[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

প্রাথমিক জীবন

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ প্রাথমিক জীবন। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।

প্রাথমিক জীবন

 

প্রাথমিক জীবন

প্রাথমিক জীবন

আমি নিয়াজি। আমার পুরো নাম আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি। সংক্ষেপে এএকে নিয়াজি। তবে আমি ‘টাইগার নিয়াজি’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। আর এই অনন্য খেতাবটা আমাকে দিয়েছিলেন ১৬১ ভারতীয় পদাতিক ব্রিগেডের চৌকস ও মেধাবী কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় (মায়ানমার) আমার বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পশ্চিম পাকিস্তানে আমাকে খেতাব দেওয়া হয় তারিক-বিন-জিয়াদ’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) আমাকে কোহিমাতে মিলিটারি তারকা দেওয়া হয় এবং ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে আমি দুই বার ‘হেলাল-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত হই, একবার ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আর অন্যবার ১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদেরে সাথে যুদ্ধে। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে ‘সিতারা-ই-খিদমত’ এবং ‘সিতারা-ই- পাকিস্তান’। এ দুটি পুরস্কার অনেক গৌরবের ও সম্মানের।

এ যাবৎ আমি অনেক পদক পেয়েছি। শুনে দেখলে চমকে উঠতে হয়। আমি ২৪টা পদক পেয়েছি। আমাকে অনেক প্রশংসাপত্র দেওয়া হয়েছে। মেজর থেকে আরো ওপরে আমার সব পদোন্নতি হয়েছে খুব দ্রুত।

আমাকে যখন ইস্টার্ন গ্যারিসনের কর্তৃত্ব দেওয়া হয়, যেটা ছিল সামরিক বাহিনীর তৃতীয় সিনিয়র পদ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তালিকায় আমি ছিলাম দ্বাদশ। বিভিন্ন সেক্টর পরিদর্শনে গেলে আমার সেনা দলকে দেখে সবাই চিৎকার দিতো “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, নিয়াজি তদবির, আল্লাহ আকবার। এসব ধ্বনি আমাকে উৎসাহ দিতো। আমার ভেতরে দেশপ্রেম জাগ্রত করতো।

আমার জীবনের অন্যতম গৌরব হলো- আমাকে ইপকাফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস)-এর সদস্যদের কমিশন এবং পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসনের সদস্যদের ‘এস জে’ (সিতারা-ই-জুরাত) বীরত্বপদক প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়।

ভারতীয়রা আমাকে ‘সৈনিকদের সেনাপতি’ বলে সম্বোধন করতো। তবে হ্যাঁ, আমার বীরত্বের জন্য পুরস্কার প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেছি নিজেকে জাহির করার জন্য নয়, বরং আমার কর্তব্য পালনে কতোটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য। কর্তব্য পালনে সর্বদা আমি দেশকে নিজের চেয়ে উপরে স্থান দিয়েছি।

আমি আমার কর্তব্য কাজে কখনো সামান্যতম গাফলতি করি নি। এটা কখনো আমার চরিত্রের মাঝে ছিল না। এবার আমি আমার জন্ম নিয়ে কিছু বলি। আমি ১৯১৫ সালে বালো খেল নামে একটা ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। গ্রামটা পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি শহর থেকে দুই মাইল দূরে সিন্ধু নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত। বর্তমান মিয়ানওয়ালি এবং মিয়ানওয়ালি জেলার ইসা-খেল্‌ তহসিল একসময় বানু জেলার অংশবিশেষ ছিল।

সেই ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশরা এক অজ্ঞাত কারণে বানু জেলা থেকে এ অংশটা কেটে নেয় এবং নতুন মিয়ানওয়ালি জেলা গঠন করে। ফয়সালাবাদ জেলার লুন্দিয়ানওয়ালায় ১৪টি চক (গ্রাম) রয়েছে নিয়াজিদের, যারা বসতি স্থাপন করে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। স্থানীয় লোকজন এ এলাকাকে এখনো ‘বান্ন টুকরি’ (খণ্ড) হিসেবে ডেকে থাকে। এ অঞ্চলে অনেক ঐতিহ্য রয়েছে।

নিয়াজি একটা নামকরা পরিবার। আমি জন্মগ্রহণ করি এই নিয়াজি পরিবারে। নিয়াজিরা হলো আফগানদের বংশধর যারা গজনি ও কান্দাহার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসে এবং ছড়িয়ে পড়ে ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায়। তবে নিয়াজিদের বেশির ভাগ লোক বাস করে মিয়ানওয়ালি জেলাতে।

এ জেলার সিন্ধু নদের উভয় তীরে তাদের বসবাস। এটা পাঠানদের বসতির শেষ পূর্বপ্রান্ত। এ ছাড়া নিয়াজিরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জেলা বান্নু কোহাট ও ডেরা ইসমাইল খান এবং বেলুচিস্তানের কোয়েটা ও পিসি জেলাতেও বসবাস করে। করাচি ও ফয়সালাবাদেও তাদের অনেক পরিবারের বসতি রয়েছে।

১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশ বিভাগের পর ভারতের পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুর ও জলন্ধরে বসবাসকারী বহু নিয়াজি পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে। যদিও কিছু রয়ে গেছে, বিশেষ করে বেরিলি ও রামপুরে। নিয়াজিদের একটা বিরাট অংশ এখনো আফগানিস্তানে রয়ে গেছে। সেখানে তারা বহু বছর ধরে বসবাস করছে।

তবে নিয়াজিদের গ্রামীণ জীবনে পরিলক্ষিত হয় উপজাতীয় প্রথা ও ঐতিহ্য। আজকের দিনেও সেখানে বন্দুকের জয়। প্রতিশোধ এবং পাল্টা প্রতিশোধের ঘটনা একটা সাধারণ দৃশ্য। প্রতিশোধ গ্রহণের আদিম ইচ্ছায় একটা পরিবার অধিক পুত্র সন্তান কামনা করে।

সবচেয়ে বেশি মূল্য দেওয়া হয় গাঢ় বন্ধুত্ব এবং আনুগত্যকে। নিয়াজিরা সৈনিক হিসেবে চাকরি করে আসছে। শত শত বছর ধরে। সৈনিক বৃত্তি হলো তাদের আদি ও সম্মানজনক পেশা। তাদের কবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র।

নিয়াজিদের মধ্যে কিছু বিখ্যাত জেনারেলের জন্ম হয়েছে। মোগল সম্রাট বাবর তার বইয়ে লিখেছেন যে, হিন্দুস্তান অভিযানের সময় যখনই তিনি নিয়াজি অধীন ভূখণ্ড। অতিক্রম করতেন, চলাচল কিংবা তাঁবুতে থাকাকালীন আক্রমণের ভয়ে তিনি নিজেই নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখাশুনা করতেন। নিয়াজিরা বাবরকে নিরাপত্তা দিতেন।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, নিয়াজিদের স্বর্ণযুগ শুরু হয় শেরশাহ সুরি ক্ষমতায় এলে। ওলাফ ক্যারোর মতে, এ গোত্রের বিপুল সংখ্যক লোক শেরশাহের সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। ১৫৪০ সালে তার বিশ্বস্ত সেনাপতি হায়বাত খান, যিনি একজন নিয়াজি, বাবরের পুত্র মোগল বাদশাহ হুমায়ুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ে বিরাট অবদান রাখেন। এরপর শেরশাহ পাঞ্জাব ছাড়েন হায়বাত খানের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে। হায়বাত খান ৩০ হাজার আফগান অশ্বারোহী সেনাদল নিয়ে দখল করেন রোটাস দূর্গ।

যখন তিনি বালুচদের কাছ থেকে মুলতান এবং তার আশেপাশের অঞ্চল দখল করেন, তখন তাকে সর্বোচ্চ পদে উন্নীত করা হয় এবং তাকে খেতাব প্রদান করা হয় ‘মসনদ-ই-আলা, আজম হুমায়ুন’। এ খেতাব ইতোপূর্বে মাত্র দুজনকে দেওয়া হয়। ইশা খান নিয়াজি শেরশাহ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন ভারত থেকে হুমায়ুনকে বিতাড়িত করার জন্য। সেটা একটা বিশাল ইতিহাস।

আরো জানা যায়, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে সাবমেরিন ‘গাজি’-এর কমান্ডার হিসেবে অ্যাডমিরাল ক্রোমত রহমান নিয়াজি তার সাহসিকতা প্রমাণ করেছিলেন ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। তার চমৎকার কৃতিত্বের জন্য তাকে ‘এস জে (সিতারা-ই-জুরাত) খেতাব প্রদান করা হয়।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ক্যাপ্টেন মেহবুব খান নিয়াজি কোনো পাকিস্তানি অফিসার যিনি প্রথম এস জে পুরস্কার পেলেন কাশ্মীর অপারেশনে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ক্যাপ্টেন হেদায়েত উল্লাহ খান নিয়াজি (পরে মেজর জেনারেল) এবং মেজর আব্দুর রব নিয়াজি (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)-কে এস জে’ খেতাব প্রদান করা হয়।

রেঞ্জার্সের নায়েক আব্দুল সাত্তার খান নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তানে তার সাহস ও বীরত্বের জন্য ভারতীয়রা সামরিক মর্যাদায় সমাধিস্থ করে। পুলিশের ডেপুটি সুপারেন্টেডেন্ট ইকরাম উল্লাহ খান নিয়াজিকে দস্যুদের বিরুদ্ধে অতুলনীয় সাহস। এবং বীরত্ব দেখানোর জন্য পুলিশ পদক প্রদান করা হয়। তার বীরত্বের নিদর্শন হিসেবে রাভি ব্রিজের কাছে (লাহোর) একটা গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে।

আজো তাকে তার নামে সবাই চেনে।কেবল সমরে নয়, তাদের অবদান অন্যান্য ক্ষেত্রেও। খেলাধুলাতেও নিয়াজিরা যথেষ্ট নাম করেছেন। তারিক এবং কাইয়ুম নিয়াজি হকিতে অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ক্রিকেট জগতের কিংবদন্তি ইমরান খান নিয়াজিরতো কোনো জুড়ি নেই।

আমার ছেলে মেজর আমান উল্লাহ খান নিয়াজি হলো পাকিস্তানের দ্রুততম দৌড়বিদ এবং আমার ছোটো ছেলে হাবিব উল্লাহ নিয়াজি তেহরান থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটানা গাড়ি চালনা প্রতিযোগিতায় ট্রফি পেয়েছে। সারা পাকিস্তান তাকে চেনে।

আমি ছোটো বেলা আমার জন্মস্থান গ্রামে অতিবাহিত করি। আমার ছেলেবেলায় গ্রামীণ জীবন ছিল একেবারে সাধারণ। জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি ছিলেন পরিবারের কর্তা এবং তার ছিল সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা।

রাতে মুরব্বিরা বৈঠকখানায় বসে হুক্কা খেতে খেতে কিংবা এক চিমটি নস্যি নিতে নিতে নানা ধরনের গল্প করতেন। কাবাডি ছিল একটি জনপ্রিয় খেলা। দুই গ্রামের মধ্যে খেলা হতো এবং ছেলে বুড়ো সবাই তা দেখতো এবং প্রাণ ভরে উপভোগ করত।

কোয়েল, তিতির এবং খরগোশ শিকার খুব জনপ্রিয় ছিল। বর্ণা দিয়ে শূকর শিকার ছিল একটি সাধারণ খেলা। ছোটো ছোটো ছেলেদের ব্যক্তিগত অস্ত্র ছিল গুলতি। এটা তারা হাতে রাখতো কিংবা গলায় ঝুলিয়ে রাখতো। সুযোগ পেলেই শিকারে মেতে উঠতো।

আমার জন্য স্থান গ্রামটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল মাত্র একটি। মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ছিল মিয়ানওয়ালিতে। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে। বাচ্চাদের কিংবা তাদের বাবা-মায়ের কারো স্কুলের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। প্রতিটা শিশু যেত গ্রামের মসজিদে, প্রার্থনা করতো এবং পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতো।

গ্রামে প্রবেশিকা (বাংলাদেশে বলা হয় এসএসসি) পরীক্ষাকে বিবেচনা করা হতো উন্নতি লাভের সর্বোচ্চ সিঁড়ি। মিয়ানওয়ালি জেলায় কোনো কলেজ ছিল না। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিই ‘ওয়াই’ ক্যাডেট হিসেবে। শুরু হয় আমার সৈনিক জীবন।

আমার সৈনিক জীবনের শুরুতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ছিল। ব্রিটিশ। ভারতীয়রা কেবল পদোন্নতি পেত সুবেদার মেজর, সুবেদার অথবা জমাদার র‍্যাংকে, যাকে বলা হতো ‘ভিসিও’ (ভাইস রয়ে’স কমিশন্ড অফিসার্স)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার কিছু নির্বাচিত ভারতীয়দের কমিশন প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্যান্ডহার্টে পাঠান হতো এবং তাদেরকে বলা হতো ‘কেসিও’ (কিংস কমিশনড অফিসার্স)। পরে এই উদ্দেশ্যে দেরাদুনে ইনডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি (আইএমএ) খোলা হয়।

 

প্রাথমিক জীবন

 

আইএমএ-তে ঢুকতে হতো একেবারে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। সশস্ত্র বাহিনী থেকেও কিছু কিছু প্রার্থীকে আইএমএ-তে নেওয়া হতো। তাদেরকে ইন্ডিয়ান আর্মি স্পেশাল ক্লাস উত্তীর্ণ হতে হতো। তারপর মুখোমুখি হতে হতো সিলেকশন বোর্ডের।

দেরাদুন থেকে যেসব ক্যাডেট বের হয়ে আসতো, তাদেরকে বলা হতো ‘আইসিও’ (ইন্ডিয়ান কমিশন্ড অফিসার্স)। এই আইসিও- দের আবাসিত করার জন্য কয়েকটা ভারতীয় ব্যাটালিয়ন এবং রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। সেটা অবশ্য পরের দিকের ঘটনা। এখানে পাকিস্তানিদের সংখ্যা ছিল একেবারে কম।

আরও দেখুন:

Leave a Comment