস্ফোরকও রয়েছে।
সেতুটা পাকিস্তানি বাহিনী দিনরাত পাহারা দেয়। সেতুর দুই পাশেই বাংকার আছে। আমাদের পর্যবেক্ষক দল আগেই খবর দিয়েছে, সাধারণত ভোর ছটার দিকে গার্ডরা বাংকার থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটাহাঁটি করে। আমরা ঠিক করি, ঐ সময় সেতুর দুই দিক থেকে এক সাথে আক্রমণ করা হবে।
শেষ রাতের দিকে আমরা ছয়জন করে দুই দলে ভাগ হয়ে সেতুর দুই দিকে অবস্থান নিলাম। ভোরবেলা দেখা গেল মজনু মৃধা যেদিকে অবস্থান নিয়েছেন, সেদিকের গার্ডরা বাংকার থেকে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের দিকের বাংকারের গার্ডরা তখনও বাংকারেই রয়ে গেছে। ফলে মজনু মৃধার দল আমাদের আগেই আক্রমণ শুরু করে দিলো। প্রথম আক্রমণেই চারজন ধরাশায়ী। কিন্তু আমাদের দিকের বাংকার থেকে প্রতিরোধ শুরু হলো।
প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে। আমরা কয়েকটা গ্রেনেডও ব্যবহার করি। শেষ পর্যন্ত গার্ডরা আর প্রতিরোধ না করে পালিয়ে যায়। ফেলে রেখে যায় ছয়টা মৃতদেহ। বাংকার থেকে আমরা তিনটা চাইনিজ রাইফেল ও চার বাক্স গুলি উদ্ধার করি। ফিরে আসার আগে আমরা বিস্ফোরকের সাহায্যে সেতুটা ধ্বংস করে দেই।
সেতু থেকে তিন-চারশ গজ দূরে রাস্তার ধারে একজন পাকিস্তানি সেনাকে আমরা গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বন্দি করি। তার বাঁ পায়ের উরুতে আর ডান কাঁধে গুলি লেগেছে। প্রচুর রক্ত ঝরছে। বাঁচার আশা কম। তবু তাকে ধরাধরি করে কাছের একটা স্কুলঘরে নিয়ে এলাম। ঘণ্টা দুয়েক বেঁচে ছিল। মরার আগে সে একটা পোস্ট কার্ড আমাদের হাতে দিয়ে বলল, আমি জানি আমি আর বেশিক্ষণ বাঁচব না। আমার একটা অনুরোধ, আমার বিবির কাছে লেখা এই চিঠিটা পোস্ট করে দিও। আমার বিবি জানুক, আমি বেঁচে আছি।

দশ
আমরা যখন শিবপুরের মাটিতে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মরণপণ যুদ্ধ করে চলেছি, তখন ভারতের মাটিতে আমাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় এক গভীর ষড়যন্ত্র। শিবপুরে বামপন্থীরা যে একটা শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তুলেছে, এটা অনেকেরই সহ্য হচ্ছিল না।
আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলতে থাকে যে, আমরা নাকি সারা শিবপুরে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছি।আমরা নাকি বাংলাদেশ সরকার বিরোধী এবং আওয়ামী লীগের লোকজনকে সব শেষ করে দিয়েছি। বস্তুত এ সময়ে শিবপুরে বড় বা মাঝারি মাপের কোনো আওয়ামী লীগ নেতাই ছিল না। তাছাড়া রাজনৈতিন লাইন হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতা বা কর্মী হত্যা করার মতো কোনো আত্মঘাতী পরিকল্পনা আমাদের ছিল না।
সেপ্টেম্বরের শেষের দিকেই বিএলএফ-এর একটা দল শিবপুরে আসে। মুক্তি বাহিনী বা এফএফ থেকে এরা ছিল একটু ভিন্ন। মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের ট্রেনিং দিতেন বাঙালি সেনা সদস্যরা। কিন্তু বিএলএফ-এর সদস্যরা প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল।
বিএলএফ-এর এই দলের সাথে ভারি অস্ত্রশস্ত্রও ছিল। এই দলের গোপন উদ্দেশ্য ছিল মান্নান ভাইকে হত্যা করা। কিন্তু শিবপুরে এসে এবং আমাদের কার্যক্রম দেখে তারা বুঝতে পারেন যে মান্নান ভাইকে হত্যার কোনো রকম প্রচেষ্টা নিলে তারা কেউ আর শিবপুর থেকে ফিরে যেতে পারবেন না। তাদের নেতা মান্নান ভাইয়ের সাথে দেখা করেন এবং আমাদের সাথে যৌথভাবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমরা তাদের এই প্রস্তাবে সম্মত হই না। আমরা বলি, তারা স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করুক। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হবে না।
