[ADINSERTER AMP] [ADINSERTER AMP]

আমাদের আত্মসমর্পণ

আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃআমাদের আত্মসমর্পণ। যা ” দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান- এ এ কে নিয়াজি” বইয়ের অংশ।

আমাদের আত্মসমর্পণ

 

আমাদের আত্মসমর্পণ

 

আমাদের আত্মসমর্পণ 

জেনারেল শ্যাম মানেকশ আমাদেরকে জানান যে, একটি ভারতীয় প্রতিনিধি দল আত্মর্পণের দলিলপত্র চূড়ান্ত করার জন্য ঢাকা আসছে। বিশাল পাখা ঝাপটে একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার ঢাকা বিমান বন্দরে চক্কর দিতে থাকে।

একটু পরেই হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে। মেজর জেনারেল জে আর জ্যাকব, চিফ অব স্টাফ, ইন্ডিয়ান ইন্টার্ন কমান্ড, তার প্রতিনিধি দল নিয়ে হেলিকপ্টার থেকে বের হয়ে আসেন। পাকিস্তানি সিওএস ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী বিমান বন্দরে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ইন্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে নিয়ে আসেন।

ভারতীয় প্রতিনিধি দল এসেছিলেন যুদ্ধবিরতির শর্তাদি নিয়ে আলোচনা করার জন্য। তবে তারা আলোচনা করা ছাড়াই আত্মসমর্পণের একটি খসড়া দলিল সাথে করে নিয়ে আসেন। ব্রিগেডিয়ার বাকিরের অফিসে জ্যাকবের সাথে তার প্রাথমিক আলোচনা হয়।

প্রস্তাব উত্থাপনের পর বাকির এ বিষয়ে আমার সাথে কথা বলেন। আমি ব্রিগেডিয়ার বাকিরকে জেনারেল জামশেদ, ফরমান এবং অ্যাডমিরাল শরীফ এবং ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি সেনা ও নৌ কর্মকর্তাদের সাথে পরমার্শ করার নির্দেশ দিই।

ভারতীয় প্রতিনিধি দল আমাদেকে হুমকি দেয়, যে আমরা তাদের শর্তে রাজি না হলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয়গ্রহণকারী স্থানীয় অনুগত লোকজন ও আমাদের বেসামরিক অফিসারদের মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে এবং মুক্তিবাহিনী তাদের হত্যা করবে। ‘ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড’ শব্দের ব্যবহার এবং আত্মসমর্পণের স্থান ও ধরন সম্পর্কে আমাদের আপত্তি সত্ত্বেও ভারতীয় প্রতিনিধি দলের এ হুমকিতে আমরা তাদের শর্তে আত্মসমর্পণে রাজি হই।

জেনারেলদের মধ্যে একমাত্র ফরমানের আচরণ নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। সংকটকালে তিনি যে দুর্বলতা ও স্খলন প্রদর্শন করেছিলেন তা মিলিয়ে যেতে থাকে। তার চোখ মুখ থেকে ভীতি ও হতাশা দূর হয়ে যায়। ৫ জন গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় এবং ২৫শে মার্চের নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানে জড়িত থাকায় তার প্রতি বাঙালিদের ক্রোধ ও ঘৃণা জন্ম নেয়।

বাঙালিরা তার অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। তাকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের তালিকা একটু বাড়িয়ে দেখানো হয়। কারণ, এ তালিকায় যাদের নাম ছিল তাদের কেউ কেউ তখনো জীবিত ছিলেন। একটি প্রচণ্ড ভীতি গ্রাস করায় ফরমান চেয়েছিলেন। পালাতে। বাঙালিরা যে-কোনো মূল্যে প্রতিরোধ গ্রহণের শপথ নেয়।

আমি ভারতীয় প্রতিনিধি দলকে আমার অফিসে ডেকে পাঠাই সামান্য আলাপ-আলোচনার পর ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানি কর্মকর্তাগণ ভারতীয় প্রস্তাব মেনে নিতে সম্মত হওয়ায়। ভারতীয় প্রস্তাবে বেসামরিক লোকজনের নিরাপদ হেফাজতের ব্যবস্থা না থাকায় আমি ব্যক্তিগতভাবে অসন্তুষ্ট হই এবং উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি ।

১৪ই ডিসেম্বর গভর্নর পদত্যাগ করায় এবং বেসামরিক কর্মকর্তাগণ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেয়ায় সামরিক কমান্ডার ও বেসামরিক প্রশাসক হিসেবে আমার ওপর বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা রক্ষার শুরু দায়িত্ব ন্যস্ত হয়। তাই আমি তাদের রক্ষা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার কোনো চেষ্টা বাকি রাখি নি। আমি জ্যাকবের কাছে দুটি শর্ত পেশ করি :

প্রথম শর্ত : ঢাকা এলাকায় পর্যাপ্ত ভারতীয় সৈন্য এসে পৌছানোর আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেদের আত্মরক্ষা ও বেসামরিক লোকজনকে রক্ষায় তাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র বহন করতে পারবে।

দ্বিতীয় শর্ত: পাকিস্তানি বেসামরিক লোক, বেসামরিক কর্মকর্তা ও স্টাফদের বেসামরিক বন্দির মর্যাদা দিতে হবে এবং সৈন্যদেরকে যেখানে রাখা হবে, তাদেরকেও রাখতে হবে সেখানেই।

জ্যাকব প্রথম শর্তে রাজি হন তাৎক্ষণিকভাবে । তবে আপত্তি করে বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের সাথে বিনিময় না হওয়া পর্যন্ত বেসামরিক লোকজনকে বাংলাদেশেই অবস্থান করতে হবে। আমি ভেবে দেখলাম যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব উভয়ের পক্ষ থেকে স্বার্থহীন ভাষায় বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তার ফয়সালা ছাড়া পরবর্তী আলোচনা হবে অর্থহীন।

আমার অনমনীয় মনোভাবের কারণে জ্যাকব আমাদের পূর্বশর্ত নিয়ে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলতে বাধ্য হন। টেলিফোন দীর্ঘ কথা-বার্তার পর এ বিষয় নিষ্পত্তিতে জ্যাকবকে তার বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। বেসামরিক লোকজনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিতা দূর হওয়ার পর বিষয়টির সুরাহা হয়।

প্রতিনিধি দলের বাঙালি সদস্য এতে আপত্তি করে কিন্তু অগ্রাহ্য হয় তার আপত্তি। এ সময় বহু ঊর্ধ্বতন ভারতীয় ও বাঙালি কর্মকর্তা এবং সাংবাদিক ঢাকা এসেছিলেন। আলোচনা ভেঙে গেলে তাদের যুদ্ধবন্দি হওয়ার ঝুঁকি ছিল। কারণ, তখনো লড়াই চলছিল। যুদ্ধের আচরণ বিধি ও পেশাগত নৈতিকতা অনুযায়ী প্রতিনিধি দলকে কেবল নিরাপত্তা দেওয়া হতো, অননুমোদিত ব্যক্তিদের নয়।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের ধারণা সম্পর্কেও আপত্তি জানিয়েছিলাম আমরা। আমি এভাবে আত্মসমর্পণ করতে চাই নি। তাই আমাদের আলোচনায় অচলাবস্থায় দেখা দেয়। ভারতীয়রা অনমনীয় অবস্থান গ্রহণ করে। তারা অনুগত লোকজনকে হত্যার হুমকি দেয়।

সত্যি সত্যি তখন বহু তরুণকে জবাই করা হয়। আমাদেরকে বলা হয় যে, সব বেসামরিক লোকজনকে মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বিষয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতো। কিন্তু তারা পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ এলাকায় আশ্রয় নেন।

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে পরিত্যাগ করায় আমাকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এরপর মেজর জেনারেল জ্যাকব ও ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী পূর্ব নির্ধারিত এলাকায় বেসামরিক লোকজনকে একত্রিতকরণ এবং অন্যান্য সেক্টরে মোতায়েন সৈন্যদের এক জায়গায় নিয়ে আসা এবং তাদেরকে ওয়াগার দিকে নিয়ে যাবার মতো অন্যান্য প্রশাসনিক সমস্যাগুলোর খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন।

ঢাকার আশপাশে অবস্থানরত সৈন্য, বেসামরিক কর্মকর্তা, বেসামরিক লোকজনও তাদের পরিবারবর্গকে একত্রিত করা ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। সিভিল এভিয়েশন, পিআইএ, কাস্টমস ও কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য কর্মকর্তাদের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সরিয়ে আনতে হবে। শহরে পরিস্থিতি বিভ্রান্তিকর।

মুক্তিবাহিনী তখন খুবই সক্রিয়। তারা বেসামরিক লোকজনের ওপর হামলা চালাচ্ছে। আমার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির দিন-রাত পরিশ্রম করে এসব লোককে সরিয়ে আনেন এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এনে একত্রিত করেন। ঢাকা থেকে আমাদের প্রস্থানের তিন দিনের মধ্যে এ কাজ শেষ করা হয়।

বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারি ও অন্যান্য অনুগত লোকজনের অবস্থা ছিল। হৃদয়বিদারক। তাদেরকে গণহত্যার মুখে রেখে যাওয়ায় তাদের কান্না ও আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। গণহত্যার খবর আসছিল। অনুগত তরুণ পূর্ব পাকিস্তানিদের লাইনে দাঁড় করিয়ে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করেছে।

সাবেক এমএনএ মৌলভী ফরিদ আহমেদসহ অন্যান্যদের হত্যা করে ঢাকার রাজপথে তাদের লাশ টানা- হেঁচড়া করা হয়। আমরা ভারতীয়দের বললাম যে, এসব ঘটনা চুক্তির প্রকাশ্য লঙ্ঘন। কিন্তু ভারতীয়রা আমাদের হাতে দড়ি পরাবার জন্য এসব ঘটনাকে ব্যবহার করছিল।

ভারতীয় যুদ্ধবিমানের ব্যাপক বোমা বর্ষণে ৬ই ডিসেম্বর থেকে আমাদের এফ-৮৬ স্যাবর জেটের বহর অকেজো হয়ে পড়ে। বিধ্বস্ত হয়ে যায় রানওয়ে। এয়ার কমোডর ইনাম জঙ্গিবিমানগুলোকে ব্যবহারোপযোগী নয় বলে ঘোষণা করেন।

পাইলটদেরকে তাদের জীবন বাঁচানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বন্দিত্ব বরণের জন্য রয়ে যান কেবল এয়ার কমোডর ইনাম। আর্মি এভিয়েশনের হেলিকপ্টারগুলো শিশু, নারী ও আহতদের নিয়ে বার্মা (মিয়ানমার) হয়ে পাকিস্তানে চলে যায়।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। মেজর জেনারেল ফরমান ও অ্যাডমিরাল শরীফ এ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন। আমি কাঁপা হাতে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করি। তখন আমার অন্তরে উত্থিত ঢেউ দুই চোখ বেয়ে অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ে। অনুষ্ঠানের একটু আগে একজন ফরাসি সাংবাদিক এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন আপনার অনুভূতি কী, টাইগার?’ জবাবে বললাম, ‘আমি অবসন্ন।’

জগজিৎ সিং অরোরা আমার পাশেই ছিলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, ‘এক চরম বৈরি পরিবেশে তাকে এক অসম্ভব দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। কোনো জেনারেলই এ পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো করতে পারতো না।’

আমাকে যে দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে তাতে আমার কোনো হাত অথবা ইচ্ছা ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্ট আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। তখন আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল :

এক. পশ্চিম পাকিস্তানকে হারানোর ঝুঁকি নেওয়া; অথবা দুই. আমার সুনাম, আমার ক্যারিয়ার, আমার ভবিষ্যৎ ও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর মহান ঐতিহ্যকে বিসর্জন দেওয়া।

পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমি শেষোক্ত পথই বেছে নিই। আমি চরম বিশৃঙ্খল ও সমস্যা সংকুল একটি দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম । দুই জন সিনিয়র জেনারেল বিভিন্ন অজুহাতে এ দায়িত্ব গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। বিদ্রোহের আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠা মাত্র একজন পদত্যাগ করেন এবং আরেকজন পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলেন।

সেনাবাহিনীর এ তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করার সময় সিনিয়রিটিতে আমি ছিলাম দ্বাদশ। তবু আমাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে আমি আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি । কিন্তু আমি আমার সম্মানকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জাতীয় স্বার্থে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করি।

যুদ্ধ জয়ের আনন্দে আত্মহারা ছিল তখন বাঙালিরা ছিল। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর তবু তাদের অনেকেই আমার কাছে এগিয়ে আসেন এবং বলেন, ‘আমরা নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় আরো প্রতিনিধিত্ব এবং উন্নয়নের জন্য আরো বরাদ্দ চেয়েছিলাম।

তবে এ ঘটনা আমরা চাই নি।’ অনেকেই সত্যি সত্যি খুব মর্মাহত ও বেদনার্ত বলে মনে হয়েছে। কয়েক ঘণ্টা আগেও তারা আমাদের রক্তের জন্য পিপাসার্ত ছিল। কিন্তু মুহূর্তে তারা বদলে যায়। তাদের দেখে মনে হয়েছে, আমাদের প্রতি তাদের যেমন ঘৃণা রয়েছে তেমনি রয়েছে মমত্ববোধও।

আমি তাদের বললাম, বিহু রক্ত ঝরেছে। এখন আর অনুতপ্ত হয়ে লাভ নেই। আমরা আমাদের নেতাদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছি। নেতারা ক্ষমতায় যাবার জন্য রক্তপাতের পথ বেছে নিয়েছেন। রোমান সম্রাটরা যেভাবে মল্লযোদ্ধাদের লড়াই দেখতেন, আমাদের নেতারা ঠিক সেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে এ রক্তপাত দেখে তৃপ্ত হয়েছেন।

যুদ্ধে ফলাফল যা-ই হোক, বিজয়ী হবেন তারাই।’ আমি বাঙালিদের সাফল্য কামনা করি এবং আশা প্রকাশ করি যে, আমাদের কালে না হলেও আমাদের নাতি-পুতিদের কালে হলেও এ ক্ষত নিরাময় হবে এবং বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে দুটি দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠবে।

সামরিক ও বেসামরিক সকল পাকিস্তানিদের সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় ভারতীয় ও পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের মধ্যে ব্যাপক আলাপ- আলোচনার পর। স্থির করা হয় যে, পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ট্রেনযোগে ওয়াগাহ সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হবে। আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে বেসামরিক।

 

google news logo
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

লোকজন, তাদের পরে বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ এবং সবার পরে সশস্ত্র বাহিনীকে পাঠানোর নির্দেশ দিই। সব সৈন্য নিরাপদে ভারত সীমান্ত অতিক্রম করার পর তিন বাহিনীর সিনিয়র অফিসারগণ রওনা দেবেন। বেসামরিক লোকজনকে নিয়ে প্রথম ট্রেনটি এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ করে ট্রেনের গন্তব্যস্থল পরিবর্তন করা হয় এবং এলাহাবাদের দিকে ট্রেন যেতে থাকে। তখন আমার আনন্দ হতাশায় পরিণত হয়।

জুলফিকার আলী ভুট্টো নিঃশর্তভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের হাতে একটি তুরুপের তাস। শেখ মুজিব, পাকিস্তানের শিবিরে আটক হাজার হাজার বাঙালি সৈন্য, ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ভারতের স্পর্শ কাতর ভূখণ্ড ফিরোজপুর হেডওয়ার্কস পাকিস্তানের হাতে থাকায় ভারতের সাথে যুদ্ধবন্দি বিনিময়ে পাকিস্তান ছিল একটি শক্তিশালী অবস্থানে।

কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো কলমের এক খোঁচায় পাকিস্তানের এ শক্তিশালী অবস্থানকে তছনছ করে দেন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার পর পাকিস্তান দর কষাকষিতে দুর্বল অবস্থানে এসে দাঁড়ায়।জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন খুবই চতুর। কোন ঘটনা তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যাবাসনে ব্যাঘাত ঘটায়? শেখ মুজিবকে ব্যবহার করে ভারত ও বাঙালিদের কাছ থেকে সর্বাধিক সুবিধা আদায়ের সুযোগ তার ছিল। তাছাড়া তিনি আমাদের হাতে থাকলে আন্তর্জাতিক চাপে দ্রুত সংকট নিষ্পত্তিও হতে পারতো।

জুলফিকার আলী ভুট্টো কেন তাড়াহুড়ো করে মুজিবকে ছেড়ে দিতে গেলেন? ইরানের শাহর পাকিস্তানে আসার কথা ছিল। তিনি শেখ মুজিবকে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের একটি সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে রাজি করানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেওয়া হয় নি। শাহের পাকিস্তান এসে পৌছানোর আগেই মুজিবকে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দেওয়া হয়।

অপদস্থ ইস্টার্ন কমান্ডের যুদ্ধবন্দিদের জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশে ফিরিয়ে নেবেন, তবে অবিলম্বে নয় । এ জন্য মুজিবকে কোনো বোঝাপড়া ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো সফলতার সাথে রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায় ইয়াহিয়া খান এবং সামরিক বিপর্যয়ের দায় নিয়াজির ওপর চাপিয়ে দেওয়া নাগাদ যুদ্ধবন্দিদের ভারতেই থাকতে হবে।

(সৈয়দ আলম রাজা, ঢাকা ডোবাকেল পৃষ্ঠা-১১১) জুলফিকার আলী ভুট্টো ইস্টার্ন কমান্ডের সৈন্য সংখ্যা ৪৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৯৬ হাজার পর্যন্ত উল্লেখ করতেন এবং সিমলা চুক্তিতে এ সংখ্যা ১ লাখ। বলে উল্লেখ করা হয়।

ইতিহাসে একটি দেশের প্রেসিডেন্ট তার নিজ দেশের ভাগ্য বিড়ম্বিত সৈনাদের সম্পর্কে এমন মিথ্যাচার করেছেন কিনা সন্দেহ। জুলফিকার আলী ভুট্টোর এ মিথ্যাচার গুল হাসান অথবা টিকা কেউই সংশোধন করেন নি।

ইস্টার্ন কমান্ডে পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য ছিল মাত্র ৩৪ হাজার। রেঞ্জার্স, স্কাউট, মিলিশিয়া ও বেসামরিক পুলিশ মিলিয়ে আরো ছিল ১১ হাজার। সব মিলিয়ে ইন্টার্ন কমান্ডে সশস্ত্র সদস্য ছিল ৪৫ হাজার। নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য, ইন্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর, সামরিক আইন প্রশাসকের কার্যালয়, ডিপো, প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ওয়ার্কশপ ও ফ্যাক্টরি প্রহরায় নিয়োজিত ব্যক্তি, নার্স, মহিলা ডাক্তার, পাচক, ধোপা, নাপিতসহ হিসাব করলে এ সংখ্যা বড়ো জোর ৫৫ হাজারে পৌঁছে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ৯৬ হাজার অথবা ১ লাখ হয় না।

৪৫ হাজারের বাইরে যাদেরকে হিসাবে ধরা হয় তারা হচ্ছে বেসামরিক কর্মকর্তা, কর্মচারি এবং মহিলা ও শিশু। ভারতীয়রা যেখানে ইন্টার্ন কমান্ডে নিয়োজিত তাদের সৈন্য সংখ্যা ১২ ডিভিশনের স্থলে ৮ ডিভিশন বলে উল্লেখ করছে, সেখানে জুলফিকার আলী ভুট্টো আমাদের সৈন্য সংখ্যাকে ৪৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৯৬ হাজার বলে উল্লেখ করতেন।

ইস্টার্ন কমান্ড এবং এ কমান্ডের সৈন্যদের বিদ্রূপ করা যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে সে উদ্দেশ্য অর্জিত হয় নি। এটা গোটা জাতিকে বিদ্রুপ করার শামিল এবং ভারতীয় অপপ্রচারকে জোরদার করার একটি প্রচেষ্টা মাত্র। ভারতীয়রা দাবি করছে যে, তারা ৯৬ হাজার সৈন্যের একটি বিরাট বাহিনীকে পরাজিত করেছে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ইন্টার্ন কমান্ডের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে বলে ভারতের দাবিকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন।

এটা মনে রাখতে হবে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট এবং সরকার প্রধান হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ নয়। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার হাই কমান্ড ও প্রাদেশিক সরকার আমাকে পরিত্যাগ করে। এ জন্য বেসামরিক ও সামরিক উভয় বিষয়ে আমাকের একাই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

গভর্নর তখনো তার পদে বহাল থাকলে প্রাদেশিক সরকার প্রধান ও প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে তাকেই আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করতে হতো, সৈন্যদের কমান্ডার হিসেবে আমাকে নয়। পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খান প্রয়োজনীয় সব দলিলে। স্বাক্ষর করেছেন; ভারপ্রাপ্ত সি-ইন-সি হিসেবে সেনাবাহিনী প্রধান অথবা চিফ অব জেনারেল স্টাফ নয়।

সেনাবাহিনীর যুদ্ধবন্দি ও বেসামরিক লোকজনকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্পে নেওয়া হয়। লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং আমাকে জানান যে, ২০শে ডিসেম্বর সিনিয়র অফিসারদের কলকাতা নেওয়া হবে। তবে ভারতীয়রা রাও ফরমান আলীকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রেখে যেতে চেয়েছিল।

৫ জন গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা থাকায় প্রতিটি কাজ-কর্মে তার হাত ছিল এবং তিনি নির্বাচন পরিচালনা ও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতে চূড়ান্ত ভূমিকা পান করেছেন।বস্তুতপক্ষে, ফরমান ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিলেন। তার ভূমিকায় বাঙালিরা ক্রুদ্ধ হয়। ২৫শে মার্চের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় তার বিরাট ভূমিকা ছিল। বাঙালিরা তাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিল না।

আমি তখন জোর দিয়ে বললাম যে, জেনারেল শ্যাম মানেকশ’র প্রদত্ত আশ্বাস অনুযায়ী কোনো পাকিস্তানি সৈন্যকে তদন্তের জন্য ভারতীয়দের কাছে হস্তান্তর করা। যাবে না। কথিত আচরণ সংক্রান্ত যে কোনো তদন্ত রিপোর্ট সিদ্ধান্তের জন্য একটি পাকিস্তানি আদালতে পেশ করতে হবে।

একইভাবে, গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থায় কর্মরত কোনো কর্মকর্তাকেও আটক করার অনুমতি দেওয়া হয় নি। আমাদের সাথে আলবদর ও আলশামসের কয়েকজন সদস্যও ছিল। তারা যুদ্ধে আমাদের সহায়তা করেছে। এ জন্য বাঙালিরা তাদের খুঁজছিল।

আমাদেরকে কলকাতার পথে রওনা দিতে হবে ২০শে ডিসেম্বর সকালে। আমি তাই আমার কমান্ড পোস্ট এলাকায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি যে, কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক লোকজনকে জড়ো করা হয়েছে। আমি তখন তাদেরকে জানাই যে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশে আমাদেরকে অস্ত্র সমর্পণ করতে হয়েছে। আমি আরো বললাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য প্রেসিডেন্ট এ নির্দেশ দিয়েছেন।

আমি নিজে, মেজর জেনারেল ফরমান, অ্যাডমিরাল শরীফ, এয়ার কমোডর ইনামুল হক, ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী, ব্রিগেডিয়ার এসএস কাসিম, আমাদের এডিসি ও ব্যাটম্যানগণ ক্যারিবু হেলিকপ্টারে কলকাতার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করি। আমি ফরমানের এডিসি পরিচয় দিয়ে আমার পিআরও মেজর সিদ্দিক সালিমকেও সাথে নিই। বাঙালি ও ভারতীয় উভয়েই তাকে খুঁজছিল।

আমি তাকে তাদের হাতে ছেড়ে দিতে চাই নি। বাংলাদেশের সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগৎ সিং ঢাকা বিমান বন্দরে আমাদের বিদায় জানান । আমরা কলকাতা দমদম বিমান বন্দরে অবতরণ করি। হেলিপ্যাড থেকে দুটি স্টাফ গাড়ি আমাদের নিয়ে ফোর্ট উইলিয়ামে আমাদের আবাসিক কোয়ার্টারের উদ্দেশে যাত্রা করে।

আমাদের আবাসিক কোয়ার্টারটি ছিল একটি নবনির্মিত তিন তলা ভবন। বেশ পরিচ্ছন্ন, সাজানো-গোছানো। একটি কক্ষকে ডাইনিংরুমে পরিণত করা হয়। এখানে সকল অফিসারগণ খাওয়া-দাওয়া করতেন। আমাদেরকে সিপাহীর রেশন দেওয়া হতো।

ভারতীয় পাচকরা রান্না করত। তবে পরিবেশন করতো আমাদের নিজস্ব আর্দালি। ব্যায়াম, বই পড়া ও রেডিও শোনা প্রভৃতি সময় কাটানোর নিয়মিত রেওয়াজে পরিণত হয়। আমরা রেডিওতে শুনতে পেলাম যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।

ফরমান রেডিওতে এ সংবাদ শুনে মন্তব্য করল, যে কিছুদিন বিলম্বে অভ্যুত্থান ঘটেছে। কিছুক্ষণ পর মেজর জেনারেল নজর, মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারী ও মেজর জেনারেল কাজী মজিদ আমাদের সাথে যোগ দেন। মেজর জেনারেল জামশেদ তখনো এসে পৌঁছান নি। কর্নেল খারা কলকাতায় আমাদের দেখাশোনা করতেন।

 

আমাদের আত্মসমর্পণ

 

উদ্বিগ্ন হয়ে তার কাছে জামশেদ সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি তখন আমাকে জানান যে, জামশেদ প্রশাসনিক বিষয়াদিতে সহায়তা করার জন্য এখনো ঢাকা রয়েছেন তিনি সুস্থ আছেন এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি পরে জানতে পারি যে, তিনি ঢাকায় নেই। কলকাতায় একটি নির্জন সেলে আটক রয়েছেন। আমার অনুমতি ছাড়া তাকে কারাগারে নেওয়া হয়।

আরও দেখুন:

Leave a Comment