[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের উপসংহার

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃদ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের উপসংহার। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।

দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের উপসংহার

 

দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের উপসংহার

 

উপসংহার

যুদ্ধ মানে মরণ। যুদ্ধ মানে জয়পরাজয়। সে অর্থে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ হচ্ছে এক বীরত্বগাঁথা যুদ্ধ। কিন্তু আত্মসমর্পণে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তে একেবারে ধূলিস্যাৎ হয়ে যায় এ বীরত্ব। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত পোলিশ অথবা রুশ প্রস্তাব গ্রহণ করে সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণের অসম্মান থেকে রক্ষা করা যেতো।

কিন্তু সেসময় যারা রাষ্ট্রের কর্ণধার ছিলেন তারা তাদের কায়েমি স্বার্থে জাতীয় সম্মান বিসর্জন দিয়েছেন। ক্ষমতাসীনরা ‘পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানে করা হবে- এই পরিকল্পপনার ভিত্তিতে কাজ না করে কাজ করেছেন পূর্ব পাকিস্তানকে সরকারবিহীন অবস্থায় পরিত্যাগে গৃহীত এমএম আহমেদ পরিকল্পনার ভিত্তিতে।

এভাবে তারা ক্ষমতার দুটি কেন্দ্র- আওয়ামী লীগ ও সেনাবাহিনীকে শিক্ষা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে হটানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ দিয়ে এবং সেনাবাহিনীর মাথা অবনমিত করা হয়েছে ইস্টার্ন কমান্ডকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে। খণ্ডিত পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের জন্যই এ দুটি কাজ করা হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসন যে দৃঢ়তা, সহনশীলতা ও নিষ্ঠা প্রদর্শন করেছে তা হচ্ছে তাদের দেশপ্রেম ও বীরত্বের প্রমাণ। তারা মূল ভূখণ্ড থেকে ১ হাজার মাইল দূরে লড়াই করেছে, সরকারি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পুনরুদ্ধার করেছে।

এটা ছিল ১২ ডিভিশন সৈন্য, ৩৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ, শত শত জঙ্গিবিমান ও নৌ বলে বলীয়ান এক বিশাল বাহিনীর সাথে দুর্বল, ক্ষুদ্র ও বিচ্ছিন্ন একটি বাহিনীর অসম লড়াই। শক্তির ভারসাম্য না থাকা সত্ত্বেও ইন্টার্ন কমান্ড স্থানীয় বৈরি জনগোষ্ঠী, গেরিলা যুদ্ধ ও ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।

এমন এক ভূখণ্ডে আমাদেরকে একটানা দীর্ঘ ৯ মাস লড়াই করতে হয়েছে যে ভূখণ্ডের সাথে রয়েছে সাড়ে ৩ হাজার মাইল ব্যাপী বৈরি ভারতীয় সীমান্ত।১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সৈন্যদেরকে একটি রাজনৈতিক বিপর্যয়কে সামরিক বিজয়ে রূপান্তরিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

সৈনারা সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে এ লক্ষ্য অর্জন করে। তারা ১৯৭১ সালের মে মাস নাগাদ মুক্তি বাহিনী গেরিলাদের পূর্ব পাকিস্তানের মাটি থেকে বিতাড়িত করে এবং দেশের দুটি অংশের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণে সরকারকে সক্ষম করে তোলার জন্য উল্লেখযোগ্যভাবে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ মোকাবেলায় কোনো সার্বিক জাতীয় কৌশল ছিল না। হাই কমান্ড পূর্ব পাকিস্তানে অর্জিত আমাদের প্রাথমিক সফলতাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, শত্রুরা এ সময়ের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে। তারা শান্তি বিনষ্ট, গেরিলা যুদ্ধ সংগঠন এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির একটি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়।

দেশ ও সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভারতের অপপ্রচারে। অসৎ উদ্দেশ্যে জান্তা এসব বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত সংবাদ খণ্ডন করে নি। ফলে বিশ্ব এগুলো বিশ্বাস করে ফেলে। অযোগ্যতা অথবা জঘন্য অপরাধে লিপ্ত থাকার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব দুরাচার কমান্ডার ও অফিসারকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল, শত্রুর অপপ্রচারে তারা খুবই সন্তুষ্ট হয়।

