আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ একটি গোপনীয় দলিল প্রকাশ । যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।
একটি গোপনীয় দলিল প্রকাশ
পরিশিষ্ট : ৫ একটি গোপনীয় দলিল প্রকাশ এটি চৌধুরী কর্তৃক দৈনিক ডন, ২৩শে ও ২৬শে
জুলাই ১৯৮৬
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী : এখনো প্রকাশ করার সময় হয় নি!
এ রিপোর্টের লক্ষ্য হচ্ছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত ও সমর্থিত অখণ্ডণীয় প্রমাণের ভিত্তিতে একটি মিথ্যা নাটকের রহস্য উন্মোচন করা। একটি গণতান্ত্রিক সরকার জাতীয় ইতহিাসের একটি অবিস্মরণীয় ও ক্ষমাহীন ঘটনা সম্পর্কে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছিল।
এ সরকার এ ঘটনা তদন্তে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করেছিল। কিন্তু গোপন রাখা হয়েছে এ কমিশনের রিপোর্ট। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি গণতান্ত্রিক সরকার কেন এমন করতর গেল, এর রহস্য উদ্ঘাটন করা প্রয়োজন।
তদানীন্তন সরকার হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট পরিবর্তন অথবা এ রিপোর্টের সমালোচনা না করে দুই তিন দশকের জন্য এ রিপোর্ট প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এটা সচিবালয়ের মোহাফেজখানায় তালাবদ্ধ করে রাখতে পারতো।
কারণ, তখন আবেগ ছিল তুঙ্গে এবং পরিস্থিতি ছিল উত্থান- পাতাল। পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এ রিপোর্ট প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তাতে খুব এটা দোষ হতো না। সব গণতান্ত্রিক দেশেই এমন করা হয়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, সকল গণতান্ত্রিক দেশে ঐতিহাসিক দলিলগুলো গোপন রাখা হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এগুলো প্রকাশ করা হয়।
কারণ, তখন ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের জীবিত থাকার সম্ভাবনা থাকে কম। ততোদিনে জনগণের আবেগও প্রশমিত হয়ে আসে এবং ঘটনার বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ করার মতো ইতিহাসবিদ ও প্রত্যক্ষদর্শী ও খুব একটা উপস্থিত থাকেন না ।
জনগণের নির্বাচিত সাবেক সরকার যেসব কাজ করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে :
ক. কমিশনের রিপোর্টে দোষী প্রমাণিত কয়েকজন জেনারেলকে কোর্ট মার্শালে। বিচার করার পরিবর্তে তাদেরকে অবসরে পাঠায় এবং অন্যান্যদের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বিদেশে কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োগ করে। অপরাধ ও ভুলের জন্য শাস্তি না দিয়ে কয়েকজনকে দেওয়া হয় পুরস্কার।
খ. বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে জনসমক্ষে এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। যে অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে সেখানে রয়েছে পরাশক্তিসহ কয়েকটি বিদেশি শক্তির পাঠানো অতি গোপনীয় বার্তা অথবা গোপনীয় সরকারি দলিল। নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো জাতীয় স্বার্থে সংরক্ষণ করা উচিত ছিল।
যুক্তিসঙ্গত পথ পরিহার করে পিপিপি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা হাম্দ রিপোর্টকে শুধু প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতেই পরিণত করে নি, তারা এ রিপোর্টকে এক পেশে, সংক্ষিপ্ত ও পক্ষপাতমূলক আখ্যায়িত করে সমালোচনাও করেছে।
রিপোর্টটিকে অপর্যাপ্ত দেখতে পেয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর লোকজন তাদের নেতাকে ছাড়া অন্য কাউকে দোষারোপ করতে পারে নি। এ কমিশন গঠনের সময় জুলফিকার আলী ভুট্টো এর সীমারেখা বেঁধে দিয়েছিলেন এবং তদন্তের পরিধি সংকুচিত করেছিলেন।

বিশ্বস্ত সূত্রের ভিত্তিতে জানা গেছে যে, তদন্ত কমিশনকে সামরিক বিপর্যয়ের মধ্যেই তাদের তদন্ত সীমাবদ্ধ রাখার এবং আত্মসমর্পণের জন্য দায়ী রাজনৈতিক ঘটনাবলী চাপা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বিচারপতি হামুদুর রহমান ঢাকার অনাকাঙ্ক্ষিত পতনের পূর্বের পরিস্থতিকে সামগ্রিকভাবে বিচারের জন্য তদন্তের পরিধি বিস্তৃত করার সুপারিশ করেছিলেন বলে শোনা যায়। এখানে উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার।
এই উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে কমিশন গঠনেও। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ কমিশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন এমন একজন বিচারপতি যার সততা সম্পর্কে সন্দেহ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, তিনি ছিলেন জন্মগতভাবে একজন পূর্ব পাকিস্তানি।
পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ায় তিনি অবশ্যই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তদন্তে তার এ মানসিক দুর্বলতার প্রতিফলন ঘটা বিচিত্র নয়। তদন্ত কমিশনে কোনো নিরপেক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সুযোগ্য কোনো সামরিক বিশেষজ্ঞকেও রাখা হয় নি 1
তবে একথা সত্য যে, তদন্ত কমিশন পরবর্তীকালে তদন্ত কার্যে দুই জন সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু তাদের নিয়োগ বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে যে দুই জনকে নিয়োগ করা হয় তাদের একজন হলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আলতাফ কাদির এবং অন্যজন হলেন মেজর জেনারেল কোরেশী। মেজর জেনারেল কোরেশী ‘পাকিস্তান আর্মি’ নামে একটি বই লিখেছেন। তার সাথে তদানীন্তন সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং সরকার তাকে খুব বিশ্বাস করতো।
তদানীওন সরকার হামুদুর রহমান কমিশনের শর্তাবলি সীমিত করে দেওয়ায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, এ কমিশনের রিপোর্টকে সরকার তার মন মতো করে তৈরি করাতে চেয়েছিল। তদানীন্তন সরকার বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের ব্যবচ্ছেদ এবং সামরিক বিপর্যয়ের রাজনেতিক পটভূমি গোপন রাখতে চেয়েছিল। এটা দুঃখজনক যে, তদন্ত কমিশন সরকারের এ হীন উদ্দেশ্যে নীরবে সায় দিয়েছে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর হুকুম শিরোধার্য করেছে।
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা গেছে যে, রিপোর্টে ‘ক্ষমতা দখলকারী’ হিসেবে ইয়াহিয়ার বিচারের সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে কমিশন ইয়াহিয়া খানকে অসময়ে আত্মসমর্পণের নির্দেশদান এবং পাকিস্তানের বিরাট ট্রাজেডির জন্য দায়ী। করে বিচারের সুপারিশ করে নি। একথা সত্য যে, ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট আইউবকে হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন।
এটা তার যতো বড়ো দোষ তার চেয়ে হাজার গুণ বড়ো দোষ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে বিপর্যয়ে তার বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ ভূমিকা। ইয়াহিয়া খানকে ছাড় দিয়ে সুপারিশ করা হলেও তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা তার বিচারের চেষ্টা করে নি। এসব দেশপ্রেমিকরা পুরনো পাকিস্তানের ধ্বংস্তূপের ওপর ‘নতুন পাকিস্তান’ গড়তে চেয়েছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, মূল খলনায়কে কেন অব্যাহতি দেওয়া হলো? এটা কি এ জন্য যে, তার বিচার হলে মূল নায়কদের মুখোশ উন্মোচিত হবে এবং প্যান্ডোরার বাক্স খুলে যাবে।
এ বিয়োগান্ত নাটকের প্রধান প্রধান চরিত্রের উল্লেখ করতে গিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর একজন জীবনীকার অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ‘১৯৭১ সালের বিপর্যয়ের জন্য ইয়াহিয়া খান, মুজিব ও জুলফিকার আলী ভুট্টো দায়ী।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘অনেকের মতে, এ তিন জনের মধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন সবচেয়ে চতুর রাজনীতিক। তার কার্যকলাপের পরিণাম উপলব্ধি করার মতো যথেষ্ট শিক্ষা ও জ্ঞান তার ছিল। সুতরাং এ বিয়োগান্ত ঘটনার সিংহভাগ দায়িত্ব অবশ্যই তাকে গ্রহণ করতে হবে।
(ভূট্টো : এ পলিটিক্যাল বায়োগ্রাফি : সালমান তাসির) জুলফিকার আলী ভুট্টো কেন হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে গোপন করেছিলেন তা উপরের উক্তি থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর জীবনী লেখক সালমান তাসির আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘জুলফিকার আলী ভুট্টো এ রিপোর্ট প্রকাশে কখনো সাহস পান নি।
কারণ, যেসব রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও ভ্রান্তিতে দেশ ভেঙে গেছে তিনি সেগুলোতে অত্যন্ত গভীরভাবে জড়িত ছিলেন।’ হ্যাঁ, তিনি তাই ছিলেন। কমিশন যে পরিস্থিতিতে কাজ করছিল সে পরিস্থিতিতে জুলফিকার আলী ভূট্টোর অনুকূলে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া ছাড়া। কমিশনের গত্যন্তর ছিল না। কমিশন চূড়ান্ত রিপোর্টে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভূমিকা এড়িয়ে যায় এবং মুজিব ও ইয়াহিয়া খানকে দোষারোপ করে। নিজের দোষ প্রকাশ পাবার ভয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো গোপনে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছিলেন।
ঢাকার পতন ঘটার আগে জুলফিকার আলী ভূট্টো প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে, দেশে তিনটি শক্তিশালী পক্ষ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে আওয়ামী লীগ, সেনাবাহিনী ও পিপিপি। পিপিপিকে একটি একক শক্তিতে পরিণত করার জন্য এ ত্রিভুজ শক্তিকে ভেঙে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল।
ক্ষমতার একক উত্তরাধিকারী হিসেবে পিপিপি’র আবির্ভাবের জন্য তা ভেঙে দিতে হয়েছে। ১৯৭১ সালের মার্চে এ ‘তিনটি শক্তির’ দুটি যখন সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তখনই এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে অবশিষ্ট পাকিস্তানের ক্ষমতার লাগাম ধরার জন্য জুলফিকার আলী ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানানো হলে এ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।
ক্ষমতায় বসেই তিনি ক্ষমতার অন্যান্য কেন্দ্র ধ্বংস অথবা অন্তত সেগুলোকে দুর্বল করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। এ লক্ষ্য অর্জনের তিনি দুটি বিষয়ে মনোযোগ নিবন্ধ করেন। একটি হচ্ছে যুদ্ধবন্দি এবং অন্যটি হচ্ছে হামুদুর রহমান কমিশন। তিনি ১৩ হাজার যুদ্ধবন্দির সাথে ৪৫ হাজার ছিল সৈন্য এবং বাদ-বাকিরা বেসামরিক লোকজন।
এ সত্যকে কখনো তুলে ধরা হয় নি। হামুদুর রহমান কমিশন যতো সত্য প্রকাশ করেছে, গোপন করেছে তার চেয়েও বেশি। জুলফিকার আলী ভুট্টো এ কমিশনের রিপোর্ট সম্পর্কে এমন একটা ধারণা দিতেন যে, একটি টাইম বোমা রয়েছে তার কাছে। তিনি যাদের ভয় পেতেন তাদের মাথার ওপর ডেমোক্লিসের তরবারির মতো এ রিপোর্ট ঘোরাতেন এবং যাদের পুষতেন তাদের মাথার ওপর।
আরও দেখুন: