বাংলাদেশ ও পাকিস্তান রাজনৈতিক সম্পর্ক ১৯৭১-১৯৭৫ : প্রাক-স্বীকৃতি পর্ব – আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন : আধুনিক বিশ্বে দুটি পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থে সম্পর্ক স্থাপন নতুন কোনো ঘটনা নয়। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো তাদের ঔপনিবেশিক অতীত ভুলে গিয়ে ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। ব্রিটেনের এককালের বিভিন্ন উপনিবেশ বর্তমানে স্বাধীন দেশগুলো এখন ব্রিটেনের নেতৃত্বাধীন কমনওয়েলথের সদস্য। স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান প্রাথমিক আবেগ ও ক্ষোভ কাটিয়ে উঠে উভয়ের স্বার্থে সম্পর্ক গড়ে তুলতে তৎপর হয়ে ওঠে।

অবশ্য এর পেছনে উভয় দেশের পরিপূরক অর্থনীতি, অমীমাংসিত বিভিন্ন বিষয় অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই উভয় দেশ তাই প্রাথমিক তিক্ততা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালায় এবং কিছু বিষয়ে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়। উভয় দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা পরস্পরের দেশ সফরও করেন। যদিও উভয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্যমান দীর্ঘদিনের সন্দেহ ও টানাপোড়েনের কারণে প্রাথমিক পর্যায়ে এই সম্পর্ক স্থাপনে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল প্রবল।
উভয় পক্ষের এই দৃষ্টিভঙ্গিগত কঠোরতার কারণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তান ২৬ মাস সময় নেয়। পাকিস্তান মুজিব আমলে স্বীকৃতি দিলেও উভয় দেশের মধ্যে এ আমলে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। উভয় দেশের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয় যেমন—সম্পদ বণ্টন, বাংলাদেশে অবস্থানরত অবাঙালি পাকিস্তানী (বিহারী নামে পরিচিত) ফেরত নেয়ার ব্যাপারে সৃষ্ট অচলাবস্থা এবং এ ক্ষেত্রে দুটি দেশের বিদ্যমান ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগত অবস্থান দুটি দেশের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠতার দিকে নিয়ে যায়নি। তাই মুজিব আমলে বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককে সম্পর্কের প্রাথমিক পদক্ষেপ ও সূচনাপর্ব হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়।

বর্তমান প্রবন্ধে দুদেশের সম্পর্ক কিভাবে বৈরী থেকে ক্রমান্বয়ে সহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে তা দেখানো হবে। চূড়ান্ত পর্বে দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাপ্তিযোগ কি ঘটেছে সে বিষয় নির্দেশ করার চেষ্টা করা হবে।
১. বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্ক: প্রাক-স্বীকৃতি পর্ব (১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত)
শুরু থেকেই পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জেড. এ. ভুট্টো বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত নেতিবাচক মনোভাব দেখান। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার সময় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কট্টর বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের যুদ্ধবিরতি খসড়া প্রতিলিপি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেন এবং সাংবাদিকদের জানান, তিনি যুদ্ধবিরতি চুক্তি কিছুতেই মেনে নেবেন না। অবশ্য তার এই প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে পাকিস্তানী জেনারেলরা একই তারিখ রাতে আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং পরের দিনই অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কাছে তারা আত্মসমর্পণ করেন। যদিও এ সংবাদ পাওয়ার পরও ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া ছিল ‘বাংলাদেশ বলে কিছু নেই, আছে পূর্ব পাকিস্তান। ২
তবে ভুট্টোর মত একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, পাকিস্তানের এই ঘটনাপ্রবাহই তাকে রাষ্ট্রের কর্ণধার হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এই উপলব্ধি থেকেই ১৮ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়াম রজার্সের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি জানান, পাকিস্তানের দুটি অংশের বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য তিনি সদা সচেষ্ট থাকবেন।
২০ ডিসেম্বর ভুট্টো দেশে ফিরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত তার প্রথম ভাষণে বাংলাদেশকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ আখ্যা দিয়ে একে পাকিস্তানের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করেন। তিনি তার স্বভাবসুলভ আবেগময় বক্তৃতায় বাঙালি জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং ভুলের মাশুল যাতে দেশ বিভক্তির রূপ না নেয় সে দিকে লক্ষ্য রেখে পাকিস্তানের ঐক্যের জন্য বাংলাদেশের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। ভুট্টো বলেন,
“আমি মুসলিম বাংলার নেতা ও জনগণের কাছে যেতে চাই এবং বিদেশী কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে চাই। আমরা বিগত ২৪ বছর যেমন ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করেছি, ভবিষ্যতেও সে রকমভাবে বসবাসের জন্য নতুন একটা মীমাংসায় উপনীত হবো। তবে এই মীমাংসা অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে হতে হবে।” ৫
একই দিন প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেও তিনি পাকিস্তানের দুই অংশকে ঐক্যবদ্ধ করে নতুন সরকার গঠনের পক্ষে মত দেন। একাত্তরের মার্চ মাসে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানে অনীহা, নয় মাস জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে যোগসাজশ, সরকারি প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে ইরান, চীন সফর, সর্বোপরি উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দান সামরিক জান্তার প্রতি তার সমর্থনেরই প্রমাণ দেয়।
যদিও পাকিস্তানের ভাঙনে ভুট্টো তার দায়-দায়িত্ব এড়ানোর জন্য নিজের ভূমিকাকে আড়াল করতেই প্রতিষেধক হিসেবে আগাম ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য তার প্রচেষ্টার প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেন। নিজের এই লক্ষ্যসাধনে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য, জেনারেলদের অযোগ্যতা ও নারী কেলেঙ্কারির কাহিনী ডিসেম্বর মাসেই পাকিস্তানের টেলিভিশনে তুলে ধরা হয়। ৭
২০ ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়াসহ ৬ জন জেনারেলকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান এবং গণতন্ত্র ফিরে না আসা পর্যন্ত সামরিক শাসন বলবৎ রাখার ঘোষণার মাধ্যমে ভুট্টো যেমন একদিকে নিজের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করেন, অন্যদিকে তেমনি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য তার আন্তরিকতা প্রদর্শনের জন্য পাকিস্তানে বন্দি শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের অনুকূলে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এড়িয়ে এই উদ্যোগের পেছনে ভুট্টোর উদ্দেশ্য ছিল দুটি।
প্রথমত, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য পাকিস্তানীদের মধ্যে যে ক্ষোভ ছিল তাকে নিজের অনুকূলে আনা; দ্বিতীয়ত, ভারতকে এড়িয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকায়ন। এ ছাড়া শেখ মুজিবের সঙ্গে অনুষ্ঠিত একাত্তরের ২৭ ও ২৯ ডিসেম্বরের দুটি বৈঠকে ভুট্টো মুজিবকে যে কোনো মূল্যে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার আহ্বান জানান। ১০ শেখ মুজিব দেশে ফেরার আগে এ বিষয়ে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ভুট্টো পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে অন্তত কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেন। ১১
ভুট্টো প্রদত্ত এই প্রস্তাবে বলা হয়, পাকিস্তানের দুটি অংশ নিয়ে কনফেডারেশন হবে, তবে ভিন্ন অর্থনীতি, প্রশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি থাকবে।১২ একই সঙ্গে ভুট্টো মুজিবকে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যে কোনো পদ গ্রহণের প্রস্তাবও দেন।১৩ শেষ পর্যন্ত কনফেডারেশন গঠন সম্ভব না হলে শিথিল কনফেডারেশনের প্রস্তাবও দেন তিনি। উলপার্ট অবশ্য শেখ মুজিবের দেশে ফিরে গিয়ে জনসভার আয়োজন করা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করেছেন। ১৪ মুজিব-ভুট্টোর এই বৈঠক ছিল অত্যন্ত গোপনীয়, যে কারণে তাদের আলোচ্যসূচি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।

স্ট্যানলি উলপার্ট ছাড়া আর কোথাও উল্লিখিত বক্তব্যের সমর্থনে কোনোরকম প্রামাণ্য বিবরণ না পাওয়ায় বৈঠকের আলোচ্যসূচির সত্যতা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকতে পারে। তবে উলপার্ট নিজেও স্বীকার করেছেন, ভুট্টো পরবর্তীকালে মুজিবকে ব্ল্যাকমেইল করার কাজে এই বৈঠকের আলোচ্যসূচিকে ব্যবহার করেছেন। বৈঠকের পর এবং মুজিবের পাকিস্তানে অবস্থানকালেই ১৯৭২-এর ১ জানুয়ারি ভয়েস অব আমেরিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টো দুই অংশের ঐক্য এবং একটি রাজনৈতিক সমঝোতার ব্যাপারে তার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। ১৫
পরের দিনই করাচিতে ভুট্টোর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দেশটির নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে মুজিবকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঐ দিনই মার্কিন সাময়িকী ‘টাইমস’ ভুট্টোর বক্তব্যের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তের নেপথ্যে পাকিস্তানের উভয় অংশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমঝোতা কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেন। ১৯ যদিও রবার্ট পেইন মনে করেন যে, শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠকে কোনো চুক্তি বা ঐ জাতীয় কোনো সুবিধা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ভুট্টো মুজিবকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।১৭

মুজিবের মুক্তির পেছনে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় কারণ ছিল সক্রিয়। মুজিবকে মুক্তি না দিলে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিদের যে ফিরিয়ে আনা যাবে না ভুট্টো সেটা তার বিভিন্ন বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে নয় মাস পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ এবং নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবকে বন্দি ও তার প্রহসনমূলক বিচারের উদ্যোগ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইয়াহিয়া বহির্বিশ্বে নিন্দিত হয়েছিলেন।
এই প্রেক্ষাপটে ভুট্টো মুজিবকে মুক্তি দিয়ে নিজেকে একজন প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালান। তবে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ ভুট্টো এই স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একক দায় না নিয়ে ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি করাচিতে প্রায় এক লাখ লোকের এক সমাবেশে মুজিবের মুক্তির জন্য জনতার রায় চান। উপস্থিত জনতা ইতিবাচক মত দিলে ভুট্টো মুজিবের মুক্তির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ঐ দিনই রেডিও পাকিস্তান এই মুক্তির কথা ঘোষণা করে।
সরকারি দল পিপিপি ছাড়াও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং ন্যাপ একে স্বাগত জানায়। কারণ, তাদের বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত ছিল পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান’ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ সহায়ক। ভুট্টো নিজেও বিভিন্ন বক্তৃতায় অনুরূপ মত দেন। মুজিবের মুক্তির পেছনে ভুট্টোর আরো যে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য কাজ করে তা হলো: প্রথমত, ভুট্টো এর মাধ্যমে এটাই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যে, নয় মাসের যুদ্ধে তার ভূমিকা ছিল সামরিক শাসকদের মতের বিরুদ্ধে।
বন্দিদশা থেকে মুজিবকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশে তিনি নিজেকে একজন মার্জিত, মধ্যপন্থী, মধ্যস্থতাকারী ও গ্রহণযোগ্য পাকিস্তানী নেতা হিসেবে উপস্থাপিত করার এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং বহির্বিশ্বে একাত্তরে পালিত নিজের ভূমিকা আড়াল করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সহানুভূতিও কামনা করেন। তৃতীয়ত, মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানের দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ড উদ্ধার করাসহ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পথ সুগম করা।
সবশেষে বলা যায়, ৩ জানুয়ারির জনসভাতেই ভুট্টো বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে তার ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপও অব্যাহত ছিল। ১৮ তবে ভুট্টো মুজিবের মুক্তির ঘোষণা দিলেও সঙ্গে সঙ্গে তার মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেননি। এর মাধ্যমে ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সমঝোতার সর্বশেষ চেষ্টা চালান। এ সময় মুজিবেকে প্রথমে তুরস্ক বা ইরানে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে মুজিব তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯
তাই ৮ ফেব্রুয়ারি আকস্মিকভাবে মুজিবকে লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভুট্টো মুজিবকে সরাসরি কয়েকটি কারণে ঢাকা পাঠাতে চাননি। প্রথমত, এর ফলে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হত। এ ছাড়া একটি স্বাধীন দেশে পাকিস্তানের মত শত্রুপক্ষের বিমান অবতরণের জটিলতাও ছিল। শেখ মুজিব নিজেই পরে স্বীকার করেন পাকিস্তান সরকার তাকে লন্ডনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং একজন বন্দি হিসেবে এ ব্যাপারে তার করার কিছুই ছিল না। ২০ মুজিব তার উপদেষ্টা ড. কামাল হোসেনসহ ঐ দিন লন্ডন এবং ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির পর ঢাকায় পৌঁছেন।

ঢাকা ফিরে ঐ দিনই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল সমাবেশে মুজিব ভুট্টোর প্রস্তাবিত বিশেষ সম্পর্কের বিপক্ষে মত দিয়ে বলেন, “পাকিস্তানী ভাইয়েরা আপনাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। আমি চাই আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সেনাবাহিনী আমাদের অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে, আমাদের মা-বোনের মর্যাদাহানি করেছে। তবুও আপনাদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষ নেই। আপনারা স্বাধীন থাকুন, আমরাও স্বাধীন থাকি। বিশ্বের অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের সাথে আমাদের যে ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে, আপনাদের সাথেও আমাদের শুধু সেই ধরনের বন্ধুত্ব হতে পারে। “২১
শেখ মুজিবের এই ভাষণে দুটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। প্রথমত, কনফেডারেশন ও শিথিল সম্পর্ক-সংক্রান্ত ভুট্টোর প্রস্তাবের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল তার এই ভাষণের উল্লিখিত অংশটুকু অন্যদিকে সদ্য স্বাধীন দেশে প্রদত্ত তার রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রথম ভাষণে পাকিস্তান ও পাকিস্তানী বাহিনী সম্পর্কে কঠোর বক্তব্য না দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সমতা ও সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে বন্ধুত্ব স্থাপনের আহ্বান জানান।
মুজিবের এই বক্তৃতা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক প্রচার পেলেও ১৩ জানুয়ারি লাহোরে ভুট্টো সাংবাদিকদের ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেন। পাশাপাশি তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে আবেদনও রাখবেন তারা যেন ‘তথাকথিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেন। কারণ মুজিবের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে তার কিছুটা সময়ের প্রয়োজন।
বাংলাদেশকে কয়েকটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি তার সমঝোতার পথে বাধার সৃষ্টি করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি মুজিবের ১০ জানুয়ারির ভাষণকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ না করার অনুরোধ জানান, কারণ তার ভাষায় মুজিবের এটাই শেষ কথা নয়। ২২ সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো বাংলাদেশকে চালসহ অন্যান্য পণ্য সাহায্য, দুটি দেশের মধ্যে বিমান সার্ভিস চালু এবং ২৮০০০ বাঙালি সৈন্যকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাবও দেন।২৩
ভুট্টোর ঐ দিনের ভাষণের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে পরের দিনই মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের সব দ্বার চিরদিনের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং টিকে থাকার জন্যই এর প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ২৪ পরের দিন মুজিব আরো বলেন, ভুট্টো যদি মনে করেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একটি রাষ্ট্র, তবে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আমি পাকিস্তানেরও প্রেসিডেন্ট, পশ্চিম পাকিস্তানে নিজের প্রতিনিধি নিয়োগেরও ক্ষমতা রাখি। ২৫

ভুট্টো মুজিবের এই উক্তিকে কূটনৈতিকভাবে ব্যবহার করেন এবং পাকিস্তানের ঐক্যের স্বার্থে মুজিবের হাতে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের ক্ষমতা অর্পণ করে রাজনীতি থেকে অবসর নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তিনি মুজিবকে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী যে কোনো একটি পদ গ্রহণের পুরনো প্রস্তাবও নতুন করে দেন । ২৬
অবশ্য মুজিব ভুট্টোর কূটনৈতিক চাল বুঝতে পেরে ১৮ জানুয়ারি বলেন, ‘আমি পাকিস্তান চাই না, বাংলাদেশ হচ্ছে এখন বাস্তব সত্য। বাংলাদেশের একজন সরকারী মুখপাত্র এক বিবৃতি মারফত ঐ দিনই বলেন, অথচ এই ভুট্টোই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধা দানকারীদের অন্যতম ছিলেন। ১০ মাস পর তার এই প্রস্তাব সত্যিই বিলম্বিত সিদ্ধান্ত ২৭
মুজিবের পরিষ্কার বক্তব্য সত্ত্বেও ভুট্টো স্বীকৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রচারণা এবং তার জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ৮টি মুসলিম দেশ সফরের আগেভাগে স্বীকৃতির প্রশ্নে বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করতে অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা অব্যাহত রাখেন। ভুট্টো তার সফরের প্রাক্কালে অর্থাৎ ১৯ জানুয়ারি বলেন, “অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোতেই পাক ভারত উপমহাদেশের সমস্যার সমাধান করতে হবে।
পাকিস্তানের এখন প্রথম কাজ হচ্ছে টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে একটি নতুন দেশ গড়ে তোলা।”২৮ কিন্তু বাংলাদেশের ঐক্যের বিপক্ষে বক্তব্য, জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দিদের ভারতে স্থানান্তর, ২৪ জানুয়ারি দালালদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন, বাংলাদেশ সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত ও আইন প্রণয়নের প্রচেষ্টায় ভারতে আটক পাকিস্তানী বন্দিদের ব্যাপারে পাকিস্তান চিন্তিত হয়ে পড়ে।
ভুট্টো জানুয়ারি মাসে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ চালান এবং মুসলিম দেশ সফরের মাধ্যমে ভারতের দখল করে নেয়া পাকিস্তানী ভূখণ্ড প্রত্যার্পণ এবং পাক যুদ্ধবন্দিদের মুক্তির জন্য ভারত ও বাংলাদেশের ওপর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির প্রয়াস পান। একই সাথে তিনি সফরকারী ৮টি দেশের (ইরান, তুরস্ক, মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, সিরিয়া, লিবিয়া ও মিসর) রাষ্ট্রপ্রধানদের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্যের সর্বশেষ সুযোগ দেয়ার অনুরোধ জানান।
পাশাপাশি জানুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী ২১টি দেশের মধ্যে ১০টি দেশের সঙ্গে পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ৩১ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং ব্রিটেনের আশু স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণায় পাকিস্তান কমনওয়েলথ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৯ জানুয়ারি মাসে এ সব উদ্যোগের পাশাপাশি পাকিস্তান সরকারি পর্যায়ে ঈদের উৎসব পালন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, ভুট্টোর ভাষায়,
“দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ পূর্বাঞ্চলের জনগণকে বিদেশী আগ্রাসনের আওতায় রেখে পশ্চিম পাকিস্তান ঈদ উৎসব পালন করতে পারে না।”৩০
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য ছিল রীতিমত হাস্যকর, কেননা ২১টি দেশ বাংলাদেশকে যেখানে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তার স্বাধীনতা লাভের পর দেড় মাস অতিবাহিত হয়েছে, তখনও এ ধরনের সিদ্ধান্ত রীতিমত কূটনৈতিক শিষ্টাচার-বহির্ভূতও ছিল। যদিও তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সেটা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

তবে ভুট্টোর এই অপপ্রচার ও হুমকি সত্ত্বেও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়টি থেমে থাকেনি। বরং ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম দেশ সেনেগাল, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াসহ আরো ২৮টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্যে ব্রিটেন, পশ্চিম জার্মানি, সুইডেন, জাপান, ফ্রান্স ও কানাডার মত দাতা দেশও ছিল। বিপুল সংখ্যক দেশের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভুট্টোর চীন সফর, ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফর পাকিস্তানের জন্য ঈন্সিত ফল বয়ে আনেনি।
আরও দেখুন…