রাজনৈতিক ও সামরিক চক্রের পূর্ণ সহযোগিতা ও পরামর্শে তারা ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর তাদের ব্যর্থতা ও অপরাধ চাপিয়ে দেয়। আমরা ভারতে যুদ্ধবন্দি। থাকাকালে তারা মাঠ ফাঁকা পেয়ে যায়। তাই তারা তাদের ইচ্ছেমতো গল্প শুনিয়েছে জাতিকে।

এ সংকটে সম্পৃক্ত লোকজন উপস্থিত না থাকায় অপপ্রচার চালানোর সুযোগ পায় তারা। চক্রান্তকারীরা ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে প্রতারণা করে এবং আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে কোনো উত্তরাধিকারী সরকার না রাখার জন্যই তারা একাজ করে।

জুলফিকার আলী ভূট্টোর অপকর্ম আড়াল করে রাখার জন্য যুদ্ধবন্দি ও বেসামরিক লোকজনকে ভারতের বন্দি শিবিরে পচিয়ে যারার চক্রান্ত করা হয়। জনগণের কাছে মিথ্যা বলা হয় এবং সশস্ত্র বাহিনীর কাছে গোপন রাখা হয় সত্য। সত্য ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আটকা পড়ে।

পশ্চিম পাকিস্তানে করার কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের লড়াই। পশ্চিম রণাঙ্গনে পদাতিক বাহিনীতে ভারতের সাথে সমতা, সাজোয়া বাহিনীতে শ্রেষ্ঠত্ব এবং সর্বাধিনায়কের আওতায় যুক্ত পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর তিন জন প্রধান থাকা সত্ত্বেও ষড়যন্ত্রকারীরা এতই ভেঙে পড়ে যে, তারা বিমান বাহিনীর পূর্ণ শক্তি ব্যবহার করে নি এবং যথাযথভাবে পরিকল্পিত হামলাও চালায় নি। আক্রমণকারী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান ভূখণ্ড দখল করার পরিবর্তে সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড হারায়।

পক্ষান্তরে, আমরা শত্রুকে পূর্ব রণাঙ্গন থেকে পশ্চিম রণাঙ্গনে সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ না দেওয়াসহ আমাদের প্রতিটি মিশনে সফল হই। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের নৌবাহিনী দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। পাকিস্তানে নৌবাহিনীর সদর দপ্তর করাচি আক্রান্ত হয়। কিন্তু আমাদের নৌবাহিনী আক্রমণকারী শত্রুর ওপর একটি গুলিও ছোঁড়ে নি।

প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ছাড়া জাতিসংঘ প্রতিনিধির কাছে মেজর জেনারেল ফরমানের বার্তা হস্তান্তর, মার্কিন, সোভিয়েত, ফরাসি ও ব্রিটিশ প্রতিনিধিদেরকে পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য তার অনুরোধ, আমার অনুমতি ছাড়া রুশ ও ভারতীয় সেনা প্রধানের সাথে তার যোগাযোগ এবং পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির পর প্রেসিডেন্ট ভবনের ওপর জঙ্গি বিমান নিয়ে এয়ার মার্শাল রহিম খানের উড্ডয়ন ইত্যাদি ঘটনাগুলো জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতায় আনার পরিকল্পিত অভুত্থানের এক একটি অংশ।

যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত না হয়েও অন্যের ব্যর্থতা ও দোষের জন্য যখন একজন সৈনিককে আত্মসমর্পণের মতো অসম্মানের মুখোমুখি হতে হয় তখন তা তার জন্য মৃত্যুর চেয়েও পীড়াদায়ক। আমাদের শাসক এবং জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে অবস্থানরত স্বার্থপর অফিসাররা ইন্টার্ন কমান্ডের সব অফিসার ও সৈন্যদের ওপর এ অসম্মান চাপিয়ে দেয় ১৩ই ডিসেম্বর আমি শেষ ব্যক্তি জীবিত থাকা পর্যন্ত শেষ বুলেট দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিই।

আমার এ নির্দেশ ছিল সৈন্যদের জন্য একটি মৃত্যু পরোয়ানা । কিন্তু সৈন্যরা আমার নির্দেশ মেনে নেয় এবং তারা লাব্বায়েক জবাব দেয়। ওয়েস্টার্ন গ্যারিসনকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার স্বার্থে আমরা সকলেই জীবিত থাকা পর্যন্ত শেষ বুলেট দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক ছিলাম।

নতুন করে কোনো সৈন্য পাঠানো হয় নি আমাদের সৈন্য ঘাটতি পূরণে। তাই হতাহত সৈন্যদের স্থান পূরণে নিয়মিত সৈন্যদের সাথে সিএএফ’র সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আমরা আমাদের লড়াই করার শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করি সহায়ক অস্ত্রশস্ত্র, সার্ভিস ও সিএএফ’র চমৎকার বিন্যাস ঘটিয়ে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র সংকুচিত করি। আমরা দুই মাসেরও কম সময়ে রুশ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্থানীয় গেরিলাদের পরাজিত করি। আমাদের এ সাফল্য অলৌকিকতার চেয়ে কম ছিল না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্রোহ দমন অভিযানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আড়াই থেকে ৩ লাখ সৈন্যের প্রয়োজন ছিল। অথচ আমরা মাত্র ৪৫ হাজার সৈন্য মোতায়েন করে এ কঠিন কাজ সম্পন্ন করেছি। আমাদের সৈন্যদের গেরিলা যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা অথবা প্রশিক্ষণ ছিল না।

শুধু মুক্তিবাহিনী নয়, স্থানীয় জনগণও আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং বেসামরিক সরকার বলতে কিছুই ছিল না। আমরা গেরিলাদের দেশ থেকে উৎখাত করেছিলাম এবং তাদেরকে কোণঠাসা করে রেখেছিলাম।

আমাকে সীমান্তে থামার নির্দেশ এবং পিছু হটে যাওয়া গেরিলাদের ধাওয়া করতে ভারতে প্রবেশে বাধা দেওয়া না হলে আমি তাদের ফাংস করতে পারতাম। কারণ ভারতীয় বাহিনী সেসময় আমাদের পক্ষ থেকে আকস্মিক হামলা মোকাবেলায় মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

শুরুতেই বিদ্রোহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত এবং পাকিস্তান অখণ্ড এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপরাজেয় থাকতে পারত। মুক্তিবাহিনীর ছদ্মাবরণে ভারতীয়রা আমাদের ভূখণ্ডে লড়াই করেছিল। তাই মুক্তিবাহিনীকে পশ্চাদ্ধাবনে আমাদের ভারতে প্রবেশের যুক্তি ছিল রাজনেতিক, সামরিক ও নৈতিকভাবে সঠিক। জান্তার মনোপুত না হওয়ায় তারা আমাকে ভারতে প্রবেশের অনুমতি দেয় নি। এক কথায়, জান্ডার লক্ষ্য ছিল ভারতকে বিজয়ী হতে দেওয়া।

ভারতীয়রা মুক্তিবাহিনী এবং চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়ে তাদের লক্ষ্য অর্জনে পূর্ব পাকিস্তানে আগ্রাসন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতীয়রা ১৯৭১ সালের ২১শে নভেম্বর তাদের আগ্রাসন শুরু করে এবং ঢাকা দখলের জন্য তারা চতুর্দিকে থেকে আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। তারা ১২ দিনে ঢাকা দখলের পরিকল্পনা করেছিল।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

কিন্তু আমরা তাদেরকে সীমান্তে অথবা সীমান্তের আশপাশে নিশ্চল করে রাখি এবং ১৩ দিন তারা কোণঠাসা হয়ে থাকে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া খান পশ্চিম রণাঙ্গনে বিলম্বিত, অপরিকল্পিত ও অপরিণামদর্শী হামলা শুরু করলে অঘোষিত যুদ্ধ প্রকাশ্যে যুদ্ধে রূপ নেয়।

২১শে নভেম্বর থেকে যে লড়াই সীমান্তে সীমাবদ্ধ ছিল তা দ্রুত দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় সোভিয়েতে ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

আমাদেরকে রাতে অথবা প্রতিকূল আবহাওয়ায় চলাচলে বাধ্য করে এবং আমাদের প্রয়োজনীয় সকল উপকরণ ধ্বংস করে দেয় ভারতীয় বিমান বাহিনী। তা সত্ত্বেও আমরা তাদের জান-মালের অবিশ্বাস্য ক্ষতিসাধন করি, তাদেরকে আরো এক সপ্তাহ আটকে রাখি সীমান্তে এবং আমাদের সুবিধাজনক ভূখতে তাদেরকে নিয়ে আসতে সক্ষম হই।

ভারতীয় বাহিনী আমাদের শক্তঘাঁটি ও দুর্গের কাছাকাছি এসে থেমে যায়। তখনো তারা ছিল ঢাকা থেকে বহু দূরে এবং পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। এ অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনী বিরাট এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে এবং তাদের সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায় তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই নাজুক।

অন্যদিকে, আমাদের দুর্গ ও শক্ত ঘাঁটিতে সব কিছুই ছিল অক্ষত। আর্টিলারি ও অন্যান্য সমরাস্ত্র সরবরাহে ঘাটতি ছিল না। এ ছাড়া আমাদের মধ্যে সমন্বয়েরও কোনো অভাব ছিল না। আমি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করার অপমান এবং ভারতের কাছে যুদ্ধবন্দি হওয়ার দুর্ভাগ্য এড়াতে পারতাম।

আমার অধীনে হেলিকপ্টার ছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার মতো সময়ও ছিল। আমি আমার প্রয়োজন মতো অর্থ নিয়ে যে-কোনো নিরপেক্ষ অথবা বন্ধু দেশে হেলিকপ্টারে করে চলে যেতে পারতাম। আমার অনুপস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক লোকজন ও বিহারি এবং সৈন্যদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হতো।

তাই আমি ঢাকায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। একজন সৈনিক ও একজন কমান্ডার হিসেবে সৈন্যদের সাথে অবস্থান করা ছিল আমার কর্তব্য। আমি সৈন্যদের সাথে আত্মসমর্পণের অপমান এবং শত্রুর হাতে বন্দি হওয়ার দুর্ভাগ্যের অংশীদার হই।

চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে আমার সৈন্যরা। তাদের কোনো বিশ্রাম অথবা স্বস্তি ছিল না। তাদের চারদিকেই ছিল শত্রু। এ পরিস্থিতিতেও তাদের মনোবল ছিল অনেক উঁচু। ইতিহাসে এমন নজির খুব কমই আছে যেখানে একটি ক্ষুদ্র বাহিনী তাদের মূল ঘাঁটি থেকে বহু দূরে দূরতিক্রম্য বাধা-বিপত্তির ভেতর এতো দীর্ঘদিন এমন বীরত্বের সাথে লড়াই করেছে।

নেতৃত্বে অভাবনীয় যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন আমার অধিকাংশ কমান্ডারই। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার ক্রীড়ণকদের অপপ্রচারে তাদের এ বীরত্বপূর্ণ উপাখ্যান ফিকে হয়ে যায় এবং নেতিবাচক ধারণা হয়। মুসফিকার আলী ভুট্টো সৎ হলে এবং তার অসৎ উদ্দেশ্য না থাকলে তিনি হামুদুর রহমান কমিশনের তদন্ত কাজের পরিধি বিস্তৃত করতে পারতেন।

কমিশনের তদন্তের আওতা সম্প্রসারিত করা হলে রাজনৈতিক ঘটনাবলী তদন্তের আওতাভূক্ত হতো লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান ছিলেন সে সময় চিফ অব আর্মি স্টাফ ।। জুলফিকার আলী ভুট্টো তদন্ত কমিশনের পরিধি সংকুচিত করায় তিনি প্রতিবাদ করেন নি। কারণ, তিনি ভালো করেই জানতেন যে, সীমিত গণ্ডির ভেতর তদন্ত।

পরিচালনা করা হলে ইস্টার্ন গ্যারিসনের ওপর পূর্ণ দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর তল্পিবাহক হতে গিয়ে তিনি তার বিবেক, নীতি-আদর্শ সবকিছু বিকিয়ে দেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো মন্ত্রিসভার একটি সাব-কমিটি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট এক নজর দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন।

এ রিপোর্ট দেখে কমিটি এটাকে ‘পক্ষপাতমূলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে এবং চরিত্র হননের একটি প্রয়াস’ বলে সমালোচনা করেছে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর দলের লোকজন এ রিপোর্টকে ‘একপেশে, সংক্ষিপ্ত ও অপর্যাপ্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে।

এ কথাও উঠেছে যে, কমিশন তাদের তদন্তের পুরোপুরি অথবা আংশিকভাবেও একটি প্রচলিত তদন্ত কমিশনের রীতিনীতি অনুসরণ করে নি। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও টিকা এ তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পুরোপুরি বদলে ফেলেন, যাতে কোনো প্রামাণ্য দলিল অবশিষ্ট না থাকে।

রাজনৈতিক বিপর্যয়ের পুরো দায়িত্ব ইস্টার্নকমান্ডের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় ব্যর্থতা চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে কাজ করেছেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান জেনারেল হামিদ, গুল হাসান, টিক্কা ও ফরমান। ক্ষমতায় যাবার জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত করার প্রয়োজন ছিল। এ প্রয়োজন পূরণে তৎকালীন সরকার ও সেনা সদর দপ্তর ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ।

আওয়ামী লীগের কাছে বাংলাদেশ ছেড়ে দিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মুজিবের হাত থেকে নিষ্কৃতি পান এবং সেনাবাহিনী যাতে কখনো তার প্রতি একটি হুমকি হয়ে দেখা দিতে না পারে সে জন্য তিনি ইস্টার্ন কমান্ডের আত্মসমর্পণের পেছনে কলকাঠি নাড়েন।

যড়যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসেন এবং তার ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করার জন্য তিনি শেষ মুজিবকে মুক্তি দেন এবং ৪৫ হাজার যুদ্ধবন্দি ও ৪৭ হাজার বেসামরিক লোকজনকে ভারতের বন্দি শিবিরে দীর্ঘকাল ফেলে রাখার বন্দোবস্ত করেন। যুদ্ধবন্দি ও বেসামরিক লোকজন দেশে ফিরে এলে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কারসাজি ও অপকর্ম ফাঁস হয়ে যেতো।

সিমলা গিয়ে ভুটো পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করতে অস্বীকৃতি জানান। সেনাবাহিনীকে ঘৃণা করতেন তিনি। সিমলা গিয়ে তিনি যে উক্তি করেন তাতে তার এ উৎকট মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি আমাদেরকে ব্রিটিশের কামানের খোরাক হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

জুলফিকার আলী ভুট্টো তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ ও কায়েদে আযমের পাকিস্তানের পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দেন। ইস্টার্ন কমান্ডের তৎপরতাকে নিম্নোল্লেখিত পর্যায়ে বিচার করতে হবে :

পর্যায় ১ :

১৯৭১ সালের মে নাগাদ বিদ্রোহীদের পরাজিত করে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পুনরুদ্ধার এবং বিদ্রোহীদের ভারতীয় ভূখণ্ডে বিতাড়িত করা। এ সাফল্যকে টিক্কার সমর্থকরাও একটি ‘অলৌকিক’ ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

পর্যায় ২:

পূর্ব পাকিস্তানের একটি ভূখণ্ড দখল করে সেখানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় গেরিলাদের সহায়তাদানকারী ভারতীয়দের প্রচেষ্টা নস্যাৎ ।

পর্যায় ৩:

পরোক্ষ যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী ২১ নভেম্বর প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ১২ দিনে পূর্ব পাকিস্তান দখল করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওরা ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা সীমান্তেই লড়াই চালাচ্ছিল। এ সময়ের মধ্যে তারা কোনো উল্লেখযোগ্য ভূখণ্ড দখল নিতে পারে নি।

পর্যায় ৪ :

আমাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে ৩রা ডিসেম্বর পশ্চিম রণাঙ্গনে বিলম্বিত লড়াই শুরু করা। পশ্চিম রণাঙ্গনে বিপর্যয়ে আমার অবস্থান আরো বেসামাল হয়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও আমার সৈন্যরা লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে এবং ভারতীয় সৈনাদের সীমান্তে আরো এক সপ্তাহ আটকে রাখে।

ভারতীয়রা তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং ঢাকা রক্ষায় চূড়ান্ত লড়াইয়ের অবস্থানে আমার সৈন্যদের পিছু হটে আসতে দেখে ভারতীয়রা পর্যন্ত তাজ্জব বনে যায়। ফরমান ও কাজী মজিদের মতো চক্রান্তকারীদের চক্রান্ত সত্ত্বেও আমার সৈন্যরা দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

এবং আমি ঢাকাসহ আমার সকল দুর্গ রক্ষায় প্রস্তুত ছিলাম। জেনারেল ইয়াহিয়া। পোলিশ ও রুশ প্রস্তাব গ্রহণ করে না করে আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান ও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর ওপর অসহনীয়। অপমান ও অসম্মান চাপিয়ে দেন।

আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া না হলে দীর্ঘদিন আমি পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা করতে পারতাম। কারণ, ভারতীয়রা ছিল এলোমেলো অবস্থায়। অন্যদিকে, আমরা তখনো প্রধান প্রধান শহর, সমুদ্র বন্দর ও বিমান বন্দর নিয়ন্ত্রণ করছিলাম।

ঢাকার বাইরে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে হামলা করার জন্য তাদেরকে নতুন করে সৈন্য আনতে হতো। এতে তাদের সময় লাগতো প্রচুর। যশোর ও ময়মনসিংহ ছাড়া আমার অন্যান্য দুর্গগুলো ভারতের ১১টি ডিভিশনকে ঠেকিয়ে রাখছিল এবং তাদেরকে দীর্ঘদিন আটকে রাখাও সম্ভব ছিল।

এতে ভারতীয়দের অবিশ্বাস্য ক্ষয়-ক্ষতি হতো। ঢাকা দখল করতে হলে পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করতে হতো তাদের। ইস্টার্ন গ্যারিসন পরাজিত হয় নি। আমার সাথে প্রতারণা করা হয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় আমাকে আত্মসমর্পণে বাধা। করা হয়।

ব্যাপক ক্ষমতা দিয়ে একটি নয়া কমিশন গঠন করা অপরিহার্য, ১৯৭১ সালের বিপর্যয় সম্পর্কে সত্য উদ্ঘাটন করতে হলে। নজিরবিহীন প্রতিকূলতা ও অসম্ভব বাধা-বিপত্তির মধ্যে ইন্টার্ন কমান্ড কীভাবে ন্যস্ত দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে এবং অন্যদিকে, সকল উপায় ও সম্পদ এবং সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও মাত্র ১০ দিনের লড়াইয়ে ওয়েস্টার্ন কমান্ড কেন সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ড হারিয়েছে তা খুঁজে বের করার জন্য একটি সামরিক মহড়ার আয়োজন করা হোক।

এ মহড়ায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সেনাবাহিনী প্রধান। এ মহড়ায় দুটি বাহিনী অংশগ্রহণ করবে। একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দেবেন টিক্কা খান, গুল হাসান ও তাদের অনুসারীরা এবং আরেকটি দলে থাকবো স্বয়ং আমি এবং আমার অফিসারগণ।

 

দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের উপসংহার

 

এ মহড়া হবে খুবই আকর্ষণীয়। এ থেকে অনেক কিছু শেখা যাবে। এতে চেয়ারে উপবিষ্ট হয়ে যারা যুদ্ধের নীতি নির্ধারণ করেন। তাদের সাথে রণাঙ্গনে সশরীরে অংশগ্রহণকারী জেনারেলদের মৌলিক পার্থক্য ফুটে উঠবে।

আরও দেখুন:

Leave a Comment