আলোচনার ভিত্তিতে বিএলএফ-এর দলটা যশোর বাজারের কাছে তাদের ক্যাম্প বসায়। আমরা আমাদের ক্যাম্প যশোর বাজার থেকে তুলে নেই। এর দুই তিন দিন পরেই এক রাতে পাকিস্তানি কমান্ডো যশোর বাজার আক্রমণ করে। তাদের হাতে বিএলএফ-এর তিন সদস্য ধরা পড়ে। এই ঘটনার পর বিএলএফ-এর দলটা তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে রায়পুরার ভিতরের দিকে চলে যায়।
শিবপুরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলতেই থাকে। এই অপপ্রচার ও রাজনৈতিক চাপের ফলে তিন নম্বর সেক্টর থেকে নির্দেশ আসে, শিবপুর থানা কমান্ডার মান্নান খান যেন তার দলবল ও অস্ত্রশস্ত্রসহ মেজর কে এম সফিউল্লাহর কাছে উপস্থিত হন।
এই নির্দেশ পালন করা হবে কি হবে না, এ নিয়ে আমাদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় যে, মান্নান খান একাই আগরতলা যাবেন এবং পুরো অবস্থা বুঝানোর চেষ্টা করবেন। এ সিদ্ধান্ত মান্নান খানের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কারণ ওখানে পৌছানো মাত্র মান্নান খানকে গ্রেফতার ও হত্যা করার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু মান্নান খান অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে সব কিছুর মোকাবেলা করেন।
অক্টোবরের প্রথম দিকে মান্নান খান আগরতলা পৌঁছান। প্রথমেই দেখা করেন। ব্যারিস্টার মনসুরের সাথে। তিনি শিবপুরের ঘটনা বিস্তারিত শুনে মান্নান খানকে সঙ্গে করে তিন নিম্বর সেক্টরের কমাণ্ডার মেজর কে এম সফিউল্লাহর কাছে হাজামারা ক্যাম্পে যান। মান্নান খানকে প্রথমেই দেরি করে আসার জন্য ও দলবল না নিয়ে আসার জন্য অভিযুক্ত করা হয়।
মান্নান খান খুব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন যে, শিবপুর থেকে যুদ্ধরত সহযোদ্ধাদের আগরতলায় নিয়ে আসার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ শিবপুর ছেড়ে চলে আসার অর্থই হচ্ছে একটা বিশাল এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া আর শিবপুরের দায়িত্ব অন্যান্য গ্রুপ কমান্ডারের কাছে ভালো মতো বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যই মান্নান খানের আসতে দেরি হয়েছে।
পরে মান্নান খান চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, শিবপুরে আমাদের হাতে যদি একজনও আওয়ামী লীগ নেতা বা কর্মী খুন হয়ে থাকে, তবে তার সব দায়িত্ব আমি নেবো। আমার কোর্ট মার্শাল করুন। শিবপুরে পাঁচজন ডাকাতকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতারা শিবপুরে গিয়ে যদি প্রকাশ্যে বলতে পারেন যে, ঐ পাঁচ জনের একজনও আওয়ামী লীগের সদস্য, তাহলেও আমি আপনাদের শাস্তি মাথা পেতে নেবো।
এরপর মান্নান খান শিবপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলো হয়েছে তার রিপোর্ট পেশ করেন। এ অবস্থায় মান্নান খানকে ক্যাম্পে আটকে রেখে গোপনে একটা সামরিক তদন্ত টিম শিবপুরে পাঠানো হয়। এই তদন্ত টিম শিবপুরে এসে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে যে রিপোর্ট পেশ করে, তাতে প্রমাণিত হয় যে, শিবপুরের বিরুদ্ধে যা প্রচার করা হচ্ছিল তা সবই চক্রান্তমূলক। তখন মান্নান খানকে শিবপুরে ফিরে গিয়ে আবার আগের মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। প্রায় পনেরো দিন পর মান্নান খান আবার শিবপুরে ফিরে আসেন।
এই সময়ই প্রায় অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটে। সেদিন সম্ভবত ২১ অক্টোবর। ঈদের আগের দিন। হঠাৎ দেখি নজরুল ফিরে এসেছে। সে চন্দরদিয়ার যুদ্ধে অস্ত্রসহ ধরা পড়েছিল। ওর আশা তো আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম।
নজরুল ধরা পড়ার পর পাকিস্তানি বাহিনীর এক সদস্য তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করে। তারপর টেনে হিচড়ে তাকে ট্রাকে তোলা হয়। ট্রাকের মধ্যেই ও জ্ঞান হারায়। নজরুলের জ্ঞান ফিরে আসে নরসিংদী হাসপাতালে। চার-পাঁচ দিন হাসপাতালে থাকার পর ওকে নিয়ে আসা হয় নরসিংদীর টিএন্ডটি-তে অবস্থিত আর্মি ক্যাম্পে। সেখানে আরো আটজন ছেলের সাথে তাকে একটা ছোটো ঘরে আটকিয়ে রাখা হয়।
বন্দি অবস্থায় ওদেরকে সারা দিনে একবার খাবার দেওয়া হতো-দুটো রুটি আর ডাল। তাছাড়া দিনের মধ্যে চার পাঁচবার চলতো ধোলাই। অফিসার বা সাধারণ সৈন্য যেই আসত, সেই ইচ্ছা মতো সবাইকে ঘুষি, লাথি আর লাঠির বাড়ি মেরে হাসতে হাসতে চলে যেত। একটু দূরে আরেকটা ঘরে কয়েকজন অল্প বয়সী মহিলা বন্দি ছিল। রাতের বেলা এই সব মহিলাদের আর্তচিৎকার আর সৈন্যদের পৈশাচিক হাসি ও উল্লাস শোনা যেত।
ক্যাম্পে যারা আটক ছিল, তাদের মধ্যে একমাত্র নজরুলই যুদ্ধরত অবস্থায় ধরা পড়েছিল। তাই নজরুলের উপর ক্যাম্পকর্তাদের আক্রোশটা একটু বেশি ছিল। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল এক ক্যাপ্টেন। জাতে পাঠান। সে প্রায়ই নজরুলকে আলাদা ভাবে ডেকে এনে অমানুষিক নির্যাতন করত।

ক্যাম্পে আসার চতুর্থ দিনে বিকেলবেলা সব কয়জন বন্দিকে পেছনের মাঠে দাঁড় করানো হয়। তারপর ওদের মধ্যে থেকে তিনজনকে গুলি করে মারা হয়। নজরুল সে যাত্রা রক্ষা পায়। পরের দিন সকালে ওদের ঘরে আরো পাঁচজন নতুন বন্দি ঢোকানো হয়। এদের মধ্যে দুজনের অবস্থা খুবই কাহিল। সেদিন বিকেলেই আবার সব বন্দিদের মাঠে দাঁড় করিয়ে তিনজনকে গুলি করা হয়। এ যাত্রাও নজরুল রক্ষা পায়। এভাবে নজরুল তৃতীয় বারও মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে।
২১ অক্টোবর সকালে ক্যাপ্টেন তার ঘরে নজরুলকে ডেকে পাঠায়। নজরুল দেখে ক্যাপ্টেন বিছানায় শুয়ে আছে। চেহারায় কেমন একটা বিষণ্ন ভাব। ক্যাপ্টেন নজরুলকে বসতে বলে। সে তো অবাক। যে ক্যাপ্টেন প্রায় প্রত্যেক দিনই তার উপর নির্যাতন চালিয়েছে, অশ্রাব্য গালি ছাড়া কথা বলেনি, সে তাকে বসতে বলছে! ক্যাপ্টেন নজরুলের কাছে জানতে চায়, বাড়িতে কে কে আছে। মার কথা মনে আসতেই নজরুলের বুকটা হু-হু করে ওঠে। মার কথা বলতে গিয়ে নজরুলের গলা ধরে আসে।
ক্যাপ্টেন জানায় যে তারও মার কথা খুব মনে পড়ছে। প্রত্যেক বছর সে তার মার সাথে ঈদ করে। এবার আর মার সাথে ঈদ করা হবে না। সে জানে না মার কাছে আর কোনোদিন ফিরে যেতে পারবে কি না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ক্যাপ্টেন নজরুলকে বলে, তুমি এখনই এই ক্যাম্প থেকে চলে যাও। দেরি করো না। আমার মত আবার পাল্টে যেতে পারে।
নভেম্বরের প্রথম থেকেই বোঝা যাচ্ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর তেজ কমে আসছে। তাদের হাবভাব দেখেও মনে হচ্ছিল, তারা আমাদের আক্রমণ করার চেয়ে নিজেদের ক্যাম্প গুটানোর দিকেই বেশি ব্যস্ত।
কুমড়োদি এতিমখানায় মিলিশিয়া ও রাজাকারদের একটা মাঝারি ধরনের ক্যাম্প ছিল। ওটা মূলত সৈন্যদের রসদ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের একটা গুদাম ছিল। ওখান থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে রসদ ও জিনিসপত্র সরবরাহ করা হতো। একদিন রাজাকার বাহিনীর এক সদস্য আমাদেরকে এসে জানায় যে, ওখান থেকে সব মিলিশিয়াদের নরসিংদী ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পে শুধু বাঙালিরাই থাকবে। আমরা যদি শুধু বাইরে থেকে কিছু গোলাগুলি করি, তবে ওরা সবাই ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাবে। তখন আমরা ক্যাম্পের সব রসদপত্র দখল করতে পারবো।
প্রথমে আমাদের সন্দেহ হয়েছিল, এটা কোনো ফাঁদ কি না। পরে ঐ এলাকার আমাদের বিশ্বস্ত লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারি সত্যিই মিলিশিয়ারা ঐ ক্যাম্প ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মিলিশিয়ারা যেদিন ক্যাম্প ত্যাগ করে, সেই রাতেই আমাদের একটা দল ক্যাম্পে চড়াও হয়। তিন-চার রাউন্ড গুলি করার পরই রাজাকাররা সব ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায়। আমরা ক্যাম্পটা দখল করি।
নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফটিক মাস্টার ভারত থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একটা দল নিয়ে যশোর বাজারে এসে পৌঁছান এবং ঐ এলাকায় একটা ক্যাম্প বসান। ফটিক মাস্টারের সাথে আগে থেকেই মান্নান ভাইয়ের যথেষ্ট সদ্ভাব ছিল। তিনি মান্নান ভাইয়ের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। যুদ্ধের একদম শেষ পর্যায়ে আসা এই দলটা কয়েকটা অপারেশন করে।

এগারো
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যুদ্ধ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে গেছে। এই সুযোগে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর বার বার আক্রমণ চালাতে থাকি। আক্রমণগুলো ছিল স্বল্পস্থায়ী এবং আচমকা। এইভাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে আমরা বেশ ব্যতিব্যস্ত রাখতে সক্ষম হই। এই সময় তারা মানসিকভাবে আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। আগে কোনো জায়গায় আক্রান্ত হলে পাকিস্তানি বাহিনী পরে ফিরে এসে ঐসব জায়গায় গ্রামবাসীদের উপর নির্যাতন চালাতো। কিন্তু এখন দেখা গেল, তারা কোন রকমে আত্মরক্ষা করে পালিয়ে যাচ্ছে।
আমরা সিদ্ধান্ত নেই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, শিবপুরকে মুক্ত করতে হবে। আমরা তাই আমাদের আক্রমণ তীব্রতর করতে থাকি। পর পর তিন রাত আমরা খুব কাছ থেকে শিবপুর ক্যাম্পের উপর আক্রমণ চালাই। এই আক্রমণের ফলে চারজন, পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এর দু’দিন পর সকালে পাকিস্তানি বাহিনী শিবপুর থেকে তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে নরসিংদী চলে যায়।
সেদিন ছিল এক স্মরণীয় দিন। গ্রাম থেকে হাজার হাজার লোক এসে জমা হতে লাগলো শিবপুরে। জনতার সে কি বিজয় উল্লাস। এক বিশাল বিজয় মিছিল নিয়ে আমরা শিবপুর থানায় বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিলাম। শিবপুর মুক্ত হলো।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। সবার মাঝেই চরম উত্তেজনা। সন্ধ্যার পর সবাই মিলে রেডিওর চারদিকে বসে খবর শুনি। স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশবাণী, বিবিসি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধরি। ৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে আসার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ইন্দিরা গান্ধীও ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা দেন। ভারতের পূর্ব আর পশ্চিম উভয় প্রান্তেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
৫ ডিসেম্বর সকাল থেকেই শিবপুরের আকাশ দিয়ে ভারতীয় বিমান উড়তে দেখলাম। জঙ্গি বিমানগুলো খুব নিচু দিয়ে উড়ছিল। রাতের খবরে শুনলাম, কুর্মিটোলা বিমানক্ষেত্রটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। রানওয়েতে পঁচিশ ফুট ব্যাসের গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর শক্তি পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে।
৬ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিলেন।
সে রাতেই আমরা অনেকে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার নরসিংদী মুক্ত করতে হবে। নেভাল সিরাজের সাথে আলোচনা হলো। আমরা নরসিংদীর উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করব। আর নেভাল সিরাজ তাঁর বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালাবেন দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে। আমরা যৌথভাবে এই আক্রমণ চালাতে থাকি। আমাদের উপর্যুপরি আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

আমেরিকা তাহলে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে? যুদ্ধ তাহলে দীর্ঘায়িত হবে? বাংলাদেশ কি ভিয়েতনাম চলেছে? হলে মন্দ হয় না। দীর্ঘায়িত যুদ্ধে দেশের মধ্যে আমাদের ঘাঁটিগুলো আরো পোক্ত হবে।
৮ ডিসেম্বর শুনলাম সিলেট ও যশোর ৯ ডিসেম্বরের খবর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে হানাদার বাহিনী পালিয়ে গেছে।
১১ ডিসেম্বর আমরা নরসিংদীর টিএন্ডটি মজনু ঝিনুক, আওলাদ, সাউদ, ইকবালসহ আমরা প্রায় ত্রিশজন এই আক্রমণে অংশ নেই। কিন্তু ক্যাম্পের বাংকার থেকে ভারি মেশিনগানের গুলি বিরতিহীনভাবে বর্ষণ হতে থাকে। ফলে আমরা ক্যাম্পের কাছাকাছি যেতে ব্যর্থ হই। দূর থেকেই আমরা কিছু গ্রেনেড ছুঁড়লেও তা বিশেষ কার্যকর হয় না। পরের দিন আবার নতুনভাবে আক্রমণ চালাই।
একই সাথে আমরা মাইকে ঘোষণা দিতে থাকি, ক্যাম্পের সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের মারা হবে না। কিন্তু সেদিনও ক্যাম্প দখল করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ১৩ তারিখ আমরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই খুব ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প ছেড়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায়। পথে পাঁচদোনায় নেভাল সিরাজ তাঁর দলবল নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ সময় একুশজন পাকিস্তানি সৈন্যকে নেভাল সিরাজের দল অস্ত্রসহ ধরে ফেলে। বাকিরা ঢাকার দিকে চলে যায়।
আমরা যখন নরসিংদী মুক্ত করি, ভারতীয় বাহিনী তখন নরসিংদী থেকে অনেক দূরে। মাত্র ভৈরব পর্যন্ত পৌঁছেছে। টিএন্ডটি ক্যাম্প দখল করে সেখানে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি। ক্যাম্প দখলের পর ভিতরে ঢুকে অস্ত্রের সম্ভার দেখে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। ঘর বোঝাই হাল্কা ও ভারি মেশিনগান। থরে থরে সাজানো রকেট লাঞ্চার আর দুই ইঞ্চি মর্টার। অফুরন্ত গোলাগুলি আর গ্রেনেড। এত অস্ত্র আজ আমাদের হস্তগত। অথচ পুরো যুদ্ধের সময় অস্ত্রের কত অভাবই না আমরা বোধ করেছি।
কিন্তু এই অস্ত্র আমরা আমাদের দখলে রাখতে পারলাম না। কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা হেলিকপ্টার নামল। তাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক। তাঁরা আমাদের নরসিংদী মুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন এবং ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব তাঁদের হাতে ছেড়ে দিতে বললেন। আমরা দখল করা অস্ত্রসম্ভার ভারতীয় বাহিনীর হাতে তুলে দিয়ে মনটা খারাপ করেই শিবপুর ফিরে এলাম।
হায়দার আনোয়ার খান জুনো :
কমিউনিস্ট নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক হায়দার আনোয়ার খান জুনো। হায়দার আনোয়ারের জন্ম ১৯৪৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কলকাতায়। তার পৈতৃক বাড়ি নড়াইল জেলায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় এমএসসি পাশ করেন। তবে স্কুল জীবন থেকেই তিনি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন বাম রাজনীতির চীনপন্থী শিবিরে।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কারাবরণ করেন তিনি। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পরে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হলে এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পান তিনি। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় গেরিলা দলে ছিলেন হায়দার আনোয়ার। তিনি বোমা তৈরির কাজ করতেন। প্রতিরোধ যুদ্ধেও অংশ নেন এই গেরিলা।
জুনোর মৃত্যুতে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, ওয়ার্কার্স পার্টি ঢাকা মহানগর, এনডিপি শোক প্রকাশ করেছে।
আরও পড়ুন: