[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

এ এ কে নিয়াজি-দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের সূচিপত্র

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ এ এ কে নিয়াজি-দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের সূচিপত্র।

Table of Contents

এ এ কে নিয়াজি-দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের সূচিপত্র

 

এ এ কে নিয়াজি-দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের সূচিপত্র

 

অনুবাদকের কথা

১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ছিলেন। যুদ্ধের প্রায় পুরো সময়টাই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে কাটান। ১৬ই ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তিনি মিত্রবাহিনীর নিকট নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেন। যুদ্ধে পরাজয়ের পর তাকে সহ তার গোটা বাহিনীকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারত থেকে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ফেরেন নিয়াজি।

এই বইয়ে তিনি যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধপরবর্তী অনেক মূল্যবান কথা বলেছেন। তবে তিনি কয়েকটি কথা ঘুরে ফিরে বার বার বলেছেন। যেমন তিনি বলেছেন যে,

  1. যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তান সরকারের কাছে বার বার অস্ত্র ও সৈন্য চেয়েও কোনো সাহায্য পান নি। সাহায্য পেলে পাকিস্তানের জয় ছিল নিশ্চিত।
  2. যুদ্ধে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছে, সামরিক নয়।
  3. ভারতে বন্দি পাকিস্তানিদের দেশে ফিরিয়ে নিতে ভুট্টো সামান্যতম চেষ্টাও করেন নি।
  4. যুদ্ধে পরাজয়ের সকল দায় ইয়াহিয়া খানের উপর চাপিয়ে ভুট্টো হিরো সেজে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছেন ।
  5. ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দেবার নীল নকশা করে এবং তা যাতে যুদ্ধের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটে, তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নেন ইয়াহিয়া ও ভুট্টো। আর তাই যুদ্ধ, ছিল একটা প্রহসন মাত্র।
  6. যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি যোদ্ধা ছিল ৪৫ হাজারের মতো। কিন্তু ভুট্টো ও তার সরকার ৯৫ হাজারের অধিক বলে অপপ্রচার চালায়।

অবশ্য এ বইয়ে নিয়াজি তার যুদ্ধ পরিচালনা ও পরিকল্পনার যেসব বিবরণ দিয়েছেন তার অনেক কিছুই অতিরঞ্জিত করে বলেছেন। তিনি নিজের কৃতিত্বও অতিরঞ্জিত করেছেন। মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীকে তিনি অনেক খাটো করে দেখিয়েছেন |

অবশ্য বইটিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে পাকিস্তানের বিষয়ে। বিশেষ করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে। হামুদুর রহমান কমিশনের বিষয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে এই বইটিতে। যুদ্ধ পরবর্তী পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্কের বিষয়ও অনেক আলোচনা রয়েছে এই বইটিতে।

নিয়াজি ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান ফিরে গেলে সামরিক বাহিনী ও সরকারে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন তিনি, তার বিশদ বিবরণ উপস্থাপন করেছেন।তাই বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের নিকট বইটির গুরুত্ব বিবেচনা করে ভাষান্তর করা হলো। আশা করি রাজনীতি সচেতন দেশপ্রেমিক পাঠকদের ভালো লাগবে।

ভূ মি কা

আমাদের এই মানবজীবনে অনেক স্মৃতি জমা হয়। তবে এটাই সত্য যে, অপ্রিয় স্মৃতিগুলোকে ঝেড়ে ফেলে দেওয়া মানব চরিত্রের একটি সাধারণ ও স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এমন কিছু ঘটনা আমাদের জীবনে গভীর ছাপ ফেলে যেগুলোর স্মৃতি কখনো মুছে ফেলা সম্ভব হয় না।

এ ধরনের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হবার স্মৃতিগুলো এখনো আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কারণ, এ ঘটনা জাতিকে বিভক্ত করেছে এবং ভেঙে চুরমার করেছে তার অহংকার। এ স্মৃতিগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পরাজয়ের পর আমাকেসহ আমার পুরো বাহিনী ভারতে নিয়ে বন্দী করে রাখে। তারপর ১৯৭৪ সালে আমি ভারত থেকে ফিরলাম, ওখানে যুদ্ধবন্দী ছিলাম আমি। দেখতে পেলাম পাকিস্তানে রাজনৈতিক আবহ শাস্তিপূর্ণ অবস্থা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।

ক্ষমতা রয়েছে তাদের হাতে যাদের সংঘর্ষমূলক নীতির কারণে পাকিস্তান ভেঙেছে। আমার আশঙ্কা একেবারেই সত্য হলো। ইস্টার্ন সেনাদলের কাঁধে দায় চাপানো হয়েছে। ইন্টার্ন সেনাদলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছিল পাকিস্তানের ভাঙনে জুলফিকার আলি ভুট্টোর অসৎ ভূমিকা থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে ।

পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার সত্যকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছে। জাতিকে উত্তেজিত করা হয়েছে সাজানো ও বানানো মিথ্যে গল্প শুনিয়ে । ভুট্টোর নির্দেশে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স মেধা বিক্রি হওয়া লেখকদের ভাড়া করেছিল।

অবশ্য এতে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সেরও নিজস্ব অনেক স্বার্থ ছিল। জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে হাই কমান্ড এবং পশ্চিম রণাঙ্গনে কমান্ডারদের কৃতিত্ব ছিল অনেকটা শূন্যের কোঠায়। যুদ্ধের সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থেকেও এক সপ্তাহের আরো কম সময়ের মধ্যে তারা দেশে ৫ হাজার ৫০০ বর্গমাইল ভূখণ্ড হারায় ভারতের কাছে।

এ কলঙ্কের চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য তারা তৎপর হয়ে উঠেছিল। তারা নানা ধরনের চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে উঠেছিল। তবে এসব চক্রান্তে কোনো দেশপ্রেম ছিল না। ছিল কেবল যার যার নিজস্ব স্বার্থ। আর ছিল অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে কলঙ্কমুক্ত হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করা। আর তাতে তারা সাময়িক সফলও হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। সত্যটা একদিন প্রকাশ পায়-ই।

যুদ্ধ শেষ হয়েছে সেই ১৯৭১ সালে। সে হিসেবে আমার এই বই প্রকাশে যথেষ্ট বিলম্ব হয়েছে। তবে একেবারে প্রকাশ না করার চেয়ে দেরিতে প্রকাশ করা অনেক ভালো। অবশ্য বইটি এর পূর্বে প্রকাশ করা যেত না। কারণ, পরিস্থিতি এ বই প্রকাশের জন্য অনুকূলে ছিল না।

রাজনৈতিক কারণে ভুট্টো আমাকে গ্রেফতার করেছিলেন এবং জেনারেল জিয়াউল হক আমাকে কারাগারে আটকে রেখেছিলেন। মি. ভুট্টো সিজারের চেয়ে পরাক্রমশালী ছিলেন, ক্ষমতা বলে তিনি হয়েছিলেন চিহ্ন মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। এ পদবি তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও ব্যবহার করেছেন।

এটি পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড। তিনি কখনো এ বইটি প্রকাশের অনুমতি দিতেন না। কারণ, এতে তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো। জেনারেল জিয়াউল হক সরকারের আচরণ ছিল আরো নিষ্ঠুর। উভয় সরকারের কর্ণধারেরা পুরো ব্যাপারটিকে খুব ভয় পেতেন এবং তারা চান নি সত্য প্রকাশিত হোক। আর পাকিস্তানবাসী সত্যটা জেনে ফেলুক।

আমার এই সকল গল্প এক লড়াকু সৈনিকের ব্যক্তিগত কাহিনি, যে ছিল ভাগ্যবান। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতের সাথে পাকিস্তানের সব যুদ্ধে প্রায় সব ধরনের পরিবেশ ও আবহাওয়ায় লড়াই করার সুযোগ পেয়েছি।

আমি একজন সৈনিক হিসেবে আরো ভাগ্যবান যে, একটা ক্ষুদ্র প্লাটুন থেকে বিশাল বাহিনী, ইস্টার্ন সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছি, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী। আর অপারেশনের জায়গা ছিল মূল ভূখণ্ড পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বহু দূরে।

নানা প্রতিকূল পরিবেশে আমি যুদ্ধ করেছি এটা সত্য যে, সামরিক কমান্ডার হিসেবে আমি এক কঠিন স্থানে দায়িত্ব পেয়েছিলাম। আমাদের নিজেদের জনগণ, বাঙালিরা কেবল আমাদের প্রতি বৈরীই ছিল না, তারা সক্রিয়ভাবে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সব ধরনের সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছে।

আমার হাই কমান্ড অবস্থান করছিল ১ হাজার মাইল দূরে। তাই আমি সঠিক সময়ে তেমন কোনো পরামর্শ পাই নি। একই সাথে হাই কমান্ডকে এই যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হতেও আগ্রহী মনে হয় নি তেমন একটা। আমার অধীনস্থ বাহিনী ছিল দুর্বল। এবং অপর্যাপ্ত অস্ত্রে সজ্জিত। উল্লেখ করার মতো আমাদের কোনো বিমান বা নৌ-সাহায্য ছিল না। তা সত্ত্বেও আমি যুদ্ধ চালিয়ে গেছি।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের ঠিক পরপর জুলফিকার আলী ভুট্টো অর্থনৈতিক বিভাগের উপদেষ্টা এম এম আহমদ এবং পরিকল্পনা বিভাগের ডেপুটি চেয়ারম্যান মি. কামরুল ইসলামকে নির্দেশ দেন একটি কাগজ তৈরির জন্য, যেখানে প্রমাণ থাকবে যে, পূর্ব পাকিস্তান ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান ভালোভাবে টিকে থাকতে পারবে।

১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেজর জেনারেল ওমর রাজনীতিবিদদের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকায় যেতে কঠোরভাবে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দেওয়াই বরং ভালো।’ কী ভয়াবহ কথা! এটা কোনো দেশপ্রেমের কথা নয়।

জুলফিকার আলী ভুট্টো হুমকি দেন, অ্যাসেমরির যে সব নির্বাচিত সদস্য অধিবেশনে যোগদানের জন্য ঢাকা যাবেন, তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হবে।’ তিনি চূড়ান্তভাবে বলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের পরস্পর আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত।’

এটা তিনি বলেন তার বিখ্যাত ভাষায় ইধার হাম, উধার তুম’ (আমি এপাশে, তুমি ওপাশে)। মূলত জুলফিকার আলী ভুট্টো অখণ্ড পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকা গ্রহণ করার জন্য একটুও প্রস্তুত ছিলেন না। সব সময় তার প্রচেষ্টা ছিল সরকার গঠনে মুজিবের সাথে আপস করা। আর এটা কেবল সম্ভব হবে যদি পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করতে পারে।

আমার জানা মতে, পাকিস্তান ভাঙার চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয় ভুট্টোর নিজ শহর লারকানায় জেনারেল ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে এক গোপন সমঝোতার বৈঠকে। এ পরিকল্পনা যা এম এম আহমদ পরিকল্পনা’ নামে পরিচিত । এর লক্ষ্য ছিল একজন উত্তরাধিকারী সরকারবিহীন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করা, যার অর্থ যুদ্ধে হেরে যাওয়া’।

সুতরাং জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র ও ভুট্টোর স্বার্থানেষী ব্যক্তিদের গোষ্ঠীর সকল কর্মকাণ্ড যুদ্ধে হেরে যাবার লক্ষ্যে ধাবিত হয়। তারা রাজনৈতিক নিষ্পত্তি অথবা যুদ্ধ বিরতি কোনোটাই চান নি। ‘পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ হবে পশ্চিম পাকিস্তানে, এ ধরনের একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় পাকিস্তানের সেই জন্য লগ্ন থেকেই। কিন্তু তারা কাজ করতে থাকেন তাদের নিখুঁত পরিকল্পনায়- একটি উত্তরাধিকারী সরকারবিহীন অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করো।’

এটা সত্য দীর্ঘ ৮ মাসব্যাপী বিদ্রোহ সত্ত্বেও ভারত পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে কোনো বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। একটা হতাশা থেকে ভারত ১৯৭১ সালের ২১শে নভেম্বর বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে প্রবেশ করে।

এ যুদ্ধে তারা আধা-সামরিক বাহিনীসহ প্রায় ৫ লাখ সৈন্যের বিশাল সমাবেশ ঘটায়। এ ছাড়া প্রস্তুত রাখা হয় চীন সীমান্তে মোতায়েন করা আরো ৫ লাখ সৈন্য। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে ভারতীয় হামলা সম্পর্কে জানানো হলে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আমি কী-ই বা করতে পারি? আমি পারি কেবল প্রার্থনা করতে।’

এই একটি বাক্য দ্বারা ইয়াহিয়া খান দেশের প্রধান ও সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তার সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ করেন। অথচ জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার ‘প্রার্থনা’ না করে আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা অনুসারে অর্থাৎ “পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ হবে পশ্চিম পাকিস্তানে’-এ পরিকল্পনায় ব্যাপক যুদ্ধ শুরু করতে পারতেন, যার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে ইতোমধ্যে আমাদের বিপুল সংখ্যক সংরক্ষিত সৈন্যদের প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।

সংকেত পেলেই আমাদের এই সংরক্ষিত সৈন্যরা চলতে শুরু করত। পশ্চিমে আমাদের যেখানে ছিল পাঁচটি। স্ট্রাইকিং ফোর্স, সেখানে ভারতীয়দের ছিল মাত্র তিনটি। স্ট্রাইকিং কোর্সের দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব থাকায় এবং যুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণের মতো অবস্থানে থাকায় “আমাদের জয়লাভ করার সম্ভাবনা ছিল প্রতিটা ক্ষেত্রে। সহজে আমরা জয়লাভ করতাম।

পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকার ভারতীয় হামলার বিষয়টি তৎক্ষণাৎ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তুলতে চায় নি। এর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান ইস্টার্ন গ্যারিসনের ছোটো, সামান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ক্লান্ত সৈনিকদের পরাজিত করে ভারতকে জয়ী হবার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া।

দ্রুত পাল্টা আক্রমণ করার জন্য নয়, বরং পশ্চিমাংশের সৈনিকদের আবির্ভাব ঘটে একটা ভগ্ন এবং বিশৃঙ্খ প্রতিষ্ঠান হিসেবে। আর এ অবস্থা ইস্টার্ন গ্যারিসনের অবস্থানকে আরো সঙ্কটপূর্ণ করে তোলে। তাদের হেরে যাবার পথকে প্রশস্ত করে দেয় তবে যা হোক, আমাদের সব ঘাটতি এবং হাই কমান্ডের বিমাতাসুলভ আচরণ সত্ত্বেও ক্ষুধা, তৃষ্ণা এবং যুদ্ধে অবসন্নতা সত্ত্বেও আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি এবং আমাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সাথে আমরা পালন করেছি।

পক্ষান্তরে, ওয়েস্টার্ন গ্যারিসন সব সুযোগ-সুবিধা এবং অনুকূল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও চরম বিশৃঙ্খল এবং ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় পতিত হয়। তারা ৫ হাজার ৫০০ বর্গমাইল ভূখণ্ড হারায় এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান ধ্বংস করার মতো অবস্থানে পৌঁছে যায় তাদের সুপ্রিম কমান্ডারের তত্ত্বাবধানে এবং তার অধীনস্থ তিন বাহিনী (আর্মি, নেভি, ও এয়ার ফোর্স)-এর নিস্তেজ প্রতিরোধের কারণে। এটা ছিল আমার জন্য চরম কষ্টের।

তাই আমি এখানে জোর দিয়ে বলতে চাই যে, যেখানে শত্রুরা সংখ্যায় ছিল বেশি এবং তাদের অবস্থাও যেখানে ছিল অনুকূলে, সেখানে আমার কমান্ডাররা এবং আমি অত্যন্ত সীমিত সম্পদ ও শক্তি দিয়ে যা অর্জন করেছি তা সম্ভব হয়েছে আমার কমান্ডারদের আত্মত্যাগ, সাহস এবং প্রবল কর্তব্য পরায়ণতার জন্য। তারা কোনো দ্বিধা না করেই তাদের সামর্থ, ইচ্ছা ও প্রস্তুতি নিয়ে তাদের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। তারা নিজ জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন।

আর এসব গুণ আমাদেরকে এনে দিয়েছে সফলতা এবং এর কারণে আমাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ও দূর্গসমূহের সামনে ভারতীয় সেনাবাহিনী নিশ্চল হয়ে পড়ে। আমরা একটি শক্তিশালী শত্রুকে তাদের লক্ষ্য অর্জনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছি এবং আমরা তখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতো সঠিক এবং যথাযথ অবস্থায় ছিলাম।

আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু জান্তার পরিকল্পনায় তা ছিল না। আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয় অস্ত্র সমর্পণের। যখন আমি ইতস্তত করছিলাম, তখন আমাকে বলা হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানের অবস্থা চরম সঙ্কটপূর্ণ। এরপর পশ্চিম পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের রক্ষা করতে আমাদেরকে আত্মসমর্পণের জোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য এ অপমান মেনে নিলাম। ১৫ই ডিসেম্বরের পোল্যান্ড অথবা রাশিয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে আমরা আমাদের সম্মান তথা দেশকে অতি সহজে রক্ষা করতে পারতাম। আমরা অবশ্যই আত্মসমর্পণের অপমান এড়িয়ে যেতে পারতাম যদি তারা আমাদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার অনুমতি দিতো। এটাই ছিল আমাদের জয়ের একমাত্র পথ।

আমি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। আমার অন্যান্য সৈনিক ও কর্মকর্তাদের উদ্বুদ্ধ করেছি। আমি জয়ী হতে চেয়েছি। তবে আমার ওপর অর্পিত কাজ এবং অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থায় যেমন আমার আওতায় অল্পসম্পদ, ভারী অস্ত্রশস্ত্রের অভাব এবং বিমান ও নৌবাহিনীর অনুপস্থিতি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে এবং তুলনা করতে হবে ওয়েস্টার্ন গ্যারিসনের দুঃখদায়ক কীর্তির সাথে, যার ছিল সকল সুবিধা।

এসব না বুঝলে পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র বোঝা কঠিন হবে। এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের পতন হয় যা ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং মি. ভুট্টোর পূর্ব পরিকল্পিত ও সাজানো ষড়যন্ত্র । আর তাই আমাদের পরাজয় ঘটে। তবে এ পরাজয় সামরিক পরাজয় নয়, এটা রাজনৈতিক পরাজয়। এ পরাজয় ঘটে স্রেফ ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রে ফলে। এতে করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

অধ্যায় : ১ : প্রাথমিক জীবন

অধ্যায় : ২ : ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ

অধ্যায় : ৩: বিচ্ছিন্নতার জন্য যেসব ঘটনা দায়ী

অধ্যায় : ৪ : আমি হলাম কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ড

অধ্যায় : ৫ : পূর্ব পাকিস্তানের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং সৈন্য মোতায়েন

অধ্যায় : ৬ : মুক্তি বাহিনী ও আমাদের বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী

অধ্যায় : ৭ : ১৯৭১ সালের যুদ্ধপরিকল্পনা

অধ্যায়: ৮ : যুদ্ধের কালো মেঘ

অধ্যায় : ৯ : আক্রমণ

অধ্যায় : ১০ : বিভিন্ন সেক্টর ভিত্তিক যুদ্ধ

অধ্যায় : ১১: শুরু হলো পাকিস্তানের ভাঙন

অধ্যায় : ১২ : ঢাকা বৃত্ত সম্পর্কিত ভুল ধারণা এবং ভারতীয় পরিকল্পনা

অধ্যায় : ১৩ যুদ্ধের শেষ দিকে পরিকল্পিত বিপর্যয়

অধ্যায় : ১৪ : আমাদের আত্মসমর্পণ এবং যুদ্ধবন্দি শিবির নম্বর ১০০

অধ্যায় : ১৫ : আমার পাকিস্তানে ফিরে আসা

অধ্যায়: ১৬ হামুদুর রহমান কমিশন প্রসঙ্গ

অধ্যায় : ১৭ : আমার বেসামরিক জীবন যাপন

অধ্যায়: ১৮: উপসংহার

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সূত্রপাত

আমার এ বইটি প্রকাশে অনেক দেরি হয়ে গেল। অনিবার্য কারণেই দেরিটা হয়েছে। তবে বই প্রকাশে দেরি হওয়াটা হয়েছে শাপে বর। এটা অবশ্য অমোঘ সত্য যে, সত্য যে সময় হচ্ছে একটা বিরাট আরোগ্যের অধিকারী। এটা মিথ্যার প্রকাশ ঘটায়।

যদি বইটা আগে লিখতাম, তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না বিশেষ কিছু কারণে। সময় এগিয়ে যাওয়ায় বেশ কিছু সত্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, পাকিস্তানের বিভক্তি ছিল একটা সাজানো আত্মসমর্পণ, কোনো সামরিক ব্যর্থতা সেখানে ছিল না।

সামরিক কোনো ব্যাপারও ছিল না। আমাদের সৈনিদের সাহসের কোনো কমতি ছিল না। সে সময় যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের অনেক আগেই পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধটা ছিল কেবল। উপলক্ষ মাত্র। এটা সত্য যে, লারকানা পরিকল্পনা অনুযায়ী জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং মি. ভুট্টোর মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়, পূর্ব পাকিস্তানকে ছেড়ে আসা হবে একটা উত্তরাধিকারী সরকারবিহীন অবস্থায়।

‘পাকিস্তান’স ন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রবলেমস’-বইয়ের লেখিকা ফরিদা আহমেদ আমাকে লিখে জানিয়েছেন যে, আগা শাহী এক সাক্ষাৎকারে তাকে বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৯ই ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন সৈন্যদের আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে যাবার জন্য জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানি প্রতিনিধিকে জোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ঠিক সে সময় আমরা সীমান্তে অথবা সীমান্তের কাছাকাছি শত্রুদের ক্ষণিকের জন্য ঠেকিয়ে রেখেছিলাম। শত্রুদের অব্যাহত হামলা প্রতিরোধ করেও সৈন্যরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। সময় মতো সৈন্য এবং অস্ত্র এলে আমাদের জয় ছিল অনিবার্য।

১৯৭১ সালের শোকাবহ ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনো ভেসে ওঠে দ্বন্দু, রক্তপাত এবং ধ্বংসযজ্ঞের তিক্ত স্মৃতি। এটা হচ্ছে পুরো সামরিক শক্তি সমর্থিত একটা রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কাহিনি, যাতে বাইরে থেকে সাহায্য করেছে এবং উৎসাহ যুগিয়েছে আমাদের শত্রুরা, যার পরিণামে ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে দেশ।

অভ্যুদয় ঘটেছে বাংলাদেশের। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর গভীর নীল নকশার ফল -এটা আমি মনে করি যে, পাকিস্তানের ভাঙন এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা পাল্টে দিয়েছে এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ভারসাম্য।

ঘটনার গুরুত্ব আকর্ষণ করেছে অসংখ্য লেখকের মনোযোগ। কিন্তু খুব কম সংখ্যক লেখকই এ সংকটকে সঠিক দৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম হয়েছেন। অধিকাংশ লেখক লিখেছেন। একেবারে শোনা কথা, অনুমান আর গুজবের ওপর ভিত্তি করে যা প্রকৃত ঘটনা থেকে অনেক অনেক দূরে।

তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অধিকাংশ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। আমি এসব লেখকের নাম ও ভুলগুলো উল্লেখ করতে চাই না। কারণ, তারা স্বার্থান্বেষী, লোভী ও স্বার্থপর। তাদেরকে লাইটে আনা আমার কোনো উদ্দেশ্য নয় ।

পাকিস্তানের সামরিক কর্মকর্তরাও এ রকম কিছু বই লিখেছেন। ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ’ নামে একটি বই লিখেছেন মেজর জেনারেল (অব.) ফজল মুকিম, যাকে এ কাজে নিযুক্ত করেছিলেন জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল টিক্কা খান (তারা প্রথমে অনুরোধ করেছিলেন মেজর জেনারেল সরফরাজকে।

কিন্তু তিনি তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন)। এ বইয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বহু তথ্য বিকৃত করা হয়েছে। ফজল মুকিম পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধের বর্ণনা লিখেছেন রাওয়ালপিন্ডিতে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে বসে, যারা যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন এবং যারা যুদ্ধ করেছেন তাদের সাথে কোনো কথা না বলেই ।

তিনি তার বইয়ে নির্ভর করেছেন ভারতীয় লেখক ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ফেরত পাঠানো লোকদের বক্তব্যের ওপর। তার বেশির ভাগ তথ্য এবং উপস্থাপনা একেবারে ভুলে ভরা।

সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (অব.) ফজল মুকিমকে একজন স্টাফ অফিসার ও জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে একটি অফিস দেওয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাকে নাকি অর্থের জোগানও দেওয়া হয়েছিল। তাকে অধিকার দেওয়া হয়েছিল সকল গোপনীয় কাগজপত্র দেখার। কিন্তু সে অধিকার তার ছিল না। অথচ আমি দেশে ফেরার পর যখন আমি রিপোর্ট লিখছিলাম।

তখন আমাকে কোনো গোপনীয় কাগজপত্র দেখতে দেওয়া হয় নি। সরকারি প্রচার মাধ্যমে তার বইয়ের ব্যাপক প্রচার চালানো হয় এবং সেনা ইউনিটগুলোকে বলা হয় বইটি কিনতে। কোনো সরকারি বিতর্ক ছাড়াই বইটিকে যুদ্ধ সম্পর্কে জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সের ভাষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

জেনারেল টিক্কা খান তার পরামর্শদাতা জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোকে খুশি করার জন্য বইটি অনুমোদন করেন এবং পুরস্কার হিসেবে মুকিমকে প্রতিরক্ষা সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বেঈমানেরা এভাবেই পুরস্কৃত হয়।

ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামে একটি বই লিখেছেন। মেজর অবস্থায় তিনি ছিলেন আমার গণসংযোগ অফিসার (পিআরও)। বিভিন্ন সেনা সজ্জা এবং ইউনিট পরিদর্শনকালে তিনি আমার সাথে থাকতেন।

পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন একজন রিপোর্টার, সামরিক বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ তার ছিল না কিংবা ছিল না যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা। সামরিক অপারেশন সম্পর্কেও কিছু বুঝতেন না তিনি। এ ধরনের সামরিক বিষয়ের ব্যাপকতা ছিল তার ধারণার বাইরে। তিনি ফিল্ডে যুদ্ধ করেন নি।

সালিক যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারত থেকে ফেরার ঠিক পর পরই উর্দুতে একটি বই লেখেন যার নাম ‘হামান ইয়ারান দোজখ’। তার লেখা দুটি বইয়ের মধ্যে বৈষম্য এ কথাই সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি তার প্রভুদের খুশি করার জন্য একেবারে মনগড়া বিকৃত ঘটনার বিস্তর বর্ণনা দিয়েছিলেন। সালিক আমার বিরুদ্ধে লিখেছেন, অথচ আমিই তাকে রক্ষা করেছিলাম বাঙালিদের হাত থেকে, যারা তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

সিদ্দিক সালিকের বই ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ একরাশ মিথ্যের বেসাতি । ফজল মুকিমের মতো তিনিও জেনারেল টিক্কা এবং জনাব ভুট্টোর নির্দেশ মতো বইটি লেখেন আমার সুনামহানি করার জন্য। কিন্তু বইটি ছাপা হবার সময় ভুট্টোকে মৃত্যুবরণ করতে হয় ফাঁসিতে ঝুলে। আল্লাহ পাকের খেলা কাকে বলে।

জানতে পারি, আমার স্টাফ অফিসারদের একজন মেজর সালিককে আমার পিআরও হিসেবে পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রেসনোট দিতেন বিলি করার জন্য। সামরিক কাজ-কর্ম সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা জানেন যে শুধু সিনিয়র অফিসারদের এবং অপারেশনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের অপারেশন রুমে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। সালিক তার ‘হামান ইয়ারান দোজখ বইয়ে স্বীকার করেছেন যে, অপারেশন নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনায় তাকে অপারেশন রুমে প্রবেশ করার কোনো অনুমতি দেওয়া হতো না। তার বইয়ের

নামকরণও ঠিক নয়। সালিক ছিলেন আত্মসমর্পণের অংশ, আত্মসমর্পণের সাক্ষ্য নন। তাকে ভালোভাবেই পুরষ্কৃত করা হয়। তিনি ব্রিগেডিয়ার হন। একজন অনুপযুক্ত মিথ্যাবাদীকে এ রকমের পুরস্কার দেওয়া হয়।মজার কথা হলো, ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সম্পর্কে সরকারি ভাষা তৈরি করার জন্য জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স মেজর জেনারেল (অব) শওকত রেজাকে নিয়োগ করে। এর চেয়ে হাস্যকর আর কিছুই হতে পারে না।

একটি ডিভিশনের কমান্ড থেকে আমি তাকে অপসারণ করেছিলাম তার অযোগ্যতা, কাপুরুষতা এবং যুদ্ধের চাপ সহ্য করার মতো মনোবল না থাকার কারণে। তার “দি পাকিস্তান আর্মি ১৯৫৬-৭১’ বইটি পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন যুদ্ধের এবং সেনা ইউনিটের অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্যে ভরা। তিনি কেবল সে বইয়ে নিজের সাফাই গেয়েছেন।

সেই ১৯৭১ সালের যুদ্ধ সংক্রান্ত পূর্ব পাকিস্তানের ওপর আরেকটি বই লেখার জন্য জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) কামাল মতিনকে নিয়োগ করেছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো যে, জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স পূর্ব পাকিস্তানের ওপর এতো বই প্রকাশ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর কোনো বই প্রকাশ করছে না, যেখানে আমাদের জেতার মতো পর্যাপ্ত সৈন্য, সম্পদ এবং অনুকূল পরিবেশ ছিল। তবু আমাদের অপারেশনগুলো ভণ্ডুল হয়ে যায় এবং আলাদা হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান।

কুচক্রী জেনারেল টিক্কা খান এবং জুলফিকার আলী ভূট্টো নিজেদের ব্যর্থতা এবং অপকর্ম ঢাকার জন্য মুকিম ও সালিককে নিয়োগ করেছিলেন। তবে মতিনকে নিয়োগ করেন জেনারেল বেগ, যিনি মেজর জেনারেল (অব) শওকত রেজার স্টাফ অফিসার ছিলেন। কিন্তু মেয়াদকাল শেষ হবার আগেই তিনি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন। মতিন জেনারেল হেডকোয়ার্টার্সে বসে সব সুবিধা পাচ্ছেন এবং বই লিখছেন। তিনিও ছিলেন একজন সুবিধাবাদী।

আরেকটা বই, যেটা মেজর জেনারেল (অব) রাও ফরমান আলির লেখা “হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড’ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বইটা চরম মিথ্যায়। ভরা। চক্রান্ত ও জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি টিকেছিলেন পাঁচ গভর্নরের অধীনে।

তিনি ছিলেন চরম অসৎ চরিত্রের একজন লোক। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি গর্ভনর মালিকের আত্মবিশ্বাসকে দুর্বল করে দিয়েছিলেন একটা মিথ্যা সামরিক পরিস্থিতি চিত্রণের মাধ্যমে। আমাকে না জানিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে গোপন কিছু বার্তা পাঠান এবং প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের আগেই তিনি একটি অভ্যন্ত গোপনীয় বার্তা প্রকাশ করে দেন, যার স্পষ্ট অর্থ ছিল পাকিস্তান ভেঙে যাচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট এ বার্তা বাতিল করে দেন। তবে ততোক্ষণে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। ফরমান তার বইয়ে অসত্য কথা লিখেছেন। তিনি গোপনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল শ্যাম মানেকশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন।

ভারতের সাথে তার যোগাযোগের ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত জানতে পারি ১৫ই ডিসেম্বর জেনারেল শ্যাম মানেকশের বার্তার মাধ্যমে। তিনি বলছিলেন যে, ইতোমধ্যে তার সাথে আত্মসমর্পণের বিষয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে। এটা ছিল নিয়ম বহির্ভূত

তবে এ কথা সত্য যে, একটা যুদ্ধে কমান্ডিং জেনারেল এবং তার সৈন্যরা প্রধান ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এমন কিছু বিষয় থাকে যা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে অথচ বিষয়গুলোর ফল যুদ্ধে সুদূর প্রসারী। কেউ সামরিক পতনের ব্যাপারে বই লিখতে চাইবে তাকে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করতে হবে। আবহাওয়াজনিত অবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান, কমান্ডারের ওপর ন্যস্ত রাজনৈতিক ও সামরিক মিশন। এখানে এসব ব্যাপার অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

গুরুত্বপূর্ণ এবং এ ধরনের কাজের জন্য নিয়োজিত পর্যাপ্ত সৈন্য, দায়িত্ব। পালনের স্থানের বিস্তৃতি ও ধরণ, স্থানীয় পরিস্থিতি, জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি, পর্যাপ্ত সম্পদ, ঘাঁটি থেকে দূরত্ব, সঠিক ধরনের অস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জামের প্রাপ্যতা, নতুন ও অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েনের সামর্থ, রিজার্ভ সৈন্যের প্রাপ্যতা, নৌ ও বিমান সহায়তা, গোয়েন্দা সংস্থার বিন্যাস।

চিকিৎসা সুবিধা এবং শত্রুর শক্তি, সম্পদ ও পর্যাপ্ত সুবিধা- একজন কমান্ডিং জেনারেলের দক্ষতা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করার আগে অবশ্যই এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে। এগুলো কোনো মামুলি বিষয় নয়।আরেকটা কথা হলো, যেসব লেখক ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন তাদের প্রায় সবাই পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধকে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ থেকে একেবারে আলাদা করেছেন। এই বর্জন অন্যায় এবং চরম বিভ্রান্তিকর ।

পূর্ব ও পশ্চিমের যুদ্ধের পরিকল্পনা ছিল সহগামী এবং পরপর সংযুক্ত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো যুদ্ধ করা হয় নি। সত্যি কথা বলতে কি, পশ্চিম রণাঙ্গনেই ছিল মূল ও চূড়ান্ত যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধে ছিল জয়ের কথা। এ জয়কে আমরা ইচ্ছে করে হারের দিকে নিয়ে গেছি।

ঠিক একইভাবে অধিকাংশ লেখক যুদ্ধের পরিবেশগত উপাদান এবং তাদের প্রভাব বিবেচনায় আনেন নি। সামরিক অভিযানে জাতীয় কৌশল, রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা, অর্থনৈতিক সার্বিক অবস্থা, কূটনৈতিক আচরণ, সামরিক পদক্ষেপ এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক অভিযানকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা হলো বাস্তবতাকে এড়িয়ে যাওয়া, যা উচিত নয়।

কোনো সামরিক অভিযানের অর্থ হলো একটা লক্ষ্য অর্জনের উপায়। এটা হলো চাকার মধ্যে আরেকটি চাকা। সে কারণে একজন লেখকের জন্য যুদ্ধের সময় জাতীয় কৌশল এবং তার নিহিতার্থ উপলব্ধি করা গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে আলাদা করা ঠিক নয়।

আমার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের ওপর লেখা বইয়ের একজন লেখকও একটা বিশাল শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রতিকূল অবস্থায় আমার ওপর অর্পিত অথবা আমার ক্ষুদ্র, পরিশ্রান্ত ও অপর্যাপ্ত অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীর কথা বিবেচনা করেন নি। রাজনৈতিক পরাজয়টাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি।

বহু বছর পর এখন সময় এসেছে জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ও শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাদের বিশ্বস্ত লোকদের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সম্পর্কে সত্য কথা বলার। আমার বইয়ের কাহিনি হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত জ্ঞান এবং সত্যিকারভাবে আমার দেখা, অভিজ্ঞতা ও অনুভবের নথিপত্র। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, তারা সত্যটা জানবে।

 

এ এ কে নিয়াজি-দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তানের সূচিপত্র

 

পাকিস্তান আর্মির ইস্টার্ন কমান্ডের আমার বীর যোদ্ধারা যারা একটি বৈরি ভূখণ্ডে দীর্ঘ ৯ মাসব্যাপী নির্ভীকভাবে যুদ্ধ করেছে প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশে, যা পৃথিবীর আর কোনো বাহিনীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটে নি।

বিশ্রাম ছাড়া, আরাম ছাড়া, প্রয়োজনীয় সহায়তা ছাড়া, আমোদ-প্রমোদ ছাড়া, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং যাদেরকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে অস্ত্র সমর্পণ করে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে- তাদেরকে সমর্থন করা আমার নৈতিক দায়িত্ব। আমি সব সময় সর্বান্তঃকরণে সে কাজটি করেছি। নিজের স্বার্থে কোনো মিথ্যার আশ্রয় নিই নি।

আরও দেখুন:

Leave a Comment