আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ পূর্ব পাকিস্তানের পতন ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।
পূর্ব পাকিস্তানের পতন ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল
পূর্ব পাকিস্তানের পতন ছিল একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল
মে ১৯৭১ :
আমাকে পর্যুদস্ত ও পিছু হটে যাওয়া গেরিলাদের পশ্চাদ্ধাবনে ভারতের প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় নি। যদিও রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভারতে প্রবেশ করা ছিল সবদিক থেকে যুক্তিযুক্ত। ভারতীয়রা তখন আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল এবং আমাদের ভূখণ্ডে গোলাবর্ষণ করছিল। আমাকে ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হলে অংকুরেই বিদ্রোহ নস্যাৎ হয়ে যেতো এবং পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ থাকতো।
সেপ্টেম্বর ১৯৭১ :
লারকানা এবং এমএম আহমেদ পরিকল্পনার পরবর্তী ঘটনা। শত্রুদের নতুন করে সৈন্য সমাবেশ সম্পর্কে আমাকে আমার চিফ অব স্টাফের ব্রিফিং। সব যোগাযোগ কেন্দ্র রক্ষা এবং সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ। মূল দায়িত্ব সংশোধন করার ক্ষেত্রে কোনো লিখিত নির্দেশ না দেওয়া । সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা এবং একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার ব্যাপারে আমার সুপারিশ বাস্তবায়ন না করা।
অক্টোবর ১৯৭১ :
সেনাবাহিনী প্রধানের পূর্ব পাকিস্তান সফর। আমার কৌশলগত পরিকল্পনা অনুমোদন। সেনাবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ না দেওয়ার এবং ভূখণ্ড না হারানোর ওপর জোর দেন। আমাকে দেশের অভ্যন্তরে ও সীমান্তে সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।
নয়া দিল্লিতে নিযুক্ত আমাদের রাষ্ট্রদূত সাজ্জাদ হায়দার ভারতের আসন্ন হামলা সম্পর্কে বার বার সতর্ক করায় তাকে তুরস্কে বদলি করা হয়। জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স সব পর্যায়ে বিদ্রোহ দমন তৎপরতায় আমাকে রিজার্ভ সৈন্য ব্যবহারের নির্দেশ দেয়। এতে আমি চরম সংকটে পড়ে যাই।
প্রতিশ্রুত অতিরিক্ত সৈন্য না পাঠানো। ট্যাংক, গোলন্দাজ, ইঞ্জিনিয়ার্স ও সাজ-সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণ না করা। এতে যুদ্ধ পরিচালনায় সমস্যা দেখা দেয়। গভর্নর মালিক আওয়ামী লীগের বাদবাকি এমএনএ-দের সরকারের অন্তর্ভুক্ত করার এবং পলাতক এমএনএ-দের আসন পূরণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার এ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করা হয়।
১৫ই নভেম্বর ১৯৭১ :
মেজর জেনারেল জামশেদ এবং আমার চিফ অব স্টাফ পূর্ব পাকিস্তানে। মোতায়েনকৃত হালকা ডিভিশনগুলোকে আর্টিলারি, ট্যাংক এবঙ অন্যান্য সাজ- সরঞ্জাম সরবরাহ করে এগুলোকে পূর্ণাঙ্গ ডিভিশনে রূপান্তরিত করার জন্য সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন।
কিন্তু এ অনুরোধে কর্ণপাত করা হয় নি। সেনাবাহিনী প্রধানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোথাও কোনো ঘাটতি পূরণ করা হয় নি। এতে ভারতীয় হামলা মোকাবেলায় পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েনকৃত সৈন্যরা খুবই দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়।
১৯শে নভেম্বর ১৯৭১ :
খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ঈদের দিনে পূর্ণাঙ্গ হামলা শুরু করার পরিকল্পনা করছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় ৮টি ব্যাটালিয়ন, ১১১ পদাতিক ব্রিগেড এবং একটি ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্ট পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
১১১ ব্রিগেড পাঠানোর পরিকল্পনা বাতিল করা হয় এবং এ ব্রিগেডকে ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে রেখে দেওয়া হয়। পরবর্তী ৪ দিনে মাত্র ২টি ব্যাটালিয়ন ঢাকা এসে পৌঁছে। বাদ- বাকি ব্যাটালিয়নের বরাদ্দ বাতিল করা হয়। ঢাকা প্রতিরক্ষায় বরাদ্দকৃত সৈন্যরা কখনো এসে পৌঁছে নি।
২১শে নভেম্বর ১৯৭১ :
দিনটি ছিল ঈদের দিন। ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করে। শুধু ভাইস চিফ অব জেনারেল স্টাফকে এ সংবাদ দেওয়ার জন্য খুঁজে পাওয়া যায়। চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান খুব ভালোভাবেই অবগত ছিলেন যে, ঈদের দিনে ভারত হামলা করবে। এ কথা জেনেও তিনি লাহোরে ঈদ উদযাপন করছিলেন।
২২শে নভেম্বর ১৯৭১ :
প্রেসিডেন্ট ও সেনাবাহিনী প্রধান শিকারের জন্য শিয়ালকোটে চলে যান এবং জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে ব্রিফিং-এ যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানান। প্রেসিডেন্টের জঘন্য উক্তি, ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য দুআ ছাড়া আর কী করতে পারি?’
