আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ জেনারেল আবদুল হামিদ খানের রিপোর্ট। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।
জেনারেল আবদুল হামিদ খানের রিপোর্ট
জেনারেল আবদুল হামিদ খানের রিপোর্ট
জেনারেল এএকে নিয়াজিকে আমি ভালো করেই চিনি। তিনি আমার অধীনে দীর্ঘদিন বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে তিনি “টাইগার” নামেই পরিচিত। জেনারেল নিয়াজি আমাদের সেনাবাহিনীতে সর্বাধিক পদকপ্রাপ্ত অফিসার।
১৯৭১ সালে জেনারেল টিক্কা খানের স্থলাভিষিক্ত করা হয় তাকে পূর্ব পাকিস্তানের জটিল ও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায়। একজন বাস্তববাদী সৈনিক ও বৈরী পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে সক্ষম জেনারেল নিয়াজি অপকট, সৎ, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও নিবেদিত। প্রচণ্ড চাপ ও বৈরী পরিবেশে সৈন্য পরিচালনার সামর্থ্য তার রয়েছে।
তিনি ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সংকট মোকাবেলা করেছেন এবং মাত্র দুই মাসে বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে ছদ্মবেশে লড়াইরত বিএসএফ ও ভারতের নিয়মিত সৈন্যদের ভারতে তাড়িয়ে দেন। এ অভিযান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ও সাহসিকতার সাথে পরিচালনা করা হয়।
এতে কৌশলগত দক্ষতা, নিপুণ পরিকল্পনা ও কঠোর শ্রমের প্রতিফলন ঘটেছে। জেনারেল নিয়াজির পরিকল্পনা ছিল সুষ্ঠু এবং আমি ও প্রেসিডেন্ট উভয়ে এ পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা এবং পাকিস্তানের ভূখণ্ডে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ না দেওয়ার জন্য।
পূর্ব ও পশ্চিমা পাকিস্তানের যুদ্ধ ও ঘটনাবলিকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা যেতে পারে না। দেশের অধিকাংশ সামরিক শক্তি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে এবং পশ্চিম রণাঙ্গনের বিজয় পূর্ব রণাঙ্গনের বিজয় নিশ্চিত করতে পারতো।
অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা বিশেষ করে যোগাযোগ রুট ও বড়ো বড়ো শহর রক্ষা এবং দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী তৎপরতা মোকাবেলায় নিয়োজিত বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তাদানে জেনারেল নিয়াজির তিনটি পদাতিক ডিভিশন অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছে।
এ তিনটি ডিভিশন, অবিচল সাহস, অদম্য উৎসাহ, চরম আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠার সাথে লড়াই করেছে গোলন্দাজ সহায়তার ঘাটতি এবং কার্যত বিমান বাহিনীর ছত্রছায়া না থাকা সত্ত্বেও শত্রুর পঞ্চম বাহিনীর অবিরাম গোলযোগের মুখে।
ইতিহাসে এমন নজির খুঁজে পাওয়া দুস্কর। তারা শত শত যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার এবং ট্যাংক ও গোলন্দাজ বাহিনীর সমর্থপুষ্ঠ ১২ ডিভিশন ভারতীয় সৈন্যের সাথে লড়াই করেছে। এ প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সত্ত্বেও টাইগার’ নিয়াজির নেতৃত্বে, আমাদের বীর ও নিবেদিত প্রাণ সৈন্যরা অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত লড়াই অব্যাহত রেখেছে।
‘টাইগার’ তার সৈন্যদের শেষ রক্ত বিন্দু ও শেষ বুলেট দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্টের নির্দেশ এবং আমার পরামর্শে তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে। পূর্ব রণাঙ্গনে সামরিক নয়, রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে। এ রাজনেতিক বিপর্যয়ের বীজ বপন করা হয় বহু বছর আগে।
রাজনৈতিক কারণে পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ দানা বেধে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অসন্তোষের জন্য ১৯৭১ সালে জেনারেল নিয়াজি ও তার বীর সিপাহী এক কথায় গোটা সেনাবাহিনীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। ইস্টার্ন গ্যারিসনের সাহসিকতা, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে পারে নি ।
একটি উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের দ্রুত পরিসমাপ্তি ঘটে, আত্মসমর্পণের নির্দেশ পালন করায়। জেনারেল নিয়াজির মতো সর্বোত্তম ফিল্ড কমান্ডার আমি কখনো দেখি নি এবং এমন একজন কমান্ডারের সাথে আমার আর কোথাও কাজ করার সৌভাগ্য হয় নি। আমি তার সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি এবং একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, তিনি তথাকথিত বহু দেশপ্রেমিকের চেয়ে দেশের জন্য অনেক বেশি আত্মত্যাগ করেছেন।
স্বাক্ষর
জেনারেল আবদুল হামিদ খান
এপ্রিল ১৯৭২
আরও দেখুন: