আমাদের আজকের আলোচনা বিষয় –কেন্দ্রে লীগ যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশন গঠন। যা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল এর একটি অংশ।
কেন্দ্রে লীগ যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশন গঠন
ভাইসব! নতুন গণপরিষদ গঠণের পর দেখা গেল যে পাকিস্তানে কোন মন্ত্রিসভা-গঠণ করতে হলে উহা কোয়ালিশনের ভিত্তিতে গঠণ করা ছাড়া একদলীয় সরকার গঠণ কোন দলের পক্ষেই সম্ভব নয়। কারণ মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ বা যুক্তফ্রন্ট গণপরিষনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে স্থায়ী মন্ত্রিত্ব গঠণ করতে পারে না। গণপরিষদের মুসলিম লীগ সদস্যগণ এক বৈঠকে মিলিত হয়ে মিঃ চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে উক্ত পার্টির নূতন নেতা নির্বাচিত করলো। ফলে প্রাক্তণ প্রধাণমন্ত্রী মিঃ মোহাম্মদ আলীর পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হবার পথ চিররুদ্ধ হল।
গণপরিষদে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি জনাব সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ-আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার গঠণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জনাব সোহরাওয়ার্দীর সাথে আলোচনা সুরু করল। আওয়ামী লীগ পাচ দফা দাবীর স্বীকৃতির ভিত্তিতে উক্ত কোয়ালিশন গঠণে সম্মত ছিল। উক্ত দফাগুলো হচ্ছে।
(১) রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ পদ দুটি সর্ব সময়েই পাকিস্তানের উভয় অংশকে ভাগ করে দিতে হবে।
(২) পাকিস্তানের সর্বক্ষেত্রে এবং সর্ব বিষয়ে সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে চলতে হবে।
(৩) মাত্র তিনটি বিষয় বাদে পাকিস্তানের উভয় অংশকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
(৪) বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।
(৫) পাকিস্তানে যুক্ত নির্বাচন প্রথা চালু করতে হবে।
এইসব গণদাবীর ভিত্তিতে যখন জনাব সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আলোচনা চলছিল তখন হক ও তার সাঙ্গ পাঙ্গরা প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী নিঃ মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী করতে ব্যর্থ মনোরথ হওয়ায় নিরাশ হৃদয়ে মুসলিম লীগ নেতৃবন্দের নিকট বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করল ও গণ পরিষদে মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী দলের নেতা মিঃ চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে বিনাশর্তে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্টিত [অধিষ্ঠিত) করতে

রাজী হল। এই অবস্থায় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে যুক্তফ্রন্ট দলের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠণের আলাপ আলোচনা সুরু করল। পূর্ব বাংলার গণদাবী ধূলিসাৎ হতেছে দেখে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে আপনাদের সাধারণ সম্পাদক ও আরো অনেকে জনাব হকের নিকট এই প্রস্তাব পাঠালেন যে জনাব হক স্বয়ং যদি প্রধান মন্ত্রীত্বের প্রার্থী হন তাতে আওয়ামী লীগের গণপরিষদে তেরজন সদস্য জনাব হককে অকুণ্ঠ সমর্থন দেবেন।
কারণ গবর্ণর জেনারেল যখন পশ্চিম পাকিস্তান হতে মনোনীত হয়েছেন তখন কিছুতেই প্রধানমন্ত্রীত্বের পদ পূর্ব পাকিস্তানে না নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে দেওয়া ঠিক হবে না এবং উহাতে সংখ্যা সাম্যগীতিরও ব্যাতিক্রম ঘটবে। জনাব সোহরাওয়ার্দীও অনুরোধ করে পাঠালেন যে জনাব হক বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ না করে নিজের দল ও আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে একটু দৃঢ় মনোভাব পোষণ করলেই পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ [নেতৃবৃন্দ| পূর্ববাংলার দাবী দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হবেন।
কিন্তু জনাব হক এ কথায় কর্ণপাত না করে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বেই লীগ-যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা-গঠণ করে নিজে স্বরাষ্ট্র সচিবের পদ অলঙ্কৃত করেন। এবং এইরূপে পূর্ব বাংলার দাবী দাওয়ার মূলে কুঠারাঘাত করেন।
এই অশুভ আঁতাতের ফলে গণপরিষদে আওয়ামী লীগের শত বিরোধীতা সত্ত্বেও, যে ৯২-ক ধারার বলে ফজলুল হক মন্ত্রিসভাকে পদচ্যুত করে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ শাহী তাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল সেই ৯২-ক ধারা নতুন নামে ৯৩ ধারা হিসেবে পুণরায় দেশের শাসনতন্ত্রে সন্নিবিষ্ট হল। ২৬৬ কোটি টাকা ব্যায়ে যে করাচীকে কেন্দ্রীয় রাজধানী রূপে গড়ে তোলা হয়েছিল এবং যে টাকার বেশীর ভাগ পূর্ববঙ্গ বাসীদেরকে দিতে হয়েছিল সেই শিল্পায়িত করাচী সহরকে পূর্ববাংলার অধিকার হতে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ বলে ঘোষণা করা হ’ল।
পশ্চিম পাকিস্তানে সমস্ত প্রদেশগুলোকে একত্রীভূত করে জনগণের মতমতের মূল্য না দিয়ে এক কলমের খোঁচায় বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের শাসনকে অব্যাহত রাখার জন্য এক ইউনিটে রূপান্তরিত করা হল; ঘৃণিত সীমান্ত রেগুলেশন এ্যাক্ট, বেঙ্গল রেগুলেশন এ্যাক্ট (১৯১৮) প্রভৃতি নিরাপত্যা আইন পাশ হল এবং বর্তমানে শাসকচক্রের তোগলকী মনোভাবের দরুণ করাচী হ’তে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় (রাজধানী) রাজধানী গাদাপে স্থানান্তরিত করার এক ষড়যন্ত্র চলছে। জানি না এই অশুভ আঁতাতের ফলে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ গঠণতন্ত্রে জনতার গণতান্ত্রিক ও মৌলিক অধিকার সমূহ রক্ষিত হবে কি-না, অনাগত ভবিষ্যৎই এর সাক্ষ্য দেবে।
আরও দেখুনঃ