পাকিস্তান আক্রান্ত । কিন্তু ভারতীয় আগ্রাসন বন্ধে নিরাপত্তা পরিষদের যাবার ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের কোনো উদ্যোগ নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধও শুরু করা হয় নি। পরিকল্পনা ছিল যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ করা হবে পশ্চিম পাকিস্তানে।’
২২শে নভেম্বর ১৯৭১ থেকে ২রা ডিসেম্বর ১৯৭১ :
কোনো কূটনৈতিক অথবা রাজনৈতিক উদ্যোগ নেই। অথবা ঘাটতি পূরণ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা জোরদার করারও উদ্যোগ নেই। জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোর বিমানবন্দরে এক বিবৃতিতে বলেন যে, ‘পাকিস্তান ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের উত্থাপন করতে যাবে না। সম্ভবত এটাই একমাত্র উদাহরণ যেখানে আগ্রাসনের শিকার একটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদে যেতে চায় নি।
৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ :
পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডকে পূর্বাহ্নে অবহিত করা ছাড়া ভারতের ওপর পশ্চিম রণাঙ্গনে স্থল হামলার পরিবর্তে বিমান হামলা ।
৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ :
নিরাপত্তা পরিষদে পোল্যান্ডের প্রস্তাব উত্থাপন। এ প্রস্তাবে যুদ্ধ বিরতি ও রাজনৈতিক মীমাংসার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু পাকিস্তান এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স আমাদেরকে পূর্ব পাকিস্তানে শত্রু বাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে পরামর্শ দেয় যাতে তারা পশ্চিম রণাঙ্গনে ছুটে যেতে না পারে। এ জন্য আমাকে যুদ্ধবিরতি নাগাদ শত্রুদের মোকাবেলায় দিনাজপুর, রংপুর, খুলনা প্রভৃতি জায়গায় পর্যান্ত সৈন্য মোতায়েন রাখতে হয়েছে।
এসব জায়গায় সৈন্য মোতায়েন করায় রাজশাহী সেক্টরে লড়াইয়ে আমার পরিকল্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাকে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স থেকে জানানো হয়েছিল যে, শিগগির চীনা সহায়তা আসছে। এটা ছিল একটি প্রহসন। আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার
একটি অপচেষ্টা।
৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
এয়ার মার্শাল রহিম খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে ছিল নিষ্ক্রিয়। জেনারেল টিক্কা খান পরিকল্পনা অনুযায়ী হামলা চালান নি। ভারতীয় নৌবাহিনী করাচি নৌঘাঁটি আক্রমণ করে। কিন্তু আমাদের নৌবাহিনী কোনো তৎপরতা চালায় নি।
৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
গভর্নর হাউস থেকে প্রেসিডেন্টের কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠিয়ে বলা হয়। যে, ইন্টার্ন ফ্রন্ট পতনের মুখে। প্রকৃত ঘটনা ছিল যে, তখনো ইস্টার্ন ফ্রন্টের পতন ঘটার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। যশোর থেকে পিছু হটে ব্রিগেডিয়ার হায়াত ও মঞ্জুর দুটি ভারতীয় ডিভিশনকে খুলনা ও কুষ্টিয়ায় তাড়িয়ে নিয়ে যান। শত্রুর দ্বিতীয় কোর সংযোগ হারিয়ে ফেলে এবং এর ডিভিশনগুলোকে তাদের লক্ষ্যস্থল থেকে বহুদূরে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
সিলেট, ভৈরব, ময়নামতি, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, চালনা, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, নাটার, রাজশাহী প্রভৃতি যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। হিলিতে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল এবং পশ্চিম দিকে লড়াইয়ে আমাদের অগ্রগতি হচ্ছিল যে, ইস্টার্ন কমান্ডের বিপর্যয় ঘটছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল পুরোপুরি বিপরীত। আমরা তখনো তীব্র লড়াই চালাচ্ছিলাম। অন্যদিকে, ওয়েস্টার্ন গ্যারিসনের পতন ঘটেছিল অথবা পতন ঘটতে যাচ্ছিল।
পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতকে অবাধে সমুদ্র, অন্তরীক্ষ ও স্থলে হামলা চালানোর সুযোগ দেওয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে যেসব রিপোর্ট পাঠানো হয় আমি ছিলাম সে ব্যাপারে পুরোপুরি অজ্ঞ।
৮ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স থেকে আমার কাছে একটি বার্তা পাঠিয়ে বলা হয় যে, চীনাদের তৎপরতা শুরু হয়েছে। কিন্তু তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভারতীয় আগ্রাসন সম্পর্কে জাতিসংঘকে অবহিত করতে এতো সময় কেন লাগল তাও একটি দুর্বোধ্য রহস্য।
পশ্চিম রণাঙ্গনে হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ৮ই ডিসেম্বর জাতিসংঘে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো তিন দিনে নিউ ইয়র্কে পৌঁছেন। সেখানে গিয়েই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। (তার অসুখে কোনো ডাক্তার ডাকা হয় নি। কন্যা বেনজির জুলফিকার আলী ভুট্টোও ছিলেন একই হোটেলে। তিনিও তার পিতাকে দেখতে যান নি)।
৯ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
রাও ফরমান ঢাকাকে একটি উন্মুক্ত নগরী’ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেন। এ প্রস্তাব ছিল তার নিজেকে রক্ষা, ইস্টার্ন কমান্ডকে দোষারোপ এবং ঢাকার অভ্যন্তরে ও বাইরে মোতায়েন আমার সেনাদের একটি অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়ার আরেকটি চক্রান্ত।
এ প্রস্তাবে প্রকারান্তারে সকল অবাঞ্ছিত শক্তিকে এগিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং বুঝানো হয় যে, একটি গুলি ছোঁড়ার ক্ষমতাও আমার নেই। এটা ছিল আমার সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার একটি সুচতুর চক্রান্ত। ফরমান এ প্রস্তাব দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত।
গভর্নর হাউস থেকে পাঠানো আরেকটি বার্তায় প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দেওয়া হয়। আমি দ্বিমত পোষণ করি এবং গর্ভনরের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের কাছে একই বার্তায় শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করি।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট আমাকে গভর্নরের নির্দেশ মেনে নিতে বলেন। প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক সমাধানসহ যে কোনো মীমাংসায় পৌঁছার ক্ষমতা গভর্নরের ওপর ন্যস্ত করেন। পূর্ব পাকিস্তান সংকটে রাজনৈতিক মীমাংসা করা গভর্নরের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ, মুজিব ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি।

১০ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
গভর্নর যুদ্ধবিরতি, ক্ষমতা হস্তান্তর ও পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে প্রত্যাবাসনের একটি প্রস্তাব জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তরে প্রেসিডেন্টের অনুমতি কামনা করেন। প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ছাড়াই ফরমান এ অতি গোপনীয় বার্তা জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করেন। জাতি সংঘ প্রতিনিধি এ বার্তা তৎক্ষণাৎ জাতিসংঘে পাঠিয়ে দেন।
ফরমান ঢাকা ও পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করার জন্য ফ্রান্স, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের কন্সাল জেনারেলদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি তাদের সাথে যোগাযোগও করতেন। তিনি জাতিসংঘ ও চীনা প্রতিনিধি দলকেও একই আহ্বান জানান।
ফরমান আমাকে অথবা গভর্নরকে না জানিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের সাথেও যোগাযোগ করেছিলেন। একইভাবে, আমাকে অথবা গভর্নরকে অবহিত না করে তিনি উপরে উল্লিখিত বার্তা জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করেন। রুশ কন্সাল জেনারেলের সাথে তার যোগাযোগ সম্পর্কেও আমাদের দুই জনকে অন্ধকারে রাখা হয় ।
১১ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
সেনাবাহিনী প্রধান আমাকে গভর্নরের নির্দেশ মেনে নিতে বলেন। সোজা কথা, আমাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সৈন্যদের নিরাপত্তা ও অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার প্রশ্ন ওঠে
ফরমান আগের দিন জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে যে বার্তা হস্তান্তর করেছিলেন পরদিন সকালে রুশ কন্সাল জেনারেল ফরমানের কাছে টেলিফোন। করে জানান যে, তার সরকার এ বার্তায় বর্ণিত শর্তাবলি মেনে নিয়েছে। রুশ কন্স্যুলেটে ফরমানকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দান এবং নিরাপদে পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।
১২ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান আমাকে আরেকটি মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে পশতুতে বলেছিলেন, “উত্তর দিক থেকে পীত এবং দক্ষিণ দিক থেকে শ্বেতাঙ্গরা আসছে। আমাকে ৩৬ ঘণ্টা টিকে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়।
বলা হয় যে, এরপরই উত্তর দিকে থেকে চীনা এবং দক্ষিণ দিক থেকে মার্কিন সাহায্য আসবে। এটা ছিল একটি ডাহা মিথ্যা। আমি কখনো বলিনি যে, আমার পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি বার্তায় আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবার সংকল্প ব্যক্ত করেছিলাম।
আমার ওপর দোষ চাপানোর জন্য আবার চালাকি করা হয়।আমি তখন টেলিফোনে গুল হাসানকে বলেছিলাম, ‘দয়া করে আমার সাথে আর মিথ্যা কথা বলবেন না। আমি সাহায্য চাই নি এবং আমার সাহায্যের প্রয়োজনও নেই।
আমি আপনাকে পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রতি লক্ষ্য রাখার অনুরোধ করছি। এ রণাঙ্গনেই আমাদেরকে বিজয়ী হতে হবে। আমি আমার দিকটা দেখছি।’ এরপর তিনি আমার সাথে কথা বলতে চাইতেন না । মেজর জেনারেল কাজী মজিদ যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকায় পিছু হটে আসেন নি।
১৩ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সের কাছে পাঠানো বার্তায় আমি জানাই যে, ‘ঢাকা দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুসংগঠিত এবং আমি লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ আমি বিদেশি প্রচার মাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করি যে, আমার লাশের ওপর দিয়ে ভারতীয় ট্যাংককে ঢাকায় আসতে হবে। সেদিন রাতে আরেকটি বার্তায় আমি জানাই যে, ‘আমি চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য সুরক্ষিত এলাকায় অগ্রসর হচ্ছি।’
আমি শেষ ব্যক্তি জীবিত থাকা পর্যন্ত লড়াই করে যাবার নির্দেশ দিই। ফরমান আমাকে অথবা গভর্নরকে না জানিয়ে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালকে একটি আন্তর্জাতিক নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন।
রাত ১৩/১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে পাঠানো একটি অশ্রেণিভুক্ত উন্মুক্ত বার্তা । আমার অজ্ঞাতে গভর্নরের পক্ষ থেকে রাও ফরমান আলী যে বার্তা পাঠান প্রেসিডেন্ট তার জবাবে আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
যোগাযোগ করে সেনাবাহিনী প্রধান অথবা মেজর জেনারেল পীরজাদা কাউকেই পাওয়া যায় নি। জেনারেল গুল হাসান কোনো কিছুই না জানার ভান করেন। অথচ তিনি ছিলেন চিফ অব জেনারেল স্টাফ এবং সামরিক গোয়েন্দা ও সিগনালস অধিদপ্তরের মহাপরিচালক।
গভর্নর মালিক ও তার মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। আমি আত্মসমর্পণ করতে চাই নি বলেই আমার ওপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য তিনি পদত্যাগ করেন। দৃশ্যত আত্মসমর্পণের দলিলে সই করা থেকে বিরত থাকার জন্যই তিনি এ উদ্যোগ নেন ।
১৫ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
রাশিয়ার সমর্থনে পোল্যান্ড জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এ প্রস্তাবে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং প্রাথমিকভাবে ৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ বিরতির কথা উল্লেখ করা হয়। জেনারেল হামিদের একান্ত সচিব ব্রিগেডিয়ার জানজুয়া আমার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকীকে জানান যে, উপরে উল্লিখিত বার্তাটি পাঠানো হচ্ছে।
আমি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সের কাছে পাঠানো এক বার্তায় জানাই যে, ‘আমি শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে প্রস্তুত।’ জেনারেল হামিদ ও এয়ার মার্শাল রহিম ১৪ই ডিসেম্বর জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স থেকে পাঠানো বার্তা অনুযায়ী কাজ করার জন্য টেলিফোনে নির্দেশ দেন। তারা আমাকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন।
ফরমান রাশিয়ার মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করেন। আমি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হই এবং আমার সৈন্য ও অনুগত পাকিস্তানিদের নিরাপত্তা দাবি করি।
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ :
ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে বার্তা পাঠান। আমি তার প্রস্তাব সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে পাঠাই। তিনি এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং আত্মসমর্পণ করতে বলেন। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তান ও সশস্ত্র বাহিনীর সম্মান রক্ষা করার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে একটি বার্তা পাঠাই।
প্রেসিডেন্ট বার্তায় লিখেন ‘এনএফএ’ (আর কোনো যুদ্ধ নয়)। আমি প্রেসিডেন্টের সাথে কথা বলতে চাইলাম। তবে তাকে পাওয়া যায় নি সেনাবাহিনী প্রধানের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি। জেনারেল পীরজাদা তখন স্কোয়াশ খেলছিলেন। তিনি টেলিফোনে আমার সাথে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পোলিশ প্রস্তাব গ্রহণ করার পরিবর্তে ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর আত্মসমর্পণ করার অসম্মান চাপিয়ে দেওয়া। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে একটি উত্তরাধিকারী সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।।
১৬ই ডিসেম্বরের পর
অপমানে জাতি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া হয়। জেনারেল হামিদ জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে অফিসারদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেবার জন্য উঠে দাঁড়ালে ব্রিগেডিয়ার ফজলে রাজিক খানের নেতৃত্বে একদল অফিসার তার প্রতি মারমুখী হয়ে ওঠে।
ব্রিগেডিয়ার রাজিক ছিলেন গুল হাসানের খুবই ঘনিষ্ঠ। এয়ার মার্শাল রহিম ব্যক্তিগতভাবে জঙ্গিবিমান নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনের ওপর চক্কর দিতে থাকেন। এটা ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো, এয়ার মার্শাল রহিম ও গুল হাসানের নেতৃত্বে একটি পরিকল্পিত অভ্যুত্থান ।
জুলফিকার আলী ভুট্টো অধিকাংশ জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ারকে বরখাস্ত করেন। তবে টিক্কাকে রেখে দেন। ফরমানকেও রেখে দেওয়া হয়। সকল ইলেক্ট্রনিক ও প্রচার মাধ্যমে সামরিক বাহিনী বিরোধী প্রচারণা চালানো হতে থাকে।
পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়ের জন্য দোষ চাপানো হয় ইন্টার্ন কমান্ড এবং আমার ওপর। ইন্টার্ন কমান্ডের পক্ষে কথা বলার এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর ষড়যন্ত্র ও অপকর্ম প্রকাশ করার জন্য তখন আমি দেশে ছিলাম না। গুল হাসান এবং টিক্কা ছিলেন সম্পূর্ণ নীরব।
২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ :
এ রাতকে বলা হয় ‘জেনারেলদের রাত। সে রাতে গুল হাসানের বাসভবনে তিনি নিজে, মেজর জেনারেল শওকত রেজা, এয়ার মার্শাল রহিম, শাকিল উল্লাহ দুররানী, সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান আসগর খানকে গদিতে বসানোর প্রস্তাব করেন। কিন্তু গুল হাসান ও রহিম খান তাতে আপত্তি করেন। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতায় বসানো হবে।
অন্যদিকে, ইয়াহিয়ার বাসভবনে আরেকটি গ্রুপ বৈঠকে বসে। এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ইয়াহিয়া খান নিজে, জেনারেল হামিদ, ওমর ও মিঠা। এ গ্রুপ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার জন্য আলোচনা করছিল। কিন্তু গুল হাসানের গ্রুপই জয়ী হয়। গুল হাসানের নেতৃত্বাধীন গ্রুপ বন্দুকের মুখে ইয়াহিয়া খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে।
২১শে ডিসেম্বর ১৯৭১ :
জনগণের সামনে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য আমার নিজের, আমার সৈন্য ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপপ্রচার শুরু হয়। আমার বিরুদ্ধে এমন জঘন্য ও ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয় যে, জনগণের দৃষ্টিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো অথবা ইয়াহিয়া খান নয়, আমিই মূল অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হই । মূল অপরাধী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আড়াল করে রাখার জন্য ষড়যন্ত্রের চূড়ান্ত পূর্বে এ উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার চালানো হয় ।
আরও দেখুন: