সুতানুটি, বাগবাজার, কলিকাতা ১৮৫৮ সাল
==============-=========
“বাগবাজার ” – কলিকাতার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত একটি বহু প্রাচীন অঞ্চল । এই অঞ্চলটি কলকাতা তথা বাংলা তথা ভারতের অন্যতম পীঠস্থান। এই অঞ্চলের সাথে বহু মনিষীর সংযোগ ঘটছে। কেউ বা এখানে জন্মেছেন, কেউ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকেছেন, কেউ বা জীবনের অনেকটা সময় এখানেই অতিবাহিত করেছে।
* সারদা মা (১৮৫৩ – ১৯২০)
* রামকৃষ্ণ (১৮৩৬ – ১৮৮৬)
* বিবেকানন্দ (১৮৬৩ – ১৯০২)
* নিবেদিতা (১৮৬৭ – ১৯১১)
* গিরিশচন্দ্র ঘোষ (প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার) (১৮৪৪ – ১৯১২)
* বলরাম বসু – (শ্রীরামকৃষ্ণের বিশিষ্ট ভক্ত) ( ১৮৪২ – ১৮৯০)
* নন্দলাল বসু – পশুপতি বসু (বসু বাটি)
* নগেন্দ্রনাথ বসু (১৮৬৬-১৯৩৮)
– বিশ্বকোষ নামক বাংলা জ্ঞানকোষ রচয়িতা, বাগবাজারের ৮ নং কাঁটাপুকুর বাইলেনে তাঁর নিবাস ছিল। এখানেই তিনি তাঁর গ্রন্থটি রচনা করেন। কলকাতা পৌরসংস্থা তাঁর সম্মানে এই লেনটি বিশ্বকোষ লেন নামে উৎসর্গ করেছে। সম্ভবত এটিই পৃথিবীর একমাত্র বইয়ের নামে রাস্তা।
* মোহনচাঁদ বসু ( নিধুবাবুর শিষ্য। উনিশ শতকে বাগবাজারে বাস করতেন। বাংলা আখড়াই গানে খেউড় উদ্ভাবন তিনিই করেন।)
* ভোলা ময়রা (আঠারো-উনিশ শতক ) স্বনামধন্য কবিয়াল ও বাগবাজারের মিষ্টান্ন বিক্রেতা (রসগোল্লার উদ্ভাবক ও )
ইত্যাদি ইত্যাদি ।
সুতানুটি, বাগবাজার, কলিকাতা ১৮৫৮ সাল
–
ময়মনসিংহের মুগ ভালো, খুলনার ভালো কই।
ঢাকার ভালো পাতাক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দই।।
কৃষ্ণনগরের ময়রা ভালো, মালদহের ভালো আম।
উলোর ভালো বাঁদর পুরুষ, মুর্শিদাবাদের জাম।।
রংপুরের শ্বশুর ভালো, রাজশাহীর জামাই।
নোয়াখালির নৌকা ভালো, চট্টগ্রামের ধাই।।
দিনাজপুরের কায়েত ভালো, হাবড়ার ভালো শুঁড়ি।
পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভালো, ফরিদপুরের মুড়ি।।
বর্ধমানের চাষী ভালো, চব্বিশ পরগণার গোপ।
গুপ্তিপাড়ার মেয়ে ভালো, শীঘ্র-বংশলোপ।।
হুগলির ভালো কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভালো বোল।
ঢাকের বাদ্য থামলেই ভালো, হরি হরি বোল।।
−ভোলা ময়রা
* নবীন চন্দ্র দাস (১৮৪৫ – ১৮২৫) – স্বনামধন্য মিষ্টান্ন বিক্রেতা ( শোনা যায় ইতি প্রথম রসগোল্লা বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন)
***********************************************************************
এছাড়া অসংখ্য নাম আর ইতিহাস জড়িয়ে আছে বাগবাজারের সাথে লিখে শেষ করা যাবে না।
***********************************************************************
অনেকের মতে ব্রিটিশ আমলে বাগবাজার এ বিশাল “বাগ” (বাগান/ উদ্যান) ছিল, সেই “বাগ” থেকে বাগবাজার শব্দটির উদ্ভব। তবে ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন মনে করেন বাগবাজার শব্দটি ‘বাঁক বাজার’ শব্দের অপভ্রংশ। কারণ এই অঞ্চলের নিকটে হুগলি নদীর একটি প্রকাণ্ড বাঁক অবস্থিত।
বাগবাজার একসময় ছিল সুতানুটি গ্রামের অন্তর্ভুক্ত বর্ধিষ্ণু অঞ্চল । এই অঞ্চল ছিল বসু ও পাল পরিবারের আবাসভূমি। এই বসু পরিবারে অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তিত্ব নন্দলাল বসু ব্রিটিশদের আগমনের অনেক আগেই সুতানুটিতে আসেন। ডিহি কলকাতা গ্রামে বসতি স্থাপনের পর সুতানুটি অঞ্চল ধীরে ধীরে ইংরেজ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়। এই অঞ্চলের উত্তরভাগে পেরিনস গার্ডেন নামে একটি প্রমোদ উদ্যান ছিল । কলকাতার আদিযুগে কোম্পানির গণ্যমান্য কর্মচারীরা একসময় সস্ত্রীক এই উদ্যানে আমোদ প্রমোদ করতে আসতেন বলে জানা যায়। ১৭৪৬ সাল নাগাদ এই উদ্যানে ইংরেজ যাতায়াত উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল। ১৭৫২ সালে ২৫,০০০ টাকায় এই উদ্যানটি বিক্রি হয়ে যায়। যাঁর নামে এই উদ্যান, সেই ক্যাপ্টেন পেরিন ছিলেন বহু জাহাজের মালিক।
১৭৫৪ সালে কর্নেল সি এফ স্কট এই অঞ্চলের উত্তর ভাগে একটি বারুদ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করেছিলেন।
কলকাতার অন্যতম ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী জমিদার ‘ব্ল্যাক জমিদার’ নামে পরিচিত গোবিন্দরাম মিত্রের পুত্র রঘু মিত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালেই বাগবাজারের বিখ্যাত বাগবাজার ঘাটটি নির্মাণ করান। ১৭৫৬ সালের ১৭৫৬ তারিখে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করলে বাগবাজারের অদূরেই কোম্পানির সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত লালদিঘির যুদ্ধটি ঘটে। এই যুদ্ধে সিরাজ জয়লাভ করেন ও কলকাতা অধিকার করে নেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার যে বিশিষ্ট মানুষটির সঙ্গে বাগবাজারের নাম ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে পড়ে, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ। সম্ভবত ১৮৭৭ সালে প্রথমবার তিনি বাগবাজারে এসেছিলেন। ৪০, বোসপাড়া লেনে (বর্তমান নাম মা সারদামণি সরণি) কালীনাথ বসুর পৈত্রিক বাসভবনে তিনি আসেন। এখানেই হরিনাথ চট্টোপাধ্যায় (পরবর্তীকালে স্বামী তুরীয়ানন্দ), গদাধর ঘটক (গঙ্গোপাধ্যায়) (পরবর্তীকালে স্বামী অখণ্ডানন্দ) ও বিশিষ্ট নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে।
রামকৃষ্ণ মিশনের সংঘ-জননী সারদা দেবীর কলকাতায় বসবাসের সুবিধার জন্য মিশন বাগবাজারেই তাঁর জন্য একটি সুউচ্চ তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন। বর্তমানে এই বাড়িটি ‘মায়ের বাড়ি’ নামে পরিচিত এবং মিশনের বাংলা মুখপত্র উদ্বোধন পত্রিকার কার্যালয়। এই বাড়ি থেকে সামান্য দূরে মারাঠা খাল ও গঙ্গার মিলনস্থলটি দেখা যায়। বাড়ি সম্মুখস্থ রাস্তাটির নাম মুখার্জ্জী লেন থেকে পরিবর্তিত করে উদ্বোধন লেন করা হয়েছে। বাড়ির দক্ষিণে কাশী মিত্র শ্মশানঘাট ও শ্মশানেশ্বর শিব মন্দির অবস্থিত।
বাগবাজার অঞ্চলের উত্তরে বাগবাজার খাল (মারহাট্টা ডিচ) , পূর্বে শ্যামবাজার, দক্ষিণে শোভাবাজার ও কুমারটুলি এবং পশ্চিমে প্রবাহিত হুগলি নদী। সুপ্রাচীন চিৎপুর রোড (বর্তমান নাম রবীন্দ্র সরণি) সুদীর্ঘকাল ধরেই বাগবাজার অঞ্চলের জীবনরেখা। সাবর্ণ রায়চৌধুরী নির্মিত হালিশহর থেকে বেহালা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি তীর্থপথের (এই নিয়ে পূর্বেই অনেক আলোচনা করা হয়ে গেছে) উপরে এই রাস্তা নির্মিত হয়েছিল। ১৯০৪ সালে এই পথ ধরেই ট্রামলাইন বাগবাজার অবধি বিস্তৃত করা হয়।
বাগবাজার বাংলার বহু কৃতি সন্তানের বাসভূমি। তাছাড়া কলকাতার সংস্কৃতি আন্দোলনের সঙ্গেও এই অঞ্চলের নাম বিশেষভাবে জড়িত। ১২৫ বছরের পুরনো বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরিটি শহরের অন্যতম প্রাচীন লাইব্রেরি। বাগবাজার সার্বজনীন সুপ্রাচীন দুর্গাপূজাও কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও জনপ্রিয় বারোয়ারি দুর্গাপূজা। এই পূজাটিও বাগবাজার স্ট্রিটেই অনুষ্ঠিত হয়।
রামকৃষ্ণ ভক্তসমাজ এই অঞ্চলের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করেন। বাংলা সাহিত্যেও এই অঞ্চলের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষত আলালের ঘরের দুলাল গ্রন্থে প্যারীচাঁদ মিত্র বাগবাজার ঘাটে স্নানরতা মেয়েদের কথোপকথনের একটি মনোজ্ঞ বর্ণনা দিয়েছেন।
তথ্য সূত্রঃ
বাংলা স্থাননাম, সুকুমার সেন, আনন্দ পাবলিশার্স
আলালের ঘরের দুলাল : বসুমতী কর্পোরেশন লিমিটেড (কলকাতা) সংস্করণ
উইকি
ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: