আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ আমার বেসামরিক জীবন যাপন। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।
আমার বেসামরিক জীবন যাপন
আমার বেসামরিক জীবন-যাপন
ভারত থেকে ফিরে এলাম পাকিস্তানে। তারপর যখন আমি রাওয়ালপিন্ডিতে অবস্থান করছিলাম তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি কোনো কমিশনের কাছ থেকে ন্যায়বিচার পাবো না। তাই আমি সামরিক আদালত গঠনের প্রস্তাব করি।
সামরিক আদালত থেকেই ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে মতে। চার্জ গঠন করা হয়। কিন্তু ডেপুটি জজ এডভোকেট জেনারেল (ডিজেএজি) সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল টিক্কা খানকে জানান যে, অভিযোগগুলো খুবই দুর্বল এবং আমি সহজেই খালাস পেয়ে যাবো । এ জন্য আমাকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারণ করা হয়।
ভিজেএজি আমার সাথে এক সাক্ষাতে এ কথা স্বীকার করেছেন। টিক্কা খান আমাকে এক পক্ষকালের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে লাহোর সদর দপ্তরের স্টেশনকে নির্দেশ দেন। আমার নিজের কোনো বাড়ি ছিল না এবং কোনো বাড়ি কেনা অথবা ভাড়া নেওয়ার মতো অর্থও ছিল না। সুতরাং ৪০ বছরের চাকরি জীবনে আমার যা কিছু ছিল সবকিছু বিক্রি করে দিতে হয়।
আমি ভীষণ আঘাত পাই। য প্রতিকার করা যায় না তা মেনে নিতে হয়। সুতরাং আমি লাহোরে লরেন্স রোডে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় উঠি। স্ত্রী ও মেয়েকে পাঠিয়ে দিই ছেলের বাসায়। আমার ছেলে তখন সেনাবাহিনীর একজন মেজর।
বাড়ি নির্মাণের জন্য এক খণ্ড জমি বিক্রি করে দিই। ৪০ বছর চাকরি করে এ পুরস্কারই আমি পেয়েছিলাম। আমার প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। সম্ভবত জুলফিকার আলী জুলফিকার আলী ভুট্টোর নির্দেশে এ হামলা করা হয় ।
প্রখ্যাত রাজনীতিক ও আইনজীবী মিয়া মাহমুদ আলী কোরেশী এক পর্যায়ে আমার সাথে যোগাযোগ করেন। আমি যেসব কাগজপত্র সাথে করে নিয়ে যাই। সেগুলো তিনি মনোযোগ দিয়ে দেখেন এবং আমার সব কথা শুনে তিনি বলেন, ‘আপনার মামলা খুবই জোরালো। তবে ভুলবশত আপনাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’
আমি তখন তাকে জানালাম যে, আমি উন্মুক্ত বিচার চাই যাতে মূল অপরাধীদের চিহ্নিত করা যায়। হামুদুর রহমান কমিশনকে সক্রিয় করে তোলা সম্ভব হয় নি। এ কমিশনের সীমাবদ্ধতা থাকায় এবং সরকার, সেনাবাহিনী ও প্রশাসন ভুট্টো ও টিক্কার কথায় ওঠা-বসা করায় আমি তাদের কাছ থেকে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি নি। উন্মুক্ত বিচার হলে সত্য উদ্ঘাটিত হতো এবং প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করা যেতো।
আইনজীবী মাহমুদ আলী কোরেশী আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি আপনার মামলা নিয়ে লড়বো এবং আমি আপনার কাছ থেকে কোনো পয়সা নেবো না। আপনার কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও আপনি যথেষ্ট দুর্ভোগ ভোগ করেছেন। জনাব কোরেশী আমার মামলা নিয়ে অগ্রসর হবার আগেই ইস্তেকাল করেন তার মৃত্যুতে আমি আমার একজন মহৎ বন্ধু ও অভিভাবককে হারাই এবং মনে কষ্ট পাই ।
আবদুল কাইউম খান আমাকে একদিন টেলিফোন করেন এবং বলেন যে, কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করার জন্য তিনি আমার বাসায় আসছেন। তিনি আমাকে কাইউম মুসলিম লীগে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান।
তাকে আমি বললাম, ‘খান লালা, আপনি জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকারের একজন মন্ত্রী। সুতরাং তার প্রতি আপনার দুর্বলতা থাকাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে আমি তার বিপক্ষে। এ কারণে বিভিন্ন প্রশ্নে আপনার সাথে আমার মত-বিরোধ হতে পারে। আমি চাই না আপনার সাথে আমার মতবিরোধ হোক।
তিনি তখন বললেন, ‘রাজনীতিতে যোগদানের প্রস্তাব একটি ছলনা মাত্র। পাকিস্তানের বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডারের পদ গ্রহণে আপনাকে প্রস্তাব দিতে স্বয়ং জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাকে পাঠিয়েেেছন।’
আমি বললাম, খান লালা, এ পদ খুবই লোভনীয়। তবে আমি আবারো ‘না’ বলছি, জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাকে ঘৃণা করেন। আমি কোর্ট মার্শাল গঠন করতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি যথাযথ অভিযোগ গঠন করতে পারেন নি।
আমি আবার ইউনিফর্ম পরিধান করলে তিনি আমার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ আনতে পারেন এবং দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসিও দিতে পারেন । অতএব, আমি জুলফিকার আলী ভুট্টোর এ লোভনীয়। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছি। পরবর্তী সময়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাকে তলব করেন এবং বলেন গভীর জ্ঞান। সুতরাং আমি জেইউপি’তে যোগদান করি।
আমি মিয়ানওয়ালি থেকে ভাষারে যাই। ফিরে আসার পথে মাওলানা মুফতি মেহমুদের ছেলে মাওলানা ফজলুর রহমান আমার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি আমাকে তার সাথে ডেরা ইসমাইল খাঁ যেতে অনুরোধ করেন। মুফতি মেহমুদ সেখানে মাহফিলে ওয়াজ করবেন।

মুফতি সাহেবকে আমি চিনতাম এবং গভীর শ্রদ্ধা করতাম। এ জন্য আমি ডেরা ইসমাইল খাঁ যাই ।১৯৭৭ সালে গঠিত হয় পিএনএ এবং রাজনৈতিক দলের প্রধানদের গ্রেফতার করা হয়। আমি তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকি কোনো কোনো দিন আমাকে দূর-দূরান্তে দৈনিক ৮টি পর্যন্ত জনসভায় ভাষণ দিতে হয়েছে।
পিএনএ আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর গাত্রদাহ শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে নির্বাচনি জনসভায় জনগণ আমাকে দেখে মর্দে মুজাহিদ, মর্দে গাজী জেনারেল নিয়াজি, জেনারেল নিয়াজি’ প্রভৃতি শ্লোগান দিতো।
শহর ও গ্রামে যেখানে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের জোটে সদস্যপদ দেওয়া হতো আমি ছিলাম সেখানে ভীষণ জনপ্রিয়। পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সফর করার পর আমাকে করাচি যেতে বলা হয়। করাচিতে আমার প্রথম সমাবেশে প্রায় ১৫ লাখ লোক সমবেত হয়।
পাকিস্তানে কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে আর কখনো এতো লোক হয় নি। লোকজন আমাকে বহু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। আমি তাদের প্রশ্নের জবাব দিই এবং আমার জবাবে তাদেরকে সন্তুষ্ট বলে মনে হয়। আমি বললাম যে, সত্য উদ্ঘাটনের সর্বোত্তম উপায় হচ্ছে গণ- আদালত।
ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও টিক্কা এবং আমাকে তলব করা হোক। জনগণ আমাদেরকে প্রশ্ন করবে। উপস্থিত লোকজনের ভেতর থেকে মনোনীত বিচারকদের একটি প্যানেল রায় দেবে এবং তাদের রায়ে যারা দোষী সাব্যস্ত হবে তাদের শাস্তি হবে। জুলফিকার আলী ভুট্টো এ ধরনের একটি গণ-আদালতে হাজির হতে অস্বীকৃতি জানান।
করাচির মালিরে একদিন এক জনসভা ছিল। পিপিপি’ও একই দিন পাশেই আরেকটি জনসভা আহ্বান করে। হাফিজ পীরজাদা এ জনসভায় ভাষণ দেবেন। পীরজাদা বক্তৃতা দেওয়া শুরু করলে আমিও বক্তৃতা শুরু করি । আমার কণ্ঠ শুনে পীরজাদার জনসভার সব লোক আমার জনসভায় এসে পড়ে।
তখন বলতে গেলে তার সভাস্থল ফাঁকা। পিপিপি’র হাতে গোনা কয়েকজন কট্টর কর্মী ও আয়োজক ছাড়া মাঠে আর কেউ ছিল না। রাগে-ক্ষোভে গজরাতে গজরাতে পীরজাদা সভাস্থল ত্যাগ করেন এবং পিপিপি’র জনসভা পণ্ড হয়ে যায় ।
যে, পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক নয়, সামরিক বিপর্যয় ঘটেছে— এ কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হলে আমাকে কূটনৈতিক দায়িত্ব দেওয়া হবে। আমি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করি এবং বলি যে, এটা একটি রাজনৈতিক পরাজয় এবং সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য তিনি এ সামরিক বিপর্যয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি আমাকে আবার ভেবে দেখতে বলেন। অন্যথায় তিনি আমাকে ‘দেখে’ নেবেন বলেন। আমি তাকে ‘চেষ্টা’ করার কথা বলে বাসায় ফিরে আসি।
জুলফিকার আলী ভুট্টো তার হুমকি বাস্তবায়ন করেছিলেন। তিনি আমার। চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী এবং আমাকে বলীর পাঁঠা বানান। পুরো সেনাবাহিনী থেকে মাত্র আমাদের দুই জনকেই অপসারণ করা হয় এবং পেনশন থেকে আমাদের বঞ্চিত করা হয়। প্রকৃত অপরাধীদের হয় পদোন্নতি নয়তো কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান, হামিদ, পীরজাদা, মিঠা, ওমর প্রমুখকে পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অবসরে পাঠানো হয় এবং সামরিক মর্যাদা তাকে দাফন করা হয়। জেনারেল গুল হাসান। সেনাবাহিনী প্রধান হন জেনারেল ইয়াকুবকে রাষ্ট্রদূত করা হয়। টিক্কা খানও সেনাবাহিনী প্রধান হন।
আরও দেখুন: