[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

আজকে আমদের আলোচনার বিষয় ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

 

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

 

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ভাষা, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাসসহ সকল ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কেবল ধর্মের ভিত্তিতে এক হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করে এই অসম রাষ্ট্র গড়ে তোলা হয়।

এই রাষ্ট্রের কর্ণধাররা প্রথমই শোষণ ও বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলাকে। অথচ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় পাকিস্তানের ভাষাগত জনসংখ্যার একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, মোট জনসংখ্যার ৫৪.৬০% বাংলা, ২৮.০৪% পাঞ্জাবি, ৫.৮% সিন্ধি, ৭.১% পশতু, ৭.২% উর্দু এবং বাকি অন্যান্য ভাষাভাষী নাগরিক।

এর থেকে দেখা যায় উর্দু ছিল পাকিস্তানি ভাষাভাষির দিক থেকে ৩য় স্থানে। অন্যদিকে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের জনসংখ্যার ৪.৪০ কোটির মধ্যে ৪১৩ কোটি ছিল বাংলা ভাষাভাষী। এখানে ৯৮% বাংলা এবং মাত্র ১.১% ছিল উর্দু ভাষী। অথচ বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বেশ কিছু পরিকল্পনা নেয়।

কিন্তু সংগ্রামের ঐতিহ্যে লালিত বাঙালি জাতি মাতৃভাষার ওপর এ আঘাতের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। পাকিস্তান সৃষ্টির ছ’মাস পেরুতে না পেরুতে তারা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রাজপথে নামে যা ১৯৫২ সালে দ্বিতীয় পর্বের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করে ।

উর্দু বনাম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে উদ্দেশ্য ও যুক্তি

পাকিস্তানের মতো বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে ঐক্য বন্ধন সৃষ্টির জন্য একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়োজনীয়তা প্রথম থেকেই শাসকগোষ্ঠী অনুভব করেন। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের বড় অংশ ছিলেন উত্তর ভারত থেকে আগত উর্দুভাষী। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান থেকে শুরু করে পাকিস্তানের উচ্চ পদবীধারীরা ছিলেন উর্দুভাষী মোহাজের।

জিন্নাহ ও তাঁর উত্তরসূরি লিয়াকত আলীর মন্ত্রিসভাকে তাই ‘মোহাজের মন্ত্রিসভা’ বলা হতো । এক হিসেবে দেখা যায় ১৯৪৭-৫৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট ২৭ জন গভর্নর জেনারেল/প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, প্রাদেশিক গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১৮ জন ছিলেন মোহাজের। এদের আবার অধিকাংশের ভাষা ছিল উর্দু। যে কারণে প্রথমে থেকেই শ্রেণী স্বার্থে তাঁরা উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন।

এমন কি নাজিমুদ্দিন যিনি পূর্ববাংলার উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন তিনি ছিলেন উর্দুভাষী। স্বভাবতই তারা ও পশ্চিম পাকিস্তানি জনগোষ্ঠী রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সর্বত্র নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখার জন্য এ ভাষাকে বেছে নেয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বহুদিন থেকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুকে চর্চা করায় তারা উর্দুর বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ করেনি।

মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রভাবশালী অংশ পশ্চিম পাকিস্তানি হওয়ায় তারা সকলে এ ভাষার পক্ষে ছিলেন। তবে পূর্ববাংলায় এর প্রতিবাদ ওঠে। কারণ পূর্ববাংলায় কখনোই উর্দু চর্চা হয়নি। বাঙালিরা গণতন্ত্র, জনসংখ্যাধিক্য ইত্যাদি কারণে ৫৬% বাংলাভাষীদের ভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করেছে। এর সাথে জড়িত ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ।

সব যুক্তি উপেক্ষা করে প্রশাসন, অর্থনীতির কেন্দ্রসহ পশ্চিম পাকিস্তান ও কেন্দ্রের রাজধানী স্থাপিত হয় করাচিতে। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী অংশের সেখানে অবস্থানের ফলে স্বাভাবিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান সমৃদ্ধ এলাকা এবং পূর্ববঙ্গ অবহেলিত এলাকায় পরিণত হয়।

বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগের ব্যবহার, উন্নয়ন কর্মকান্ডের বড় অংশ পশ্চিমে সম্পাদনের ফলে বঞ্চিত পূর্ববঙ্গবাসীদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে শুধু শাসকের বদল হয়েছে। ব্রিটিশ শোষণের বদলে পাকিস্তানি শোষকের আবির্ভাব হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনীতি, প্রশাসনসহ চাকরি ও পদের ক্ষেত্রে বাঙালিদের বঞ্চিত করার নীতি।

উর্দুকে সরকারি ভাষা ঘোষণা, গণমাধ্যমে ব্যাপক উর্দুর ব্যবহার, সরকারি কর্মকান্ডে যেমন মানি অর্ডার ফর্ম, টেলিগ্রাম ফর্ম, ডাকটিকেট, মুদ্রায় উর্দু ব্যবহার শুরু এবং সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উর্দু ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া হলে শিক্ষিত বাঙালিরা এর প্রতিবাদ জানায়।

প্রথম থেকেই তাই বাঙালি ছাত্র ও নেতৃবৃন্দের কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, দাবি- দাওয়াতে বাংলা ভাষাকেও সরকারি মর্যাদা দানের দাবি তোলা হয়। এভাবে বাংলা ভাষার দাবি পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়।

ভাষা বিতর্কের উৎপত্তি ও বিকাশ

পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই উর্দু বনাম বাংলা নিয়ে ভাষা বিতর্ক দেখা দেয়। ১৯০৬ সালে যখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের এ অধিবেশনেও এ প্রশ্ন ওঠে। তবে তখন পর্যন্ত এ সমস্যাটি তত প্রকট হয়নি। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে দলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তনের একটি উদ্যোগ নিলে ফজলুল হকের বিরোধিতায় তা সফল হয়নি।

তৎকালীন বাংলা সরকারের সময়ও ভাষা নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের প্রাক্কালে এই বিতর্ক মৃদুভাবে দেখা দেয়। কংগ্রেস নেতারা হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলে পাল্টা ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ উর্দু ভাষাকে সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রভাষা দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে খুব ক্ষুদ্র হলেও বাংলার পক্ষে দাবি ওঠে।

তবে ১৯৪৭ সালে যখন পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায় তখন ভাষা বিতর্ক নতুন রূপ নেয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ মে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছাড়াও বেশ কয়েকজন বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ করেন এবং বাংলার পক্ষে বক্তব্য দেন।

পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষিত সমাজ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে পত্র-পত্রিকায় মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন। এসময় পূর্ববঙ্গে গঠিত বিভিন্ন সংগঠনও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখে। জুলাই মাসেই কামরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় ‘গণআজাদী লীগ’ নামে একটি আদর্শভিত্তিক সংগঠন। এই সংগঠন স্পষ্টভাবে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করে।

পরের মাসে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা বিতর্ক আরো প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত ‘তমদ্দুন মজলিস’ সভাসমিতি ও লেখনীর মাধ্যমে বাংলা ভাষার পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। এই সংগঠনের উদ্যোগে ডিসেম্বর মাসে গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ যার আহ্বায়ক মনোনীত হন নূরুল হক ভূঁইয়া।

পরবর্তীকালে এ উদ্দেশে কয়েকটি কমিটি গঠিত হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিসের গঠিত প্রথম সংগ্রাম পরিষদটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবী সমাজ, সাংবাদিক সংঘ বিভিন্ন সভা ও স্মারকলিপির মাধ্যমে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।

তবে পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি ও আশা-আকাক্মখাকে উপেক্ষা করে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সরকারি কোন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। ঢাকার বাইরেও এ আন্দোলন প্রসার ঘটে।

ঢাকায় ৬ ডিসেম্বর প্রতিবাদ মিছিল শেষে বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করেন। যদিও এ পর্যায়ে সরকার যড়যন্ত্রের পাশাপশি উর্দুভাষী মোহাজেরদের বাংলা ভাষার পক্ষে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। ১২ ডিসেম্বর এমনি একটি বাঙালি-অবাঙালি সংঘর্ষে বেশ কযেকজন বাঙালি ছাত্র আহত হন।

ভাষা সৈনিক নূরুল হক ভূঁইয়া এ ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “বাঙালিদের উপর অবাঙালিদের এটা যে অন্যায় হামলা ছিল তা সবার কাছে বেশ পরিষ্কার হয়। বাঙালির মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব, জাতীয় সত্তা ইত্যাদি সম্পর্কে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে ভাষা আন্দোলন দ্রুত জনসমর্থন লাভ করে।”

এই ঘটনার প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর সচিবালয়ের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করে। সরকার ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে এবং ১৫ দিনের জন্যে সভা- সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্তার

উল্লেখিত পরিস্থিতিতে ১৯৪৮ সালের প্রথম থেকেই ভাষা প্রশ্নে বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত অংশ বাংলা ভাষার পক্ষে সোচ্চার হয়। ১৯৪৮ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এক অধিবেশনে নিম্নপর্যায় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে গ্রহণের প্রস্তাব গ্রহণ করে ।

২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু মুসলিম লীগের সকল সদস্যের ভোটে তা অগ্রাহ্য হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পূর্ববঙ্গে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এর প্রতিবাদ করে প্রথমে ছাত্র সমাজ। ২৬ ও ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।

২ মার্চ ছাত্রসমাজ দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এ পরিষদের আহ্বায়ক মনোনীত হন শামসুল আলম। নব গঠিত পরিষদ ১১ মার্চ হরতাল আহ্বান করে। ঐদিন হরতালকালে পুলিশের লাঠি চার্জে অনেকে আহত হন। শেখ মুজিব, শামসুল আলম সহ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ১৩-১৫ মার্চ ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। শুধু ঢাকা নয় ঢাকার বাইরে সর্বত্র ১১ মার্চ হরতাল ও অন্যান্য দিনের কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের তীব্রতার প্রেক্ষিতে ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তিতে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি, তদন্ত কমিটি গঠন, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা ও ব্যবস্থাপক সভায় রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিষয় উত্থাপনে রাজি হন।

তড়িঘড়ি করে তাঁর চুক্তি সম্পাদনের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফর যেন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। ১৯ মার্চ জিন্নাহও ঢাকা সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্সে নাগরিক সংবর্ধনা, ২৪ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে মতামত দেন।

জিন্নাহর ২৪ মার্চ বক্তৃতার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে উপস্থিত ছাত্ররা ‘না’ ‘না’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদের অধিবেশনে নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সাথে ১৫ মার্চের চুক্তি ভঙ্গ করে উর্দুকে পূর্ববঙ্গের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব করেন।

পরিষদে বিরোধী দল এর প্রতিবাদ করলেও নাজিমুদ্দিন তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন নি । যদিও শেষপর্যন্ত পরিষদে উত্থাপিত এই প্রস্তাবটিও বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৪৮ সাল জিন্নাহর মৃত্যুর পর বিশেষত মার্চ মাসের পর হতে ভাষা আন্দোলন কিছু দিনের জন্য স্তিমিত থাকলেও বাংলার অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন সংগঠিত হয়।

বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষে ৮ এপ্রিল থেকে ১৮ দিন কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারীদের ধর্মঘট, মেডিকেল ছাত্রদের ধর্মঘট, জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন চলে। ১৪ জুলাই পুলিশ ধর্মঘট হয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশের মধ্যে গুলি চলাকালে ২ জন পুলিশ নিহত হয়।

এই অবস্থায় ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান আলী ঢাকা এলে ছাত্র সমাজ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানায়। লিয়াকত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া বক্তৃতায় সুকৌশলে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্রদের মধ্য হতে আবারও ‘না’ ‘না’ ধ্বনি সম্বলিত প্রতিবাদ ওঠে।

১৯৪৯-১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের বিস্তার

১৯৪৮ সালের পর প্রতি বছর ১১ মার্চ প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। ১৯৪৯ সালে আরবি হরফে বাংলা লেখার সরকারি ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এ উদ্দেশে ১৯৪৯ সালের মার্চে আকরাম খাঁকে সভাপতি করে ‘পূর্ববাংলা ভাষা কমিটি’ গঠিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রতিবাদ জানায়। যদিও শেষপর্যন্ত এর বাস্তবায়ন হয়নি।

১৯৫২ সালে নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে ২৭ জানুয়ারি উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এর প্রতিবাদে ছাত্র সমাজ ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট পালন করে । ৩১ জানুয়ারি সর্বদলীয় সভায়ও সরকারি নীতির সমালোচনা করা হয়। এ সময় আব্দুল মতিনকে আহবায়ক করে নতুন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদ গঠনের পর আন্দোলনের গতি সঞ্চার করে।

নাজিমুদ্দিনের এই উক্তির প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারি মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে এক সভায় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ পরিষদই ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গে হরতাল আহ্বান করে। কিন্তু সরকার বিক্ষোভ দমনে ১৪৪ ধারা জারি করলে শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্ব।

সারসংক্ষেপ

১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে তা ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে সকল বাঙালির আন্দোলনে পরিণত হয়। একদিকে সরকারের দমননীতি, অন্যদিকে বাঙালি জাতির বাংলা ভাষার পক্ষে দুর্বার আন্দোলন সমানতালে চলতে থাকে। ঢাকায় সূচিত আন্দোলনের বিস্তার মফস্বল পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। সে কারণে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন অল্প সময়ে সাফল্য লাভ করে।

সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি

১। রতনলাল চক্রবর্তী, ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র, ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ২০০০। এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ১৯৯৩।

২। বদরুদ্দীন উমর, ‘ভাষা আন্দোলন, সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১, ঢাকা,

৩। Census of Pakistan 1951, vol. 1 Pakistan, Karachi, Government of Pakistan, N.d.

 

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি

 

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নঃ

১। ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখুন।

২। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের বিস্তার সংক্ষেপে লিখুন।

রচনামূলক প্রশ্ন:

১। ভাষা আন্দোলনের পটভূমি সংক্ষেপে আলোচনা করুন ।

আরও দেখুন:

Leave a Comment